ঋণমান ঠিক রেখে ঋণপ্রবাহ ঘূর্ণীয়মান রাখলেই ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য সবল থাকবে

করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব সারাবিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে, আমাদের দেশেও চলছে। এই সময়ে আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাত কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে বা আদৌ এখানে কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কিনা, সেসব নিয়েই আজকের এই আলোচনার অবতারণা। করোনার প্রভাবে ইতিমধ্যেই একটা বিপর্যয় ব্যাংকিং খাতে নেমে এসেছে। এই বিপর্যয়টা আরো কিছুদিন চলমান থাকবে বলে মনে হয়। যেমনটা আমরা বলছি, আমাদের বিশেষজ্ঞরা বলছেন এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তও অনেকটা ওই রকমই আছে যে, করোনা আরও কিছুদিন দীর্ঘস্থায়ী হবে। কতদিন হবে কেউ সেটা জানে না। তাই করোনা দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং আমাদেরকে করোনার সাথেই বসবাস করতে হবে। এটাকে মেনে নিয়ে, এর সাথে আমাদের মানিয়ে চলার মতো বিষয় চলে এসেছে।

কিন্তু এরই মাঝে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে, ব্যাংকিংখাতও একটা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এই ক্ষতিগ্রস্ত দিকগুলো আমদের কাটিয়ে উঠতে হবে। গত দশকে আমাদের ব্যাংকিং খাতের মুনাফা প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পগুলো ভালো গতিতে চলছিল। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের ব্যাংকের আমানত ও ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে,ব্যাংকিংখাত অনেক মুনাফা করে আসছিল। মুনাফার এই অংশে ভাটা পড়বেই। এর অর্থ এই নয় যে, ব্যাংকিংখাতে এমন একটা অবস্থা হবে যে,ব্যাংক আর মুনাফা চোখে দেখবে না। লস নিতে নিতে এক পর্যায়ে অস্তিত্বের প্রশ্ন চলে আসবে, এমনটি হবে না।

আমরা যে অবস্থাটা দেখছি, এটিকে আর্থিক মন্দা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। আর্থিক মন্দার সাথে সাথে আমরা নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে অর্থাৎ আমাদের ব্যাংকের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো পরিবর্তন করে,কিভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়, সেদিকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।

এখনকার সময়ে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট এবং অফিস ম্যানেজমেন্ট বেশ একটা চ্যালেঞ্জিং ইস্যু। প্রথমদিকে বিশ্বব্যাপী নির্দেশনা ছিল, জরুরি প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে বের হওয় যাবে না। এটা কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। প্রথমদিকে এটা সরকারি সিদ্ধান্ত ছিল। এর প্রেক্ষিতে আমি ব্যাংকার হিসেবেও ঘরের বাইরে যেতে পারবো না। বাইরে গেলে, আমিও ঝুঁকিতে থাকবো। দশজনকে ঝুঁকিতে রাখবো,দশজন পুরো সমাজকে ঝুঁকিতে ফেলে দিবে। কিন্তু আমাদের ব্যাংক খাত প্রথম দিন থেকে কখনোই বন্ধ ছিল না। আমাদের এই করোনা মোকাবেলায় সম্মুখযুদ্ধে যাদেরকে আমরা যোদ্ধা বলছি,তারা প্রকৃত অর্থেই সম্মুখযোদ্ধা। কেবলমাত্র স্বাস্থ্যকর্মী নয়,এখানে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীও আছে। তখন মানবসম্পদ নিয়ে ব্যাংকিংখাত ভালো একটা সমস্যায় পড়ে য়ায়।

করোনার প্রথমদিকে রোগাক্রান্ত সম্পর্কে তেমন জ্ঞান ছিল না আমাদের। কোন্ ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করলে নিজেকে নিরাপদ রাখা যায়, সে ধারণা আমাদের ছিল না। কাজেই আমরা কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে শাখায় প্রেরণ করতে পারছিলাম না। অপরদিকে ব্যাংকিংখাত চালু রাখার সরকারি নির্দেশনা ছিল। এই টানাপোড়েনে আমাদেরকে রোস্টারিং ডিউটি করতে হয়েছে। আজকে তিনজন ডিউটি করলে,পরের সপ্তাহে অন্য তিনজন ডিউটি করবে। দেহে সংক্রমিত হওয়ার পরেও,একটা সময় থাকে যেটাকে আমরা বলি ইমিউনিটি। দেহ ইমিউন হয়ে থাকে, শরীরে তার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া ইত্যাদি হিসেব করে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে সমস্ত নির্দেশনা দিয়েছে, সেগুলো মেনে আমরা মানব সম্পদকে বিভক্ত করেছি। কার্যক্রমকে ভাগ করে দিয়েছি। তারপর যেটা আমরা করেছি, ক্ষুদ্রাকার হলেও আমাদের সম্মানিত চেয়ারম্যান মহোদয়, এ বিষয়ে একটা প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। মৃত্যু হলে একটা ভালো পরিমান টাকা দেয়া হবে, চিকিৎসার ব্যয় পুরোটা বহন করা হবে। এছাড়াও আমাদের নিয়মিত আরও অন্যান্য আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

আপনারা জানেন, ন্যাশনাল ব্যাংক প্রথম প্রজন্মের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক। পর্যাপ্ত শাখা ন্যাশনাল ব্যাংকের রয়েছে। আমরা অনেক রকমের সেবা চালু করেছি এবং যতটুকু সম্ভব বিস্মৃত রাখার চেষ্টা করেছি। আমাদের ব্যাংকের সব শাখা প্রথম দিন থেকে খোলা আছে এবং আমাদের কর্মীরা সতস্ফুর্তভাবে গ্রাহকদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

করোনার শুরুর দিকে আমাদের বিজনেস অপারেশনে একটু আধটু সমস্যা ছিল। পরবর্তীতে এটা ঠিক করা গেছে। যেহেতু আমরা একটা ডিজিটাল যুগে আছি। আমাদের ব্যাংকেও অনেকটা স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল পদ্ধতি রয়েছে। বাসায় বসে আমরা কাজ করছি, কাজে কখনো বাধাগ্রস্ত হয়নি। বাইরের সাথে যোগাযোগ যেটা না করলেই নয়,সেগুলো আমরা করতে পেরেছি। কোনো গ্রাহক সেবা না পেয়ে ফেরত গেছে,অর্থাৎ অপারেশনাল হ্যাজার্ডের কারণে কোনো গ্রাহক সেবা বঞ্চিত হয়েছেন, এমনটি আমাদের ব্যাংকে হয়নি। আমি যতটুকু জানি সমগ্র ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এমন হয়নি যে, কোনো গ্রাহক কোনো শাখা থেকে সেবা না পেয়ে চলে গেছে। যদি হয়েও থাকে, তাও বিরল। এইখাতে সরকারি নির্দেশনা, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা,আমাদের প্রচেষ্টা সব মিলিয়ে সেবা চালু রাখা সম্ভব হয়েছে।

এবারের বাজেট নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। আমরা সরকারকে রাজস্ব প্রদান করি নিট মুনাফা থেকে। আমাদের লাভ ক্ষতির হিসাবটা করের উপর অনেকটা নির্ভর করে। বাজেটে ব্যাংকিং খাতকে বিশেষ করে ব্যবসায়ী খাতকে চাঙ্গা রাখার জন্য, বাজেটের প্রাক্কালেই সরকার ব্যাংক গুলোকে প্রণোদনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। এরপরেও আরো অনেক প্রণোদনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, যেটা প্রায় পাঁচ বছর আগের জাতীয় বাজেটের সমান। বাজেটের আগেই প্রণোদনা দিয়ে, আর্থিক সহায়তা দিয়ে, গ্রাহকদের টিকিয়ে রাখা,তথা ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখার সরকারি প্রচেষ্টা ছিল, সেটা বাজেটে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। এবারের বাজেটে এর চেয়ে বেশি পাবার বা প্রত্যাশা ছিল বলে আমি মনে করি না।

আমাদের অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করতে হলে আমি মনে করি, আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা তথা আর্থিক খাতকে চাঙ্গা রাখতে হবে। আর্থিক খাতকে চাঙ্গা রাখার জন্য ব্যাংকগুলোকে অনেকগুলো নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের ঋণপ্রবাহের জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখতে হবে। যেখানে ঋণ দিলে আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখা যাবে, সেসব জায়গায় ঋণ দিতে হবে।

আমাদের দেশ যাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়, বহির্বিশ্বের উপর যাতে আমাদের নির্ভরশীলতা কমে যায়, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। গত চার মাসে কিন্তু অনেকগুলো কাজ হয়েছে। যেমন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এক ইঞ্চি জায়গাও ফেলে রাখা যাবে না। অর্থাৎ আমাদের এখন জোর দিতে হবে কৃষি খাতে। কৃষির সাথে আরো সম্পৃক্ত খাত রয়েছে। যেমন, হাঁস মুরগি, পশুপালন ইত্যাদি। এসব দিকে আমাদের জোর দিতে হবে। দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দেশে যথেষ্ট শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। যেগুলো আমাদের দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাইরে রপ্তানি করার সক্ষমতা রাখে। আমদের এখন অপ্রয়োজনীয় আমদানি থেকে বিরত থেকে,আমাদের দেশীয় শিল্পকে কিভাবে আরো বেশি শক্তিশালী করা যায় ও উৎপাদন আরো বেশি বৃদ্ধি করা যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

ন্যাশনাল ব্যাংক আমাদের পরিচালনা পর্ষদ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন আমাদের ঋণের অংক হবে ছোট ছোট। অর্থাৎ ছোট এবং মাঝারি উদ্যোক্তা,যাদের আসলেই অর্থের প্রয়োজন, মূলধনের প্রয়োজন রয়েছে,আমরা সে দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের ত্রৈমাসিক প্রকল্পে সুনির্দিষ্টভাবে আমরা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করব। আমি মনে করি, শুধু আমরা নই, প্রতিটি ব্যাংক তাই করবে।

আমাদের দেশের যে ক্ষুদ্র সম্ভাবনাময় শিল্প আছে, সেগুলোকে সচল করতে হবে, এগুলোর কর্মতৎপরতা ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেলে,আমাদের করোনাকালীন যে বিপদ, সংকটাপন্ন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটা থাকবে না। আমাদের অর্থনীতি, দেশীয় উৎপাদনের উপর নির্ভর হওয়া উচিত।

ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যেহেতু দেশের অধিকাংশ ব্যাংক বেসরকারি মালিকানাধীন এবং পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। আমাদের ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে ব্যয় সংকোচন করার একটি প্রবনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যাংক হচ্ছে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চাকচিক্যের একটা অবয়ব থাকে। সেই জায়গাটাতে এখন আপোস করছি। আমাদের গাড়িসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক যেসব খরচ চাইলেই একটু কমানো যায়, সেগুলো এরই মাঝে আমরা ব্যয় সংকোচন করেছি।

এগুলো করে আপনি যদি মুনাফাকে একটা কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে রাখতে পারেন,তাহলেই ব্যাংকের সার্বিক উন্নতি। আরও একটা বিষয় হচ্ছে, ব্যাংক খাতের ঋণের মান ঠিক রাখা। এটা যদি ঠিক থাকে, তাহলে ব্যাংকের সামগ্রিক উন্নয়ন হতে বাধ্য। আমি যেই টাকাটা ঋণ দিব, সেটা ফিরিয়ে এনে আরেকজনকে ঋণ দেয়া যাবে। এই ঘূর্ণিয়মান ঋণ প্রক্রিয়া যখন চলতে থাকবে, তখনই ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকারদের এখন সচেতন হওয়া উচিত, যাতে আমাদের ব্যাংক ঋণ,কুঋণে বা ব্যাড লোনে পরিণত না হয়।

এই ডিসেম্বর পর্যন্ত যে সমস্ত ঋণের নবায়ন করার কথা, এগুলো কোনো প্রকার প্রশ্ন ব্যতিরেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়ন করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছে। ঋণের শ্রেণীকরণের একটি মানদণ্ড থাকে, ঋণ যেন কুঋণে পরিণত না হয়। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ বছর নতুন করে ঋণ শ্রেণীকরণ করা লাগবে না। এই যে একটা সুবিধা দেয়া হয়েছে, এটা সকলকে গ্রহণ করা উচিত। ঋণের পরিস্থিতি যাই হোক, ঋণ শ্রেণীকরণ হবে না। ব্যাংকারদের সচেষ্ট থাকতে হবে, যাতে গ্রাহকদের এই বড় সুযোগটা অকার্যকর হয়ে যাতে ঋণ শ্রেণীকরণ না হয়। এজন্য সকলকে যথাযথ কাজ করে যেতে হবে। এই কাজগুলো করলে সার্বিকভাবে ব্যাংকের উন্নতি হবে।

করোনা এখন বৈশ্বিক মহামারী। এই মহামারীর গতিপ্রকৃতি কীভাবে ছড়ায়, ছড়ানোর পরে কি হয়,মানুষের মৃত্যুর পর এটি ছড়ায় কিনা, এই বিষয়গুলো আমাদের অজানা থাকার কারণে, প্রথম থেকেই আমাদের মাঝে ভীতি কাজ করেছে। রোগীর সাথে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, তাদের মানবিক বিপর্যয় হচ্ছে। আমাদেরকে বলা হয়েছে, করোনা রোগী থেকে দূরে থাকবেন। আমার ভাইয়ের করোনা পজেটিভ হয়েছে,সে বাড়িতে আছে, আমাকে তো বলা হয়নি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। আপনার বাড়িতে আপনি নিজেকে পৃথক রাখুন। ভাইরাসটি ছড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিভাবে এটি ছড়ায়, এটা এখন আমরা জানি। আপনি করোনা রোগীকে ধরবেন,ভাইরাসটি আপনাকে সংক্রমিত করতে পারে।

সেটা আপনার মুখ,নাক,চোখে যদি হাত না লাগে, সে ব্যাপারে সতর্ক থেকে,আপনি একই বাড়িতে দূরত্ব রেখে, কোনো রোগীর সাথে থাকেন, কোনো সমস্যা নেই। রোগী যে পাত্রে খাবেন,সে পাত্রটি আলাদা রাখবেন। তারপর আমরা রোগীকে হাসপাতলে নিচ্ছি, হাসপাতালে গেলে করোনা রোগীকে কেউ ধরতে চাচ্ছে না। প্রথম দিকে আমাদের প্রস্তুতি ছিল না। এটা একটা বিরাট মানবিক বিপর্যয় হয়েছে। আমাদের চিকিৎসা কর্মী যারা আছেন, ডাক্তার থেকে শুরু করে নার্স,তাদের সুরক্ষা সামগ্রী প্রথমদিকে ছিল না, এখন তৈরি হয়েছে। আবার ডাক্তার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। আমাদের যদি জানা থাকে কি করলে করোনা হবে না, তাহলে ভীতি চলে যাবে। এখন আমাদের জানা হয়ে গেছে। আমি নিজে যেভাবে ভীত ছিলাম, এখন সেরকম ভীত নই। কারণ এখন আমি জানি, কী প্রটেকশন নিলে আমি রাস্তা দিয়ে চলতে পারবো।

করোনা রোগির মৃত্যুর পর যে করুণ পরিস্থিতি হচ্ছে,কেউই যাচ্ছেন না মরদেহের কাছে। কয়েকটি সংস্থা মিলে জানাজা পড়ে মরদেহের দাফন সম্পন্ন করছে বা চিতায় নিয়ে মরদেহের সৎকার করা হচ্ছে। একজন মানুষ মারা গেলে দুই চার ঘন্টা পর, মৃতের কাছ থেকে আর করোনা রোগ ছড়াবে না, এটা তো বলাই হচ্ছে। আর যদিও বা হাতে লাগলো,আমার হাত যদি মুখে না যায়, হাত ধুয়ে ফেললেই তো হলো, এখানে তো আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা কেন অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি করছি? এটা একেবারেই উচিত হচ্ছে না। আমাকে জানতে হবে, কি করলে রোগ আমার শরীরে ঢুকবে না। আর করোনা হওয়ার সাথে সাথেই মৃত্যু হবে, এই ভীতিকর পরিস্থিতি থেকেও আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। আমরা প্রতিদিনই দেখছি, কতোজন মারা যাচ্ছেন,কতোজন আক্রান্ত হচ্ছেন। আর আমাকে তো এমনিতেও মরতে হবে একসময়। তাহলে এতো ভীত হতে হবে কেন?

আজ করোনার কারণে ব্যবসা বন্ধ,কাজ বন্ধ। বাড়িতে যারা আমাদের সহায়তা করতেন, তাদের কাজ বন্ধ। রিক্সাওয়ালা ভাইদের রিক্সায় যাত্রী উঠে না, তারা বেকার হয়ে যাচ্ছে। একটা কর্মহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমদের মধ্যে যাদের সহায় সম্বল আছে, আমদের এগিয়ে আসা উচিৎ। একটা কথা প্রসঙ্গক্রমে আমি বলি, আমার এখন চাকরি ছেড়ে অবসরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি গ্রামমুখী হয়ে যাচ্ছি। আমি বলব কিভাবে বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা যাবে। আমি গ্রামমুখী হয়ে গিয়ে মাছ চাষ করব। আমি একটা পুকুরের মাছ প্রথমে বিক্রি করে হয়তো এক দুই লাখ টাকা পাব। আমি একটা পুকুরের মাছ স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছি। আর্থিক সহায়তা যেগুলো করা দরকার, সেগুলো আমি করছি অনেকেই করছেন। এভাবে আমাদের দেশে যে পরিমাণ বিত্তবান মানুষ আছে, তারা যদি মানবিক বিপর্যয়ের এই দিকটা ভাবেন, তারা যদি একটু এগিয়ে আসেন! আমার বাসা থেকে প্রতিদিন দুপুরে ৫ জনের খাবার প্যাকেট করে,বাসার নিচে অনাহারী মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, তাদেরকে দেয়া হয়। আপনারা হয়তো অনেকে জানেন না, আমি ছবি তুলি । পুলিশকে দেখেছি, তাদের উদ্যোগে প্রচুর মানুষকে বিভিন্ন জায়গায় খাওয়া বিলি করেছে। মানবিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার এটাও একটা দিক যে,আমাদের যাদের বিত্ত আছে, বিত্তহীনদেরকে আমাদের বিত্ত আমরা শেয়ার করি। তাহলে মানবিক বিপর্যয়ের আর্থিক দিকটা সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

গ্রাম থেকে আমরা শহরে আসি কারণ, শহরে অনেক টাকা আয় করা যাবে এই ভেবে। এই ধারণা থেকে এখন আমাদের ফিরে আসার সময় এসেছে। যে যুবকরা বেকার হয়ে গেছে, তারা গ্রামে যাক। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনি সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। এগুলোকে কাঠামোগত রূপ দেওয়ার দরকার। যুবক শ্রেণী যারা কাজ পাচ্ছে না, তাদের নিজেদের জমি, তারা সেগুলোতে চাষ করুক। কৃষিতে বিপ্লব ঘটার এখনও সময় আছে। আমাদের কৃষি বিভাগ এ বিষয়ে ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে। আমাদের মাঝে সেই জ্ঞান বিতরণ করেছে। আমরা যদি এগুলোকে বাস্তবায়ন করি,তাহলে যে বিশাল যুবসমাজ বেকার হয়ে আছে, তাদের একটা কাজের জায়গা তৈরি হবে।

জাপান যে উন্নতি করেছে,তার মুল হচ্ছে, একটা বড় শিল্পের সাথে অনেকগুলো ছোট ছোট শিল্প জড়িত। টয়োটা গাড়ির কথাই ধরা যাক,গাড়ি শুধু কেবল টায়োটা ফ্যাক্টরিতে তৈরি হচ্ছে না। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হচ্ছে। এই সকল মডেল অনুসরণ করলে আমি মনে করি, দ্রুত অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

এএসএম বুলবুল
এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর
ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড