আমদানি ও অভিযান চালের বাজারে অল্প পরিবর্তন

কাজী লুৎফুল কবীর: আমদানি শুল্ক কমানো, বাকিতে ঋণপত্র খোলার সুযোগসহ নানা উদ্যোগে চালের বাজারের অস্থিরতা কমানো না গেলেও,গেলো সপ্তাহে আমদানী,পাটের বস্তা শিথিল ও অভিযানের মাত্রা বাড়ায় কিছুটা নিয়ন্ত্রনে মোকাম ও পাইকারি বাজার। এরইমধ্যে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় পাইকারি বাজারে মোটা চালসহ সব ধরনের চিকন চাল কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা করে কমেছে। বিশেষ করে অভিযানের ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের বড় বড় মোকামগুলোতে এর প্রভাব পড়ে বেশ। তবে খুচরা বাজারে প্রভাব নেই বললেই চলে। খুচরা বাজারে চালের দর আগের মতোই। তবে প্রকারভেদে মোটা চালে কেজিপ্রতি ১ থেকে ২ টাকা কমলেও,চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০/৫৫ টাকা করে।

উল্লেখ গেলো দু থেকে তিন মাস ধরে আমদানি শুল্ক কমানো ও বাকিতে ঋণপত্র খোলার সুযোগ দিয়েও কমানো যাচ্ছিল না চালের বাজারের অস্থিরতা। গেলো সপ্তাহজুড়ে লাগামহীনভাবে বেড়েছে মোটা চালসহ বিভিন্ন ধরনের চাল দর। ফলে দিনে দিনে নাভিশ্বাস উঠছে ভোক্তাদের। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারসাজি করে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে নানা মহলে। এই সিন্ডিকেট অবৈধভাবে চাল মজুত করার পাশাপাশি স্তরে স্তরে অপপ্রচার চালিয়ে চালের দাম বাড়াচ্ছে।

এরইমধ্যে চালের বাজারে অস্থিরতার পেছনে অবৈধভাবে চাল মজুদকারী ১৬ হাজার মিল মালিককে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করেছে সরকার। তারপরও থামছে না চালের দরদামের উধ্বগতি। বর্তমানে রাজধানীর খুচরাবাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ( ইরি, গুটি স্বর্ণা) ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, বিআর-২৮ ৫২ থেকে ৫৪ টাকায়, মিনিকেট ৫৮ থেকে ৬০ ও নাজিরশাইল ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ঢাকার দুই পাইকারি বাজার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও বাবুবাজার-বাদামতলীর চালের আড়তে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৪৮ থেকে ৫০ টাকা উঠেছে। অন্যদিকে, সরু মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৫ টাকা কেজিতে। মাঝারি মানের বিআর ২৮ চালের দাম কেজিপ্রতি ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা চাইছেন বিক্রেতারা।

ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশে কখনোই মোটা চালের কেজিপ্রতি দর ৫০ টাকা ছাড়ায়নি। আবার ধানের দামও এত বেশি হয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন বিশ্ববাজারে চালের দাম টনপ্রতি ১ হাজার ডলার হয়েছিল, তখনো ঢাকার বাজারে মোটা চালের কেজি ৪০ টাকার আশপাশে ছিল।

খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম গত ১৪ সেপ্টেম্বর বৃহষ্পতিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা চাল নিয়ে চালবাজি করছেন। চাল নিয়ে রাজনীতি চলছে। চালবাজি ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সমস্ত দেশকে একটা বিভ্রাটের মধ্যে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে একটি চক্র।

এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালের বাজারে হঠাৎ করে অস্থিরতা তৈরি হয়নি। হাওরে অকাল বন্যায় যখন আগাম বোরো ফসলের ক্ষতি হলো তখন কেন টনক নড়েনি খাদ্য অধিদপ্তরের? তখনতো সরকারের গুদামে চালের মজুদ তলানীতে ছিল। সে সময় কেন খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আগাম সংকটের আভাস পেলেন না। সময়মতো চাল আমদানির উদ্যোগ নিলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হতো না। এছাড়া চাল আমদানিতে শুল্ক যখন কমানোই হলো, তাহলে তা আরো আগে কেন হলো না? নাকি শুল্ক কমানোর জন্যই ইচ্ছাকৃতভাবে চালের বাজারে এ অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছিল?

খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত মার্চের দিকে চালের মজুদের পরিমাণ কিছুটা কমে আসলেও তা ছয়-সাত লাখ টনের নিচে নামে না। আর মে মাসে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বোরো সংগ্রহ শুরু হলে, মজুদ বাড়তে থাকে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি পুরোপুরি উল্টো হয়েছে। কারণ, তার আগেই হাওরে অকাল বন্যায় আগাম বোরো ফসল নষ্ট হয়েছে। ফলে খাদ্য বিভাগ অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বোরো সগ্রহে ব্যর্থ হয়েছে। এ সংকট মোকাবেলায় যদি দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হতো, তাহলে চালের বাজারে এ সমস্যা হতো না।

খাদ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা বলেন, চালের মজুদ তলানীর ও হাওরে অকাল বন্যায় বোরো ফসলের ক্ষতিতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন সময় মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তখন বিষয়টি গুরুত্ব্্ দিলে চালের বাজারে কোন সংকট তৈরী হতো না।
তবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলছেন, যারা বলেছে চালের মজুত কম থাকায় দাম বেড়েছে তারা ভুল ব্যাখ্যা করছে। শুধু সরকারি বিতরণ ব্যবস্থায় চাল সরবারহ করা হয়। সরকার দেরিতে চাল আমদানি প্রক্রিয়া কেন শুরু করল- এমন প্রশ্নে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, যথাসময়ে চাল আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। ট্যারিফ উঠিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা আগেই চিঠি লিখেছিলাম।

বাংলাদেশ অটো মেজর, রাইস ও হাসকিং মিলের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, হাওরে অকাল বন্যায় ও ব্লাস্ট রোগে ২০ থেকে ২৫ লাখ টন চালের ঘাটতি হবে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলে ধানের ফলন ভালো হয়নি। প্রতি হেক্টর জমিতে ৬ থেকে ৮ মণ ধান কম হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। দাম বাড়ার ক্ষেত্রে মিল মালিকদের কোন কারসাজি নেই।

অবৈধ মজুত ও অপপ্রচার

চালের দাম বাড়ার কোন কারণ নেই বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, গত বোরো মৌসুমে এক কোটি ৯১ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যা ও বিভিন্ন রোগবালাইয়ে ২০ লাখ টন ফসল নষ্ট হয়েছে। কিন্তু তারপরও এক কোটি ৭০ লাখ টন বোরো ধান পাওয়া গেছে। এরসাথে ২২ লাখ টন আউশ ধান পেয়েছি। সবমিলিয়ে ১ কোটি ৯২ লাখ টন ধান আমাদের ঘরে এসেছে।

সংকট কোথায়

অভিযোগ উঠেছে, চালের বাজার অস্থিতিশীল করতে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। সিন্ডিকেটটি ব্যবসায়ীদের মাঝে অপপ্রচার চালাচ্ছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর ভারতের মিনিস্ট্রি অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’র স্বাক্ষর বিহীন একটি ভুয়া চিঠি বন্দর এলাকায় বিভিন্ন ব্যাসায়ীদের মাঝে প্রচার করেছে। চিঠিতে বলা হয়, ১৫ সেপ্টেম্বরের পর ভারত বাংলাদেশে চাল রফতানি করবে না। চিঠিটি মোবাইলে ছবি ধারন করে তা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের মাঝে। চিঠির সূত্র ধরে পরে আমদানিকারকরা চালের মূল্য কেজি প্রতি ২/৩ টাকা করে বাড়িয়ে দেন। চিঠির গুজবে বাজারে চালের দাম হু হু করে বাড়াতে শুরু করে। অনেক আমদানিকারক বন্দর থেকে চাল খালাশের পর, তা তাদের নিজস্ব গুদামে স্টক করতে শুরু করেন। তবে এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। এরইমধ্যে চালের অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা।

দর নিয়ন্ত্রনে চালের মোকাম

কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক সড়কের দুই পাশে প্রায় ৫০০ ছোট-বড় চালকল রয়েছে, যা খাজানগর মোকাম হিসেবে পরিচিত। এসব চালকল থেকে দিনে প্রায় আড়াই হাজার মেট্রিক টন চাল ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যায়। দেশের চালের বাজারে বড় ভূমিকা রাখে কুষ্টিয়া। কুষ্টিয়া থেকে সরবরাহ হয় মূলত সরু ও মাঝারি চাল। আর ভারত থেকে আসছে মোটা চাল।

খাজানগরের চালকলের মালিকেরা বলছেন, বাজারে ধান মিলছে না। কিছু কিছু পাওয়া গেলেও দাম উঠেছে মণপ্রতি দেড় হাজার টাকায়। এ ধান কিনে চাল উৎপাদন করলে এখনকার দামেও পোষাবে না।

চাতালগুলো বেশির ভাগই খালি। কিছু কিছু চাতালে ধান শুকাচ্ছেন শ্রমিকেরা। তবে কুষ্টিয়ায় বেশি উৎপাদনক্ষমতার ৩১টি আধুনিক প্রযুক্তির অটো রাইস মিল আছে, সেগুলো প্রায় সবই চলছে। সরু ও মাঝারি চাল মূলত এসব অটো রাইস মিলেই উৎপাদিত হয়।

খাজানগরের বেশির ভাগ মিলেই এখন মোটা চাল নেই। ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, মোটা চালের বাজার এখন ভারতের ওপর নির্ভর করছে। সেই চাল আসছে মূলত বেনাপোল বন্দর দিয়ে। ঈদের পরে বন্দর খোলার পর সেখানে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা, যা গতকাল ৪৮ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

চালকলের মালিকদের সভা ও অভিযান

চালের বাজারের অস্থির অবস্থার জন্য চালকলের মালিকদের কারসাজিকে দায়ী করেছেন সরকারের দুজন মন্ত্রী। চালকল মালিকদের সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদের খাজানগরের মিলে অভিযানও চালানো হয়েছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি আলোচনার জন্য আগামী মঙ্গলবার চালকল মালিকদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকে মালিকদের অবস্থান কি হবে, তা ঠিক করতে বগুড়ায় ১৬ সেপ্টেম্বর শনিবার বৈঠক করেছেন বিভিন্ন জেলার চালকল মালিক সমিতির নেতারা।

বগুড়ায় বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় নেতাদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। আগামী মঙ্গলবার সরকারের সঙ্গে অনুষ্ঠেয় বৈঠক সামনে রেখে চালকল মালিকেরা এ সভা করেন।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুর রশিদের সভাপতিত্বে বৈঠকে সংগঠনের সারা দেশের শতাধিক নেতা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, চালের মূল্য হঠাৎ করে বৃদ্ধির জন্য একটি গণমাধ্যমের খবরই দায়ী। চালের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার জন্য কোনোক্রমেই চালকলের মালিকেরা দায়ী নন। একজন মিলের মালিকের চালকলের জন্য ১৫ দিনে যে ধান প্রয়োজন, তার পাঁচ গুণ ধান-চাল গুদামে মজুত করার বৈধতা রয়েছে।

নাটোরে মজুত চালের বস্তায় উৎপাদন তারিখ না থাকায় নাটোরের দুটি চালকলকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। শনিবার বড়াইগ্রাম উপজেলার গড়মাটি এলাকার রশিদ অটো রাইস মিল ও বনপাড়ার গাজী রাইস মিলে অভিযান চালানো হয়। এ সময় রশিদ অটো রাইস মিলে চালের বস্তায় উৎপাদন তারিখ উল্লেখ না থাকায় ভোক্তা অধিকার আইনে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এদিকে ১৭ সেপ্টেম্বর রোববার সচিবালয়ে অটোরাইস মিল অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানান,সারাদেশে চালকলগুলোতে অভিযানের জন্য জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চালের অবৈধ মজুত পেলে ওই চালকল মালিককে গ্রেপ্তার করা হবে।

তিনি বলেন, নওগাঁয় বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদের গোডাউনে অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে মজুত রাখা বিপুল পরিমাণের চাল পাওয়া গেছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ায় আব্দুর রশিদের আরেকটি গোডাউনে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণে চাল উদ্ধার করা হয়।

এসময় বাণিজ্যমন্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তারা ষড়যন্ত্র করছেন। তাদেরকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিন বৈঠক থেকে মন্ত্রীর নির্দেশে আব্দুর রশিদের মিলে অভিযান চালায় পুলিশ। নির্দেশ দেয়া হয় গ্রেফতারের।
এমন নির্দেশের একদিন পর, ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশিদ, সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলীসহ ব্যবসায়ীদের নিয়ে তিনমন্ত্রীর আরেকটি বৈঠকে আসে নতুন সিদ্ধান্ত। চাল আমদানীতে ব্যবসায়ীদের যুক্তি মেনে ৩ মাসের জন্য শিথিল করা হয়,চালের বস্তায় পাটের ব্যবহার। বৈঠকে চালের ঘাটতি মেটাতে ব্যবসায়ীদের উন্মুক্তভাবে চাল আমদানির নির্দেশনা দেওয়া হয়। চালের দর কমাতে ব্যবসায়ীরা যুক্তি দেখান চাল সংরক্ষণ ও পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের বস্তা ব্যবহারের কারণে চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। চটের বস্তার কারণে প্রতি কেজিতে এক টাকা খরচ বাড়ে। কিন্তু প্লাস্টিকের বস্তা অনেক সাশ্রয়ী। প্লাস্টিকের বস্তায় খরচ হয় মাত্র ১৫/১৬ পয়সা। যদি চটের বস্তা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করা হয়, তবে আমদানিতে প্রতি কেজি চালের দাম দুই টাকা কমবে। পরে বাণিজ্যমন্ত্রী তাৎক্ষনিক চটের বস্তায় চাল আমদানির সরকারি বাধ্যবাধকতার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন।

এর একদিন পর আরেকটি বৈঠকে পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম জানান চাল আমদানীতে চটের বস্তা ব্যবহার শিথিল করা হলেও,দেশীয় চালে পাটের বস্তা বাধ্যতামূলক থাকবে।

সবশেষ ২৩ সেপ্টেম্বর পলাশবাড়ী ও সাদুল্লাপুর উপজেলায় চালানো অভিযানে অবৈধভাবে মজুদ রাখা ১১২ মেট্রিক টন চাল জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া জব্দ করা হয়েছে নগদ ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৬৯ টাকা ও তিন হাজার ১৭১টি চটের বস্তা। অভিযান শেষে গুদাম পাঁচটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। মেসার্স খন্দকার ট্রেডার্সের মালিক হারুনার রশিদের পাঁচটি গোডাউন থেকে এসব চাল, নগদ টাকা ও বস্তা জব্দ করা হয়।

চাল আমদানি বেড়েছে

সরকার চাল আমদানির শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে এনেছে। শুল্ক কমানোর পর চাল আমদানি বেড়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাইয়ে চাল আমদানির জন্য ১৪ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। এই অংক গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে ১২৫৩৭ শতাংশ বেশি। জুলাই মাসে চাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৭ কোটি ১২ লাখ ডলারের, যা গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ৫৩১৬ শতাংশ বেশি। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই মাসে মাত্র ১১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এছাড়া গম আমদানির এলসি বেড়েছে ৭৪ শতাংশ।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বেসরকারিভাবে ১৭ লাখ টন চাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল আমদানি হচ্ছে। এরইমধ্যে ভিয়েতনামের এক লাখ ৫৪ হাজার টন চাল গোডাউনে মজুদ করা হয়েছে। বাকি চাল খালাসের অপেক্ষায় আছে। কম্বোডিয়া থেকে আড়াই লাখ টন চাল আমদানিতে চুক্তি হয়েছে। আগামি তিন মাসের মধ্যে এসব চাল দেশে আসবে। এছাড়া ১৭ সেপ্টেম্বর রোববার ঢাকায় আসা মায়ানমানের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দুই লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে।

এদিকে গেলো তিন সপ্তাহে চাল আমদানীর বেশকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরইমধ্যে মায়ানমার থেকে ১ লাখ টন চাল আমদানীর সিদ্ধান্ত হয়েছে। বন্যাকে মাথায় রেখে এইরমধ্যে প্রায় ৯ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানীর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আমদানির প্রক্রিয়াধীন চালের মধ্যে সরকারের হাতে এসে পৌঁছেছে দুই লাখ মেট্রিকটন চাল। এছাড়া আরও দেড় লাখ মেট্রিকটন চাল জাহাজ থেকে খালাসের অপেক্ষায় আছে।

আগামী ১২ নভেম্বরের মধ্যে বাকি সাড়ে ৫ মেট্রিকটন চাল বাংলাদেশে পৌঁছাবে। গেলো ২০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে খাদ্য সচিব মোহাম্মাদ কায়কোবাদ হোসাইন সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।

দাম বাড়ায় তেমন সাড়া মেলেনি ওএমএসে মোটা চালে

স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ১৭ সেপ্টেম্বর রোববার থেকে খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল ও আটা বিক্রি শুরু করে সরকার। প্রতি কেজি চাল ১৫ টাকা ও আটা ১৭ টাকায় বিক্রি করা হবে। প্রাথমিকভাবে দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও তা চালু হয়। কিন্তু দাম চিকন চালের তুলনায় তেমনটা কম না হওয়া,খুব একটা সাড়া মেলেনি দেশব্যাপি ওএমএসে মোটা চাল বিক্রি।এদিকে প্রতি কেজি আটা বিক্রি হচ্ছে ১৭ টাকা দরে। গত বছর এই চাল ১৫ ও আটা ১৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।

ওএমএসে চালের দাম দ্বিগুণ করার কারণ সম্পর্কে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর আমরা যখন ওএমএস চালু করি, তখন বাজারে প্রতি কেজি চালের দাম ছিল ৩০ টাকা। তাই মূলত নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আমরা ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করেছি। এখন বাজারে প্রতি কেজি চাল ৪৫ টাকা, তাই দাম বাড়ানো হয়েছে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারে সরবরাহে একটি ধাক্কা লেগেছে। চাল ব্যবসায়ীরা হয়তো মনে করছেন, কিছুদিন পরে যে মৌসুমটি আসবে, সেখানেও উৎপাদন কম হবে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারও চড়া। সরকারের উচিত এখন চালের সরবরাহ বাড়ানো।গত বোরো মৌসুমে ফলন প্রায় ২০ লাখ টন কম হয়েছে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে দুই দফায় আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে ২৮ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা ও বাকিতে আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও দাম বাড়ছে।

আজকের বাজার : এলকে/এলকে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭