অনেক মানুষকে নিয়োজিত করতে পারাটাই স্বপ্ন’র স্বপ্ন

করোনাকালীন এই সময়ে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রথমত আমাদের কর্মীদের নিরাপত্তা। তাদের সামনে একটা মিশন তুলে ধরা। তারা কেনো এই সময় কাজ করবে? আমরা তাদেরকে কিভাবে নিরাপদে রাখবো, এটাই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে,কাস্টমাররা কেনো স্বপ্নে আসতে নিরাপদ বোধ করবেন? তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, মালামালের যোগান অব্যাহত রাখা এবং পণ্যের দাম ঠিক রাখা,যাতে সবার নাগালের মধ্যে থাকে। অনেক কাস্টমার এই সময় দুই তিন মাসের পণ্যে একসাথে বাসায় মজুদ করা শুরু করেছেন। স্বপ্ন আপামর জনগণের সুপার শপ। আমাদের সেবা, সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারাটাও একটা চ্যালেঞ্জ। এগুলোই হচ্ছে আমাদের মুখ্য চ্যালেঞ্জ। আমরা প্রথম দিকের চ্যালেঞ্জগুলো পার করেছি। এখন পরের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, যারা ঘরে বসে বাজার করতে চান, তাদের জন্য নতুন কি আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে,হোম ডেলিভারি। আপনারা দেখেছেন, ইতিমধ্যে আমরা হোম ডেলিভারি চালু করছি। আমরা ই-কমার্স চালু করেছি। আমাদের বেচা বিক্রি এখন ১৫ শতাংশই অনলাইনে হয়।

সমাজের প্রান্তিক কিছু মানুষ যারা সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত, তাদের পাশে কিভাবে দাঁড়ানো যায়, সে ভাবনা আমাদেরকে তাড়িত করে। এই প্রান্তিক মানুষগুলো সবসময়ই যে নিম্নবিত্তের হবে, তা কিন্তু না। কখনো এই প্রান্তিক মানুষের কাতারে গারো সম্প্রদায়, তাদের দিকে কেউ নজর দেয় না, তারা চাকরিহীন, কর্মহীন। কখনোবা ফ্রিল্যান্সার কমিউনিটি এই প্রান্তিক মানুষের কাতারে। আবার বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা, যাদেরকে আমরা এনআরবি বলি, তারাও এই প্রান্তিক মানুষের দলে। কখনো প্রান্তিক কৃষক, যাদের মালামাল বাজারে আনতে পারছে না। কখনোবা এই দলে তৃতীয় লিঙ্গের কর্মীরা, যাদের এই সময়ে কোনো আয় রোজগার হচ্ছে না। এদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে,তাদের দিকে কেউ তাকায় না, স্বপ্ন তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে এবং সহযোগিতা করেছে।

এবার করোনাকলীন এই মুহুর্তের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। আমি যেভাবে দেখি, আমাদের বিভিন্ন সিস্টেম আছে। যেমন হেলথকেয়ার সিস্টেম,ইকোনোমি সিস্টেম,সোশ্যাল সিস্টেম। এই সিস্টেমের মধ্যেও কম্প্রোমাইজ করা হয়। এই মুহূর্তে ইকোনোমি সিস্টেম কিছুটা কম্প্রোমাইজড। আমাদের এখন হেলথকেয়ারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন,এখন আমাদের মানব সম্পদ রক্ষা করা জরুরি। যেহেতু আমরা গরীব দেশ, আমাদেরকে অর্থনীতিতে স্বাবলম্বী হতে হবে। যাতে আমাদের চল্লিশ পার্সেন্ট লোক বেকার না হয়,এটাও একটা চ্যালেঞ্জ। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অসংখ্য চ্যালেঞ্জ ফেইস করতে হয়। যেমন ধরেন, যখন পলিসিগুলো প্রতিষ্ঠা হয়, তখন উপরের দিকে পলিসিগুলো সুন্দর থাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে চিন্তাগুলো করেন, অনেক সুন্দর চিন্তা। কিন্তু প্র্যাকটিস লেভেলে যখন নিচের দিকে নামি, তখন বাস্তবে জিনিসগুলো অনেক সময় ক্যাপচার করা কঠিন হয়ে যায়। যেমন শপিং আওয়ারের কথাই বলি, শপিং আওয়ার যদি কমিয়ে দেই। সকাল নয়টা থেকে সাতটা পর্যন্ত ছিল। এখন কমিয়ে তিনটা পর্যন্ত দেয়া হয়,তাহলে কিন্তু জন-মানুষের আরো বেশি ভিড় বাড়বে। যদি শপিং আওয়ার বাড়িয়ে দেয়া হয়, তাহলে কম সংখ্যক মানুষ আসবে। তখন প্রতি ঘন্টায় কম সংখ্যক মানুষ কাজ করবে। সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখার জন্য,সময়টা বাড়িয়ে খোলা রাখলে ভালো হতো। এই ছোট ছোট পলিসি, যেগুলা টেকনিক্যাল পলিসি,কতক্ষণ খোলা থাকবে এইসব সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়, আমাদের মতো যারা প্র্যাকটিক্যালি কাজ করে মাঠে ঘাটে, তাদের থেকে যদি ইনপুট নেওয়া হয়, তাহলে মনে হয় আরো ভালো হবে।

আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে,আমরা সোসাইটিতে অনেক সময় ক্লোজনেসবায়াসে ভুগি। যেমন ধরুন, আপনার সাথে আমার প্রত্যেকদিন দেখা হচ্ছে, আমার অফিসে আসেন। আমার মনে হচ্ছে, আপনি সব ঠিকঠাক মতো করছেন। আরেক জন অনেক বেশি কাজ করছে, আমি তাকে চিনি না, তার কথা শুনতে পারবো না। সোসাইটিতে অনেক কথা কিন্তু ক্যাপচার হয়। আমাদের মতো যারা সাপ্লাই চেইন নিয়ে করি, কতৃপক্ষের সাথে যাদের একটা মিটিং করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। তাদের অনেক অব্যক্ত বেদনা থাকে। এই অব্যক্ত বেদনাগুলো শোনার লোকজন কম,তাদের বলার জায়গা অনেক কম। বলার জায়গা যদি পাওয়া যেত, তাহলে ভালো হতো। চ্যালেঞ্জের মধ্যে মোটামুটি এগুলোই উল্লেখ করার মতো।

স্টক মার্কেটের অবস্থা বেশি ভালো না। গত চার মাস ধরে স্বপ্ন অপারেটিং প্রফিটে আছে। এটা ভালো খবর, স্টক মার্কেটে যারা আমাদেরকে ফলো করেন, তাদের জন্য বলছি। আমার ধারণা, স্বপ্ন এ মাসেও অপারেটিং প্রফিট করবে। এটা একটা ভালো খবর। লাস্ট ইয়ারের রিভিউ যদি বলি,প্রায় ৯০ শতাংশ অপারেটিং প্রফিটে গ্রোথ হয়েছে। স্বপ্নকে বাড়াতে গিয়ে অনেক ঋণ নিতে হয়েছে। আমি এই প্রেক্ষিতে প্রথম থেকেই বলে আসছি, এর মধ্যে ইকুইটি ইনজেক্ট করতে হবে। প্রাইভেট, ফরেইন অথবা লোকাল বিনিয়োগ আনতে হবে। আমরা উদ্যোগও নিয়েছিলাম, কিন্তু করোনার কারণে বিষয়টি আটকে গেছে।

এবারের বাজেটের দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক। আমাদের উপর অর্থাৎ স্বপ্নের মতো সুপার সপগুলোর উপর ৫% ভ্যাট আগে থেকেই ছিল। আমরা বলেছিলাম এই ৫% ভ্যাট উঠিয়ে দেওয়ার জন্য। কারণটা হচ্ছে, করোনার সময় ব্যাপক সংখ্যক মানুষ সুপার সপকে বেছে নিয়েছেন। সুপার শপ এখন বিলাসিতার জায়গা নয়। সুপারশপে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত সবাই যায়। এমন না যে শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত মানুষেরা যায়। এটা আমরা সবাই জানি, আমাদের জিডিপি কমেছে এবং কোনো সন্দেহ নাই জিডিপি ২ থেকে ৫ শতাংশ কমবে। জিডিপি যদি ২ থেকে ৫ শতাংশ কমে, তাহলে ইনকাম কমেছে। ইনকাম যদি কমে, তাহলে শহরের মধ্যবিত্তের উপর চাপ পড়ছে। মধ্যবিত্তের উপর যদি চাপ পড়ে থাকে, তাহলে তার উপর আবার এক্সট্রা ৫ শতাংশ ভ্যাট চাপিয়ে দিয়ে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। নিরাপদভাবে সুপারশপে সামাজিক দুরুত্ব মেনে শপিং করা থেকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এটা না করে যদি খোলাবাজারে গিয়ে ঠেলা ঠেলি করে শপিং করা হয়, তাহলে তো সমস্যা। সুপার শপের উপর ৫ পার্সেন্ট হিসাব করে, সরকার মাত্র ৮০ কোটি টাকার মতো ভ্যাট পায়। এই ৮০ কোটি টাকা সরকারের রেভেনিউ-এর তুলনায় কিছুই না। এই ভ্যাট কমালে মধ্যবিত্তের উপর চাপটা কমতো। সুপার শপগুলোর ফার্স্ট হওয়ার একটা প্রবণতা বাড়তো। আমি মনে করি, সুপারশপ চেইন থেকে প্রায় ৬০ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব।

সুপারশপ খাতের সার্বিক উন্নয়ন করতে হলে আমি বলবো,প্রথমেই ৫% ভ্যাট উঠানো উচিৎ। বিদেশি প্রাইভেট ফার্মগুলো যাতে এখানে ইনভেস্ট করে, সেজন্য একটা কমিটি করা উচিত। বিদেশীরা যাতে সুপারশপগুলোতে ইনভেস্ট করে সে ব্যাপারে আলোচনা করা দরকার। সারাদেশে সুপারশপের জন্য আলাদা জায়গা তৈরি করে দেয়া উচিৎ। সরকারের অনেক জায়গা পড়ে আছে, যেখানে খোলা নিরাপদ খাদ্যের বাজার করা যেতে পারে। যেখানে কৃষক সরাসরি যুক্ত হয়ে তার ন্যায্য দামটা পাবেন। এমন জায়গাটিই হতে পারে সুপারমার্কেট। আমি মনে করি, সারা বাংলাদেশ এক লক্ষ সুপার মার্কেট হতে পারে।

এই সময়ে স্বপ্নের গ্রাহকদের জন্য আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আমাদের মধ্যে তিনটা পলিসি আছে। কাস্টমারের সাথে সবসময় ভালো ব্যবহার করা এবং ভালোভাবে কথা বলা। আমরা যেটা করি সেটা হচ্ছে, কাস্টমারদেরকে সব সময় বলি, প্লিজ স্যার মাস্ক পরে আসুন, হ্যান্ডসেনিটাইজ করে আসুন। অনেক কাস্টমার শোনে না। আসল কথা হচ্ছে, কাস্টমার ইজ অলওয়েজ রাইট। প্রত্যেকদিন আমরা ভুলের বিশ্লেষণ করি। সপ্তাহে একদিন বৃহস্পতিবার ভুলের একটা বিশ্লেষণ কমিটি করি। যেভুলগুলো হয়,সে ভুলগুলোকে সংশোধন করার জন্য চেষ্টা করি।

কীভাবে আমাদের ভুলগুলো বিশ্লেষণ করি, সেটা একটু আলোকপাত করা যাক। কাস্টমাররা আমাদের ভুল ধরেন। আমাদের ফেসবুক পেইজে ওনারা লেখেন, আপনি এটা করছেন, সেটা করেছেন, আপনার এটা ভুল হয়েছে ইত্যাতি ইত্যাদি। আসলে আমাদের অনেক ভুল হয়ে যায়। যেমন ধরুন মাছ। এখনো এমন কোনো মেশিন আবিষ্কার হয়নি, যে মেশিন দিয়ে একটা মাছের ভিতরের একটি অংশে, কোনো একটা পার্টিকেল পচে গেছে কিনা, সেটা জানা যায়। অথবা একটা মাছের প্রত্যেকটি জায়গায় কত ডিগ্রি সেলসিয়াস টেম্পারেচার থাকবে, এটা জানা যাবে, এরকম মেশিন এখনো বের হয়নি। তারপর আমরা মাছ যেখানে রাখি, বরফের টেম্পারেচার আমরা মাপি। তারপরে মাছটা কাস্টমারের সামনে কাটা হয়। মাছে গন্ধ থাকলে কাস্টমারকে দেওয়া হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, ভুল হয়। প্রতিদিন প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার কাস্টমার আমাদের সেবা গ্রহণ করেন। এখান থেকে দু একজনের যদি কমপ্লেইন আসে, তখন আমরা বলি ঠিক আছে স্যার, আমাদের ভুল হয়েছে, আমরা ক্ষমা চাচ্ছি। আমরা পারলে ওইদিনই একটা মাছ কিংবা ফল পাঠিয়ে দেই,সাথে ফুলের তোড়া দিয়ে ক্ষমা চাই। এরপর আমরা ভুল বিশ্লেষণ করে, কি করে সমাধান করা যায় তা বের করার চেষ্টা করি। এটাই আমার মনে হয়, সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। দ্বিতীয় উদ্যোগ হলো, কি করে আমরা কৃষকের উন্নয়ন করতে পারি, সে চেষ্টা করছি। এজন্য আমরা প্রত্যেক মাসে চিন্তা করি, কটা গ্রামে আমরা কি কি উদ্যোগ নিয়েছি। তা থেকে কৃষকের কি লাভ হয়েছে। অনলাইন স্পেসে আমরা কাস্টমারদের জন্য কি করতে পারছি।

অনেক মানুষকে নিয়োজিত করতে পারাটাই স্বপ্ন’র স্বপ্ন। আরো বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, স্বপ্ন’র সবচেয়ে বড় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে, সারা বাংলাদেশে প্রতিটি প্রান্তে স্বপ্ন’র শপ থাকবে। অসংখ্য মানুষের সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। সেইসব মানুষের কর্মসংস্থান হবে, যারা অন্য জায়গায় চাকরি পাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশের অনেক মেধাবী লোকের ভালো জায়গায় চাকরি হয় না। আমরা সেই মানুষগুলোকে কাজ দিতে চাই। এমন লোক আমাদের দরকার, যারা খাটাখাটনি করতে চায়, সৎ মানুষ।

সাব্বির হাসান নাসির
নির্বাহী পরিচালক
এসিআই লজিস্টিকস লিমিটেড