এগ্রো প্রসেসিং শিল্পে চাই আমদানি মূল্যে তেল: ইলিয়াস মৃধা

সামনে বাজেট আসছে, বাজেটকে ঘিরে কৃষি,  শিল্প, বাণিজ্য সব মহলেরই কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকে সরকারের কাছে। বিশেষ করে কৃষি যেহেতু দেশের কর্মসংস্থানের একক বৃহত্তম খাত তাই কৃষি কিছুটা বাড়তি সুবিধা দাবি করতেই পারে। এর মধ্যে একটি হলো কৃষিতে বিশেষায়িত ভ্যাট ব্যবস্থা চালু। বাজেটে প্রত্যাশা, নিজেদের ব্যবসার ইতিকথা, আগামি দিনগুলোর পরিকল্পনা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে আজকের বাজার ও এবি টেলিভিশনের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন দেশের এগ্রো প্রসেসিং ব্যবসার প্রথমসারির প্রতিষ্ঠান প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থ্াপনা পরিচালক  ইলিয়াস মৃধা। তার সঙ্গে আলাপচারিতার চুম্বক অংশ তারই ভাষায় পাঠকদের জন্য ছাপা হলো।

প্রাণের শুরু যেভাবে
আমি যদি এগ্রো প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি বা কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প সম্পর্কে বলি, আমাদের যিনি স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন, প্রয়াত মেজর জেনারেল আমজাদ খান চৌধুরী উনি আসলে কৃষিকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখার  চেষ্টা করতেন। আমাদের কৃষি মৌসুমে কৃষকরা বেশি ফসল উৎপাদন করলে কিন্তু দাম কমে  যায়। এতে করে কৃষকের খুব বেশি লাভ হয় না। উনি ভাবলেন তা হলে এর সমাধান কী হতে পারে? কৃষি পণ্যে ভ্যালু অ্যাড বা মূল্য সংযোজন হতে পারে ভালো সমাধান। এক পর্যায়ে তিনি থাইল্যান্ডে যান। ওখানে কিংস সেন্টার নামে একটা কেন্দ্র আছে, যা  থাই রাজা নিজে তত্ত্বাবধান করেন, এখান থেকে কৃষকদের কৃষিজাত পণ্যের প্রসেসিংয়ের ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করা হয়।  সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ভাবলেন আমাদের  দেশে আনারস কিংবা আমের মৌসুমে হাজার হাজার আম  ও আনারস উৎপন্ন হয়। তাহলে এগুলোকে আমরা কিভাবে কাজে লাগাতে পারি। পাকিস্তান শুষ্ক একটি দেশ।  আম তাদের ওখানে আমাদের  চেয়ে কম হয়। তারা যদি আমের জুস নিজের দেশে এবং বাইরের পৃথিবীর মানুষকে সারা বছর খাওয়াতে পারে তাহলে আমরা পারব না  কেন? মানুষ তো  বেভারেজ খায়। তখন আমরা ভাবি আনারস, আমের রস ক্যানিং করে রপ্তানি করতে পারি।  আমের জুস, বার  ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা শুরু করলাম, এই আমাদের অগ্রযাত্রা শুরু হলো। শুরুতে আমাদের প্রচুর স্ট্রাগল করতে হয়েছে, ব্যাংকের কাছে গেলে ব্যাংক মনে করত ইন্ড্রাস্ট্রি মানে টেক্সটাইল, জুট ইত্যাদি। এগ্রো প্রসেসিং আবার কী? পিকল বা আচার তৈরি, আমের রস ক্যানিং করে বাজার ধরা এসব তারা বুঝতে চাইত না। যদিও এটি অনেক আগে থেকেই শিল্প হিসেবে ঘোষিত ছিল। সাবিনকো নামে একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের প্রথম অর্থায়ন করে। তবে তারা আমাদের একটি শর্ত দেয়  পাবলিকলি  কোম্পানি ফোট করতে হবে। আমরা তখন এগ্রিকালচার মার্কেটিং কোম্পানি নামে একটি কোম্পানি লিস্টেড করি। পুজিঁবাজারে এটি ব্যাপক সাড়া জাগায়, আমরা প্রচুর শেয়ার পাই। এরপর থেকে আর আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমাদের পণ্যগুলোও বাজারে প্রচুর বিক্রি হতে থাকে। আমরা চিন্তা করলাম সারা বছর কিভাবে কাঁচামাল পাওয়া যায়? আমরা একটা সম্প্রসারণ বিভাগ চালু করলাম। আমাদের কর্মীরা কৃষকের কাছে যেতে লাগলো,  দেশে আমরাই প্রথম কন্ট্রাক্ট ফার্মিং শুরু করি। কৃষকদের আমরা বলি  তোমাদের  ভালো বীজ দিচ্ছি, তোমরা শুধু উৎপাদন করো। মৌসুমের সময় তোমাদের চিন্তা করতে হবে না আমরাই সব ফসল কিনে নিবো। বাংলাদেশে আমরাই বাণিজ্যিক মুগডাল চাষ শুরু করি, আগে আমাদের দেশে কিছু মসুর ও কালাই চাষ হতো। মুগডাল আমাদের স্ন্যাকস  তৈরিতে কাজে লাগে। এর কিছুটা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো তবে সবসময় পাওয়া যেত না। সারাবছর যেহেতু আমাদের বাজারে থাকতে হয়; আমাদের র’ ম্যাটারিয়াল লাগে তাই আমাদের পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প লাগবে। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ না থাকলে আমরা টিকতে পারব না। এরপর আমরা আনারস, টমেটো, আম, স্পাইস নানা ধরনের জিনিস নিয়ে কাজ শুরু করলাম। আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব ভাবলেন, পাকিস্তান যদি বাসমতি নিয়ে বিশ্ববাজারে কাজ করতে পারে আমরা কেন আমাদের গড গিফটেড অ্যারোম্যাটিক রাইস চিনিগুড়া নিয়ে কাজ করতে পারব না? এরই এক পর্যায়ে আমার বস রাজশাহীর গোদাগাড়ি এলাকায় যান। দেখেন, এই এলাকার মানুষ বছরে একটাই ধান চাষ করে সেটি চিনিগুড়া। কিন্তু উৎপাদন খুবই কম হয়। তবে এটিকে ব্র্যান্ডেড করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এরপর আমরা দেশে প্রথম চিনিগুড়া  পোলাও চাল প্যাকেট করে বিক্রি শুরু করি। বিভিন্ন হেটেলে- রেস্তরায় দিই। সাড়াও পাই ভালো। আগে এটি খোলা বিক্রি হতো। আমরা এই চাল রপ্তানি শুরু করি, মিডিয়াতে আনি। আমরা ক্যাম্পেইন করি এই চাল সুগন্ধী, একেবারে প্রাকৃতিকভাবে। কোনোরকম কৃত্রিম সুগন্ধ এতে দেওয়া হয় না। বাসমতি কিছুটা লম্বা হয় তবে এর সুগন্ধ নেই। মানুষ আমাদের চিনিগুড়া চাল পছন্দ করতে শুরু করে।  এখন কৃষক ভাতের চালের তুলনায়  সুগন্ধি চালের ভালো দাম পাচ্ছে,  তারা লাভবান হচ্ছে। রুরাল ইকোনমিও এতে শক্তিশালী হচ্ছে। আমাদের পরে এখন অনেকেই কিন্তু প্যাকেট সুগন্ধি চাল বাজারজাত করছে। এতে বাজারও বাড়ছে। আমরা স্বাগত জানাই। এতে করে ভোক্তা বাড়বে, বিক্রি বাড়বে।

স্বাস্থ্যসম্মত শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থা
খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে বলতে চাই, হেসাপ, এইনসিসিপি, মান নিয়ন্ত্রণ না করে আপনি কোনোমতেই খাদ্যসামগ্রী রপ্তানি করতে পারবেন না। আমরা ১৩৪ টা দেশে রপ্তানি করি। সব পণ্যই কিন্তু ওইসব  দেশের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয় সুতরাং হেসাপ কমপ্লায়েন্ট না হয়ে কিন্তু কিছু করা যাবে না। একটা নতুন কোম্পানি তার আরএন্ডডিতে খুব নজর দেবে না। তারা সহজেই কপি করতে চায়। দ্রুত বাজার ধরতে চায়। তবে মানসম্মত না হলে কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে না। কেবল গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস মেনেই বিশ্ববাজারে যে কোনো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা সম্ভব।

দুধে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে প্রাণ
বাংলাদেশে দুধের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এখনো গুড়া দুধ প্রচুর পরিমাণে আমদানি করতে হচ্ছে।  তাই দুধে বাংলাদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কাজ করছে প্রাণ। কিছুদিন আগেও বিবিসিতে একটা নিউজ হয়েছে, বাংলাদেশে ২ কোটি ৪০ লক্ষ লোক রয়েছে; যাদের নিউট্রিশন লেভেল খুবই লো। এটা পূরণ করতে হলে এই ২ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষকে প্রচুর পরিমাণে দুধ খাওয়াতে হবে। এখন দুধ খাওয়াতে হলে আমদানি করা দুধ দিয়ে হবে না। কারণ এতে বেশি খরচ পড়ে যাওয়ায় অনেকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। দেশে যদি দুধের উৎপাদন বেড়ে যায় তাহলে খরচ কমে যাবে। সবাই কিনে খেতে পারবে। আমরা  ঢাকার বাইরে কয়েকটা ফার্ম করেছি। বর্তমানে একটি গাভী দৈনিক গড়ে ৮ লিটার দুধ দিচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এন উৎপাদন ২০ লিটারে নিয়ে যাওয়া। এতে কৃষকরাও লাভবান হবেন। এর বাইরে আমরা ইউগার্ট, ইউগার্ট ড্রিংক এসব নিয়েও কাজ করছি। কিছু বাচ্চা আছে দুধ খেতে চায় না কিন্তু দধি বা ইউগার্ট খেতে পছন্দ করে। এজন্য পুষ্টিগুণ ঠিক রেখে কিছু দুগ্ধজাত প্রোডাক্ট তৈরি করার চিন্তা রয়েছে।

প্রাণের নতুন পরিকল্পনা
আমরা বর্তমানে ৮ টি সেক্টর নিয়ে কাজ করছি- জুস এন্ড বেভারেজ, কার্বোনাইটেড বেভারেজ, ডেইরি, কুলিনারি, স্ন্যাকস, কনফেকশনারি, বেকারি এন্ড বিস্কিটস্ এবং এগ্রিকালচার এক্সটেনশন। আমরা এখন বাংলাদেশি সিঙাড়া, সমুচা এ ধরনের  প্রোডাক্ট নিয়ে চিন্তা করছি। বাংলাদেশি প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে আছে। তারা কিন্তু বাংলাদেশের সিঙাড়া, সমুচা, পরোটার কথা ভুলেনি। তাদেরও এটা খেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু দূর প্রবাসে এসব পাওয়া যায় না। আমরা যদি এটা এক্সপোর্ট করি তাহলে প্রবাসীরা এটা কিনে খেতে পারবে। পাশাপাশি ওইসব দেশের অধিবাসীরা  আমাদের দেশের  প্রোডাক্টের সঙ্গে পরিচিত হবে। তারা খেতে পারবে। এরপর পিঠা, পুলি, পায়েস রপ্তানির ও সুযোগ রয়েছে।

বাইরে কিন্তু একজনের ওপর পুরো পরিবার ডিপেনডেন্ট না। স্বামী স্ত্রী দুজনই কাজ করছেন। তাদের কারোরই অফিসের কাজ শেষে বাসায় ফিরে খাবার তৈরির এনার্জি থাকে না। ফলে রেডি ফুডের প্রতি নির্ভরশীলতা বাড়ছে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশেও এই প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রেডি ফুডের পাশাপাশি ভবিষ্যতে পোল্ট্রি নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। পোল্ট্রি প্রসেসিং শিল্প নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা আছে প্রাণ গ্রুপের।

ব্যবসার চ্যালেঞ্জ
আমাদের আর্থিক সহায়তার চেয়ে নীতি সহায়তা বেশি দরকার।  দেশের  উত্তরাঞ্চল কৃষিতে ভালো । সেখানে কৃষি নির্ভর শিল্প স্থাপন করলে ভালো করা সম্ভব। কাঁচামালের পরিবহন খরচ বেশি পড়বে না। কিন্তু উত্তরে শিল্প স্থাপনের বড় বাধা হচ্ছে জ্বালানি। ওখানে কোনো গ্যাস সংযোগ নেই। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহও নিরবিচ্ছিন্ন নয়। এ অবস্থায় শিল্প স্থাপন করতে হলে, জেনারেটর এবং এলপিজি গ্যাসের ওপর নির্ভর করত হবে। আর এতে  প্রোডাকশন কস্টও বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় বিদেশি কোম্পানি ও তাদের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়  আমাদের বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়।

জ্বালানি সমস্যার সমাধান কী
সরকার ইচ্ছা প্রকাশ করলে এ সমস্যার সমাধান হতে বেশি সময় লাগবে না। সরকার যদি শিল্পের জন্য জ্বালানি খাতে একটু ভর্তুকি বাড়িয়ে দেয়। ভর্তুকি বলতে, সরকারের ক্রয়মূল্যের চেয়ে কমে দিতে বলছি না। শিল্পের জন্য যদি সরকার  আমদানি মূল্যে জ্বালানি ও সার্ভিসটা দেয় তা হলে আমাদের উৎপাদন খরচ কমে যাবে। আমরা যদি ভালোভাবে শিল্প চালাতে পারি তাহলে সরকার ভ্যাট, ট্যাক্সসহ বিভিন্নভাবে লাভবান হবে। একইসঙ্গে অনেক বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।

সরকার নানাভাবে শিল্পের জন্য সহযোগিতা করতে পারে। যেমন, কৃষিপণ্যে বিশেষায়িত ভ্যাট সিস্টেম করতে পারে। একজন কৃষক কিন্তু কখনোই ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে মরিচ বা টমেটো বিক্রি করবে না। আর বেশি ভ্যাট দিলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের খরচটা বেড়ে যায়। এখানে যদি সরকার ভ্যাটে কিছুটা ছাড় দেয় তাহলে আমাদের একটু সুবিধা হয়। আমরা  ভ্যাট ১৫ শতাংশের জায়গায় ৫ শতাংশ নির্ধারণ করতে পারবো। যেহেতু আমি সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছি সেহেতু এটুকু সুবিধা আমরা পেতেই পারি।

বাজেটে প্রত্যাশা
এবারের বাজেটে আমাদের প্রধান চাওয়া হচ্ছে কৃষিপণ্যে বিশেষায়িত ভ্যাট ব্যবস্থা চালুকরণ। কৃষিজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে হবে। এগ্রিকালচার প্রোডাক্টের আমদানি নির্ভরতা কমাতে অভ্যন্তরীণ সহায়ক নীতিমালা করা দরকার।

ইলিয়াস মৃধা
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রাণ গ্রুপ

আজকের বাজার: আরআর/ ১৭ মে ২০১৭