পাটেই বেশি সরকারি সুবিধা পাওয়ার কথা

সোনালী আঁশ এগিয়ে যাচ্ছে : মূলত আমার বাবার হাত ধরেই এই প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি। তার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানটি আজ এ পর্যায়ে এসেছে। তারই ধারাবাহিকতায় এখন আমরা এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি। আপনারা জানেন পাকিস্তান আমলে সরকারের আয়ের সিংহভাগই আসতো পাট থেকে। পাকিস্তানের সার্বিক উন্নয়ন এমন কী ইসলামাবাদ শহরটাই পাটের টাকা দিয়ে হয়েছে। যখন পূর্ব পাকিস্তানিরা দেখল যে তাদের তৈরি পণ্যের টাকা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। আমাদের উন্নয়নের কোনও ভূমিকা কিংবা উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। সেই ক্ষোভ মূলত স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু।

একটা কথা অনেকেই জানে না, বাংলাদেশের শুরুর সময়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে তখন কোন টাকাই ছিল না। এই পাট বিক্রির মাধ্যমে আয় করা বৈদেশিক ডলার দিয়েই সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ শুরু হয়। বাবা সবসময় বলতেন, ‘এখন আমরা গার্মেন্টস সহ অন্যান্য সেক্টরকে গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্ত এটা ভুলে গেলে চলবে না, ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৯০ ভাগ ফরেন কারেন্সি আসতো পাট থেকে’। এখন আপনারা বলছেন পাট আর আগের মতো প্লাস্টিকের সঙ্গে পারছে না, পিছিয়ে যাচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর পলিসি সাপোর্টও তেমন দিচ্ছে না। ফলে এখন পাট হারিয়ে যেতে বসেছে। এভাবে চলতে থাকলে সোনালী আঁশ খ্যাত এই পাট হারিয়ে যাবে একদিন।

বর্তমান সরকার প্রধানের ব্যক্তিগত উদ্যোগের কারণে এবং কিছু নীতি সহায়তায়, পাটের স্বল্প পরিসরে উন্নয়ন ঘটছে। পাশপাশি বৃহৎ আকারে উন্নয়নের জন্যও কাজ চলছে। বিকেএমই, বিজেএমই সবাই পাট সেক্টরকে অলাভজনক খাত বলে কোন রকম সহযোগিতা করত না । এখন তাদের ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। তা ছাড়া পাটের সঙ্গে সারা বাংলার প্রত্যন্ত কৃষক সমাজের জীবন-জীবিকা জড়িত। এক ডলার খরচ হলে সেটা তাদের মধ্যেই যাচ্ছে, যা কি না বিরাট একটা অর্থনৈতিক অবদান রাখে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা মিলিয়ন ডলার খরচ করি কিন্ত এই খরচ হয় শহরকেন্দ্রিক। কিন্ত পাটের টাকাটা গ্রামের হাটে, গঞ্জে, বাজারে সব জায়গায় চলে যায়। বাংলাদেশের এক চতুর্থাংশ জনসাধারণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাটের সঙ্গে জড়িত। আমরা এখন দেখছি পাটের কাছে ট্র্যাডিশনাল অনেক পণ্য মার খাচ্ছে । কিন্ত শুরুতে দামে সস্তা থাকার কারণে পাট মূলত পণ্য বাহনের উপাদান ব্যাগ হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। বৃটিশ সময়কাল, পাকিস্তানের সময়, এখন বাংলাদেশেও চালের বস্তা, ধানের বস্তা, গমের বস্তা হিসেবে পাট প্রচলিত। যখন প্লাস্টিক আসলো তখন এর ওজন, মূল্যসহ বিভিন্ন কারণে প্লাস্টিকের সঙ্গে টিকতে না পেরে পাটের অবস্থার অবনমন ঘটতে থাকলো। কিন্ত বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন ব্যাবহারের ফলে প্লাস্টিক মানুষের জন্য স্বাস্থ্যহানিকর । আর এ জন্য সবাই এখন তাকে বর্জন করছে। তার পরিবর্তে এখন সবাই পাটকেই বেছে নিয়েছে। কারণ দেখা গিয়েছে পাট পরিবেশ সম্মত। আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করে আসছি। এর ফলে পাটের ব্যবহার এখন কিছুটা বেড়েছে। পাশাপাশি সরকারের কিছু নীতিমালার পরিবর্তনের জন্য আরো দাবি দাওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। সদাশয় সরকারও পাটের উন্নয়নে আমাদের সঙ্গে আছেন এবং সব সমস্যার অবসান হবে আশা করি।

সরকার এখন ডাইভারসিফাইড জুট গুডস করার জন্য জোর দিচ্ছে। যাতে ট্র্যাডিশনাল এই পণ্যটির ডিমান্ড আরো বাড়ানো যায়। তা ছাড়া আরো সমস্যা ছিল, আমরা প্রায় ৯০ভাগ রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল ছিলাম, আর মাত্র ১০ ভাগ অভ্যন্তরীণ বাজারে আমাদের পণ্যের সরবরাহ ছিল। এসব কারণে আন্তর্জাতিক বাজারের যে কোন অঞ্চলে কোন সমস্যা বাধলেই এর প্রভাব এসে পড়তো পাটের ওপর। ভারত যদিও সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পাট উৎপাদন করে। তারা মাত্র ১০ ভাগ রপ্তানি করে এবং ৯০ ভাগ নিজেদের ব্যবহারের জন্য পণ্য তৈরি করে। সুতরাং সেখানে তাদের সমস্যা হচ্ছে না। ওই দেশের সরকারও কৃষক, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে। ফলে দেশের বাইরে কোন সমস্যা হলেও মাত্র ১০ ভাগ রপ্তানিতে তাদের কারখানাগুলোয় তেমন কোন প্রভাব পড়ে না। সেখানে আমাদের ৯০ ভাগের মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে এর প্রভাব গিয়ে পড়ে সব মিলগুলোর ওপর। এখানে বাংলাদেশে যদি ৫০ ভাগ রপ্তানি আর ৫০ ভাগ অভ্যন্তরীণ কাজে পাটের ব্যবহার হয়, তাহলে সমস্যা হলেও এই জুটমিলগুলোর ভবিষ্যত থাকে। তা ছাড়া সরকার যদি পাট থেকে আরো ডাইভারসিফিকেশন চায়, ভ্যালু এডিশন চায়, তাহলে মিলগুলোর স্থায়ীত্বের জন্য তা ভালো হবে। এর জন্য বিভিন্ন প্রোডাক্ট তৈরি করে বাজারে আনতে হবে এবং তা সবার কাছে পরিচিত করে তুলতে হবে। এই সবুজ পণ্যের বিভিন্ন ব্যবহার পদ্ধতি সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হবে। তা হলে ক্রেতারা আগ্রহ প্রকাশ করবে। এবং পাটের পণ্যের চাহিদার পাশাপাশি পাট সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে যাবার সুযোগ থাকবে, পাটের স্থায়ীত্ব আসবে। এজন্য আমরা তো আছিই, কিন্ত সরকারকেও সেভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

লো-কস্ট ফাইন্যান্স যদি সরকার আমাদের না দেয়, আমাদের রপ্তানির জন্য যদি সরকার সহযোগিতা না করে, নতুন ও ডাইভারসিফাইড পণ্য উৎপাদনে সরকার যদি উৎসাহিত না করে, তখন আমাদের রিস্ক ফ্যাক্টরটা অনেক বেশি হাই হয়ে যায়। কারণ একটা নতুন পণ্যের ওপর নির্ভর করে আমাদের ফ্যাক্টরি নির্মাণ করতে হবে, সেখানে টাকার প্রয়োজন। তার পর সে পণ্যকে আরো চার-পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের মার্কেটিং করতে হবে। এভাবে আরো কিছু প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে ইন্টারেস্ট বৃদ্ধিসহ মার্কেটে পরিচিতি পাবে। ফলে মালিকের জন্য তা ভায়াবল হবে। দেখুন পাটের চেয়েও অনেক সহজ সেক্টর রয়েছে, যেগুলোতে সহজেই সবাই বিনিয়োগ করে।

এ ক্ষেত্রে সরকার শুরুর দিকে, উদাহরণ হিসেবে ডাইভারসিফিকেশনের জন্য কিছু ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করে দিতে পারে। সেগুলো যদি লাভজনক হয় তা হলে অন্য বিনিয়োগকারীরা উৎসাহের সঙ্গে এই সেক্টরে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। এছাড়া সরকারের অনেক নীতির কারণে এই সেক্টর সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে। দেখুন, আমরা শতভাগ দেশীয় পাট দিয়ে পণ্য উৎপাদন করি। সেখানে সরকারি ব্যাংকে আমাদের লোনের ক্ষেত্রে ইন্টারেস্ট রেট হলো ১৩ পারসেন্ট। অন্যদিকে যারা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, যারা বাইরে থেকে তুলা আমদানি করে স্পিনিং করে, সুতা তৈরি করছেন, তাদের ইন্টারেস্ট রেট হলো, দুই বা তিন ভাগ। এবং তারা উৎপাদন করে এক বছর পরে পেমেন্ট করছে কারণ তারা এলসিতে পণ্য আনছে। আর আমি যদি সিজনে লোকালি পাট কিনি, সেখানে আমাকে সাত থেকে আট মাস আগে পাট কিনে মজুদ করতে হয়। সেখানে আমার ইন্টারেস্ট রেট হলো ১৩ ভাগ। সেটা দিয়ে আমি পণ্য উৎপাদন করব, তিন চার মাস পর সেটা বিক্রি করে টাকা পাব। তাহলে কী দাঁড়ালো, আমার প্রায় দুই বছরের ইন্টারেস্ট পড়ে থাকছে। সে জায়গায় কটন উৎপাদনকারীরা দুই বছরের ডিফার পেমেন্ট-এর মতো পেয়ে যায়। আর সেখানে আমাদের দুই বছরের ইন্টারেস্ট রেট হবে ২৬ পারসেন্ট, ফলে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। আমাদের দায়, লস সবই কিন্তু এই ইন্টারেস্ট রেটের কারণেই হচ্ছে। একই ইন্টারেস্ট রেট যদি বাংলাদেশের কটন মিলগুলোর জন্য প্রযোজ্য হতো, তাহলে একটা কটন মিলও সারভাইব করতে পারতো কি না সন্দেহ আছে।

তাহলে পাটের উন্নয়নে আমরা কী করতে পারি : এটা সহজ হিসাব, আমি তো আমার দেশের কাঁচামাল ব্যবহার করি, তাহলে যিনি বাইরে থেকে মাল আমদানি করে, পণ্য উৎপাদন করছেন, তার থেকে তো বেশি সুবিধা পাচ্ছি না। হিসাব অনুযায়ী তার সমান বা তার তুলনায় বেশি সরকারি সুবিধা পাওয়ার কথা আমাদের। কারণ দেশীয় পণ্যের উৎপাদনে আমার অংশগ্রহণ তার চেয়ে অনেক বেশি। আমরা পাট রপ্তানি করে শতভাগ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনছি। কিন্ত গার্মেন্টসের কটন, র-ম্যাটেরিয়াল, এক্সেসরিজসহ প্রায় সব কিছুই আসে বাইরে থেকে। সেক্ষেত্রে আমি তার চাইতে বেশি সুবিধা পাওয়ার জন্য যোগ্য কি না বলেন? এ জায়গাটাতে সরকার আমাদের তো আটকে দিয়েছে, কারণ আমাদের পাট আমদানি করা নিষেধ। যদি তাই হতো তাহলে আমরাও তো একই সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারতাম। তাহলে এটা কী ধরনের পলিসি হলো? এটাতো বৈষম্যমূলক নীতি হয়ে গেল, তাই না। আমাদের সরকার যখন একটা নীতিমালা বানায় তখন একটা সেক্টর দেখে, তাদের পক্ষে বায়াস্ট হয়েই তৈরি করে। অন্য কোন দিকে এর ফলে কি হবে তারা ফিরেও তাকানোর প্রয়োজন মনে করে না। ফলে যে অন্য সেক্টর এফেক্টেড হচ্ছে, কিংবা আমরা যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি তারা সেটা বুঝে না। এসব পলিসির সংশোধন করা দরকার। এজন্য পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় বার বার অর্থ মন্ত্রণালয়কে তাগাদা দিলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

তারা বলছেন, লোকাল কারেন্সির জন্য তাদের পলিসি একরকম, ফরেন কারেন্সির জন্য আরেক রকম। আমরা সেটা মানি। কিন্ত পাটের ক্ষেত্রে একই কথা চলবে না, কারণ এটা একটা কৃষিজ পণ্য। এর ওপর আপনি সবচেয়ে বেশি ইন্টারেস্ট দিয়ে রাখবেন? তারা তো বোঝেন না যে, এই সেক্টরে এতো বেশি প্রফিট হবে না যে অত বেশি ইন্টারেস্ট দিয়ে টিকে থাকা যাবে। আমরা তো ডমেস্টিক ব্যবসা করছি না, আমরা রপ্তানি ভিত্তিক ব্যবসা করছি। আমি যদি আমার দেশের পণ্য দিয়ে ব্যবসা করি, পণ্য উৎপাদন করি তাহলে তো আমার ইন্টারেস্ট রেট দুই থেকে আড়াই থাকার কথা। এখন যদি আমি ১৩ পার্সেন্ট করে দিই, তাহলে তো এটা তিন চার বছর পর শতভাগ হয়ে যাবে। তাহলে যত লস, দায় দেনাসহ স্বাধীনতার পর থেকে, এখন পর্যন্ত যদি আমরা সর্বোচ্চ ইন্টারেস্ট দিয়ে থাকি, সেখানে আমাদের কম হারে ইন্টারেস্ট রেট করা হয়, তাহলে সেগুলো আমরা পুষিয়ে নিতে পারবো।

সরকার সবধরনের সুযোগ সুবিধা অন্যদের দিচ্ছে। রপ্তানি উৎসাহিত করার জন্য সরকার তা দিচ্ছে। কিন্ত যারা সবচেয়ে বেশি কন্ট্রিবিউট করে তাদের আরো বেশি বেনিফিট দেয়া দরকার। হয়তোবা টোটাল এক্সপোর্ট তাদের বেশি কিন্ত কন্ট্রিবিউশন বা ভ্যালু অ্যাড তো একশভাগ না। আমি কাউকে ছোট করার জন্য এসব বলছি না। ডাইভারসিফাইড বা বহুমুখী নতুন পাট পণ্যের সম্ভাবনা আছে। কিন্ত সে ক্ষেত্রে একক ভাবে একটা কোম্পানির পক্ষে রিস্ক নেয়া খুবই ডিফিকাল্ট। তাদের ইনিশিয়াল সাপোর্ট দেয়ার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে । একবার যখন দেখা যাবে পাট-ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেছে, তখন হাজার হাজার উদ্যোক্তা এগিয়ে আসবে।

পাট পণ্যের বর্তমান চাহিদা : আমরা আসলে এ খাতকে সম্ভাবনাময় খাত বলছি, কিন্ত এর ভেতরে ঢুকে, একটু গভীরভাবে এ খাতকে নিয়ে তেমন কোনও এনালাইসিস করি না। পাট পণ্যকে প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে তুলনা করলে কিন্ত হবে না। এর সব প্রডাক্ট কিন্ত মানের দিক দিয়ে প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে সমান সমান বা বেশি হবে না। তাহলে পাটের ক্ষেত্রে ওইসব কম্প্রোমাইজ কিভাবে করবেন? এটাই হলো বড় চ্যালেঞ্জ। জুটকে ডাইভারসিফাইড করতে হলে এর মান ওইরকম করতে হবে। কনজুমারের চাহিদা অনুসারে তৈরি করতে হবে। মার্কেট প্রাইসটা হাতের নাগালে রাখতে হবে। কনজুমাররা চাচ্ছে জুট প্রডাক্ট, কিন্ত তারা তো অন্য পণ্য সেক্রিফাইস করে শুধু জুট প্রোডাক্ট

নেবে না। আমাদের রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে জুট পণ্য উৎপাদনে ওই লেভেলে নিয়ে যেতে হবে। এখন জুট নিয়ে রিসার্চ দরকার, ডেভেলপমেন্ট দরকার, একে সাসটেইনেবল করার জন্য সময়োপযোগী পরিকল্পনা করে কাজের প্রয়োজন আছে। আমরা যেন তেন একটা প্রোডাক্ট বানিয়ে দিয়েই বললাম যে এর ব্যবহার করতে হবে, এভাবে হবে না। ওই পণ্যকে তো ক্রেতাদের এক্সেপ্ট করতে হবে। তাছাড়া এর মূল্য যদি অত্যধিক হয়, তাহলেও হবে না। জুটের অনেক সম্ভাবনা আছে, এটা আমরা লেখাপড়া করে জানি, বা ল্যাব পর্যায়ে পরীক্ষা করে জানা গেছে। কিংবা মাইক্রো লেভেলে যাচাই করে দেখা গেছে। এখন কেউ যদি উদ্যোগের শুরুটা প্রথমেই করে তার জন্য বিরাট ধরনের রিক্স থেকে যাবে। তাকে বিভিন্ন ধরনের এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তারপরই তো কনজ্যুমাররা ব্যবহার করে বলবে যে, তারা এটা ব্যবহার করছে। তো এই ব্যাপারগুলো প্রথম পর্যায়ে ফেইস করতে হবে।

নতুন উদ্যোক্তা,ব্যবসার উন্নয়ন, দিকনির্দেশনা কিংবা পরামর্শ : আমাদের অনেক নতুন নতুন আসেন, এসে তারা করে কী, লোকাল মার্কেট থেকে প্রথমে ফেব্রিক কিনে স্যাম্পলটা বানায়। ওরা যখন লোকাল মার্কেট থেকে পাট পণ্য কেনে তখন খুব কম দামে পেয়ে যায়। এর কারণ আমাদের মিলের অনেক কাটপিস থাকে, গুদামে অনেক পুরনো লট পরে থাকে, এসব আমরা কমদামে বিক্রি করে দিই। তো সেই মালগুলো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নিয়ে লোকাল মার্কেটে কম দামে বিক্রি করে দেয়। ফলে উদ্যোক্তারা সহজেই স্যাম্পল তৈরি করতে পারে। কিন্ত যখন বড় কোন অর্ডার আসে তখন তাকে বিপদে পড়তে হয়। কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণ ফেব্রিক সে লোকাল মার্কেট থেকে কিনতে পারে না। আর তখনই উদ্যোক্তাকে যেতে হবে মিলের কাছে, মিল তো তার সঠিক মূল্য চেয়ে বসে। তখন উদ্যোক্তার কাছে মনে হয় এর মূল্য বেশি।

আরেকটা ব্যাপার দেখা যায়, সরকার অনেক সময় বিজেএমসির থেকে মাল সরবরাহ করে। বিজেএমসির মালামাল সবসময় কম থাকে কারণ বিজেএমসি তার কস্টিংয়ের সঙ্গে মিলিয়ে মাল বিক্রি করে না। তারা সরকারের কাছ থেকে প্রতিবছর সাবসিডি পায়। ফলে তারা উৎপাদন খরচের কমেই মালামাল বিক্রি করে। আমাদের তুলনায় অনেক কমে তারা বিক্রি করছে। আমরা জানি, বিদেশে মাল ডেলিভারি দিতে হলে সময়মতো পণ্য ক্যারি করতে হবে, সঠিক মাল দিতে হবে, এর মান সঠিক হতে হবে। বিজেএমসিতে সবসময় আপনি সময়মতো সেই মালামাল পাবেন না। ফলে উদ্যোক্তাকে আমাদের কাছে আসতে হয়। কিন্ত আমরা তো আমাদের নির্দিষ্ট মূল্যের কমে বিক্রি করতে পারি না। তখন তাদের কাছে মনে হয় এর মূল্য বেশি। আসলে পাটের সার্বিক ডিমান্ড কমে যাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা গোটা কয়েক কোনমতে টিকে আছি বলতে পারেন। যদি এর চাহিদা বাড়ে , নতুন করে উদ্যোগ নেয়া হয়, তাহলে আবার অচল কারখানা সচল করা সম্ভব।

পুরোনো সব মেশিনপত্র পরিবর্তন করে নতুন মেশিন স্থাপন করতে হবে। এখনও সেই ১৯৬০ সালের মেশিন দিয়েই কাজ করছি আমরা। ভারত সরকার ২০ ভাগ সাবসিডি সহযোগিতা করে তাদের পুরোনো মেশিন পরিবর্তন করে নতুনভাবে সব সাজিয়েছে। আমাদের সরকারকেও সেভাবে উদ্যোগি হতে হবে। এতে করে আমাদের উৎপাদন হারও দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তাহলেই আমাদের স্থায়ীত্ব , স্বল্প মূল্য নির্ধারণ, সবই সহজ হবে।

পাট পণ্যে উৎসাহী তরুণ প্রজন্মের প্রতি পরামর্শ : আমার জানা মতে, সারা দেশের আনাচে কানাচে তরুণ প্রজন্ম পাট নিয়ে কাজ করার জন্য উৎসাহিত হচ্ছে। দেখা যায়, উৎসাহ থাকলেও তাদের বেশিরভাগেরই ফাইন্যান্স থাকে না। এর জন্য তাদের প্রপার সাপোর্ট দিতে হবে, গাইড করতে হবে। তাহলেই তারা এগিয়ে আসতে পারবে। এখন প্রশ্ন হলো, এই ফাইন্যান্সটা কী করে আসবে। আমাদের দেশে গার্মেন্টস শিল্পেও প্রথম প্রথম ফাইন্যান্স ছিল না। শুরুর দিকে তাদেরও অনেক সাফার করতে হয়েছে। কিন্ত কি দেখা গেল, তাদের যখন ব্যাক টু ব্যাক ফাইন্যান্সিয়াল সাপোর্ট দেয়া হলো, তারা এগিয়ে গেল দ্রুত। আজ এই সেক্টর কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? কিন্ত জুটের জন্য যদি এলসি করি, তাহলে ব্যাংক কিন্ত সেখানে কোনরকম সহযোগিতা করবেনা। কারণ, জুটের ক্ষেত্রে গার্মেন্টসের মতো কোন সাপোর্ট নেই। সরকারের কোনও আইন নেই।

একজন নতুন উদ্যোক্তা যদি কোনোভাবে দেশি বা বিদেশি মেলা থেকে, কোটি টাকার অর্ডার পায় তাহলে সে কিভাবে কী করবে? তাকে বায়ারের অর্ডার অনুযায়ী পণ্য তৈরি করে দিতে হবে। কিন্ত সে পরিমাণ টাকা তার নেই। সে তখন কী করবে? সে যদি এলসি সুবিধা পেত, ম্যাটেরিয়াল সাপ্লাই ব্যাক টু ব্যাক দিয়ে, তার ব্যবসা কন্টিনিউ করতে পারত, তাহলে একজন উদ্যোক্তা তার সর্বশ্রম দিয়ে নিজেকে একটা সাসটেইনেবল অবস্থানে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্ত জুটের ব্যবসায় সে সুযোগ আমাদের বা নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য নেই। কিন্ত অন্যান্য সেক্টরের মতো সরকার যদি জুটের ক্ষেত্রে সকল সুযোগ সুবিধা দিত, তাহলে এ সেক্টরটাও সমানতালে এগিয়ে যেতে পারত। তাছারা গ্রীণ ফাইন্যান্স বলে একটা সিস্টেম আছে যেখানে গার্মেন্টস অন্তর্ভূক্ত। আমরা পাটের সঙ্গে একে যুক্ত করেছি। কিন্ত ফরেন কারেন্সির জন্য পাটকে এখনও অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। ফলে সেখান থেকে আমরা অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছি না। পাট একটি গ্রীণ প্রোডাক্ট। আমাদের যে মিলগুলো আছে, যে ফ্যাসিলিটি আছে, সেগুলো আমাদের গ্রীণ করতে হবে। তাহলে পাটকে পুরোটাই একটা গ্রীণ প্রোডাক্ট হিসেবে প্রেজেন্টেশন দিতে পারব।

আমাদের পক্ষ থেকে নতুনদের জন্য সহযোগিতা: একটা বড় পরিসরের মিলের পক্ষে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের চাহিদা মতো পণ্য সরবরাহ করা কষ্টকর। কারণ তাদের চাহিদার তুলনায় আমাদের উৎপাদন পরিসর অনেক বড়। আমাদের মিলগুলোর সেটআপ তৈরি করা আছে, ৫০ থেকে ৫০০ টনের উপযোগী করে। তাই আমাদের পক্ষে ৫০- ৬০ গজ করে বিক্রি করা খুবই ডিফিকাল্ট। আবার আমরা জানি, তাদের যদি আমরা সাপোর্ট না দিই, তাহলে তারা নিজেদের ডেভেলপ করতে পারবে না। অনেক সময় আমাদের কাছে অল্প বিস্তর যা থাকে, সেখান থেকে নতুন উদ্যোক্তাদের যথাসম্ভব স্বল্প পরিসরে ডেলিভারি দিয়ে সহযোগিতা করি। আমরা যখন জেডিপিসির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রোগ্রামে যাই, উদ্যোক্তারা আমাদের প্রোডাক্ট দেখে আগ্রহ প্রকাশ করে। আমরা সে অনুযায়ী তাদের সাúøাই দেয়ার চেষ্টা করি। জেডিপিসিকেও আমরা পরামর্শ দিই যে, তারা কিভাবে সবাইকে সহযোগিতা করবে। ছোট উদ্যোক্তা হলে কি হবে, এক সময় তারাও আমাদের মতো বড় মিলগুলোকে চাহিদা অনুপাতে, পণ্য উৎপাদনের জন্য উৎসাহিত করবে। আসলে আমরা এডিশনাল জুটমিলগুলো, সবসময় বড় ভলিউমে পণ্য বিক্রয় করি। ফলে আমাদের প্রফিট মার্জিন কম থাকে। যখন আপনি ডিজাইনে যাবেন, হাই ভ্যালু প্রোডাক্ট করবেন, আপনি যখন ফ্যাশনে চলে যাবেন, তখন কিন্ত আপনার প্র্রোডাক্ট কস্টের সঙ্গে প্রাইসের তেমন মিল থাকবে না। কারণ, আপনার প্রোডাক্ট যদি আকর্ষণীয় হয়, তাহলে সবাই সেটা পছন্দ করেই কিনতে চাইবে। তখন সে কিন্ত বুঝবে না প্রাইস আসলে কী। আবার যারা ডেইলি ইন্ড্রাস্ট্রিওয়াল প্রোডাক্টের জন্য মাল কিনবে, বাজারের সবাই কিন্ত এর মূল্য কমবেশি জানবে। কিন্ত ডিজাইনের কাপড়ের জন্য সেটা ঠিক থাকে না। ডিজাইনের কাপড় কিন্ত সে মূল্যে বিক্রিও হয় না। ফলে উদ্যোক্তা হাই ভ্যালু প্রোডাক্ট তৈরি করতে পারে, তখন একটা প্রফিট এবিলিটি থাকে। তার নতুন প্রোডাক্টের জন্য সে আবার রি-ইনভেস্ট করতে পারবে

মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটওয়ারী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সোনালী আাঁশ ইন্ড্রাস্ট্রিজ