এলএনজি আমদানি নিয়ে সংকটের আশঙ্কা

নাজমুল লিখনঃ দেশে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২০১৮ সাল থেকে গ্যাস দেবেন বলে বাজেট বক্তব্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এজন্য এলএনজি আমদানির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও সম্প্রতি বলেছেন, আগামী এপ্রিলে এলএনজির প্রথম চালানটি দেশে আসবে।
কিন্তু দুটো কারণে তরলীকৃত এই প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি নিয়ে সংকটে পড়ার আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্টদের অনেকে। এর একটি কারণ হলো-সম্প্রতি এশিয়ার বাজারে এলএনজির দাম বেড়েছে। যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এতে দেশে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে অথবা তাতে সরকারকে ভর্তুকী দিতে হবে। অপর কারণ হলো-আমদানি করা এই গ্যাস দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহ করতে যে পাইপলাইন দরকার তার মধ্যে দুটির কাজ শেষ হওয়া এখনও বেশ বাকি। ফলে আমদানি করা গ্যাস পুরোটা সরবরাহ করা নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
প্রাকৃতিক গ্যাস সাধারণ চাপ ও তাপমাত্রায় গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। শীতলকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাসের তাপমাত্রা কমিয়ে -১৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নামিয়ে আনলে গ্যাস তরলে পরিণত হয়। এই তরল প্রাকৃতিক গ্যাসকেই এলএনজি বলা হয়। পরিবহনের সুবিধার্থে এক বায়ুমন্ডলীয় চাপে এলএনজি তৈরি করা হয়। যখন প্রাকৃতিক গ্যাসকে সাধারণ বায়মন্ডলীয় চাপে তরল করে ফেলা হয় তখন এর আয়তন কমে যায় প্রায় ৬০০ গুন। অর্থাৎ ৬০০ লিটার গ্যাসকে এলএনজিতে রূপান্তরিত করে মাত্র এক লিটারের ছোট্ট একটা বোতলে ভরে ফেলা যায়। এই এলএনজি আমদানির পর তা বিশেষ ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক গ্যাসে রুপান্তর করে দেশের অভ্যান্তরে পাইপ লাইনে সরবরাহ করা হবে।
বেশ কয়েক বছর ধরে এলএনজির দাম কমতির দিকে ছিল। সম্প্রতি প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) গ্যাসের দাম উঠেছে সাড়ে ১০ মার্কিন ডলারে। এর আগে ২০১৪ সালে প্রতি এমএমবিটিইউর দাম ছিল ১৬ ডলার। ২০১৬ সালে তা ৬ দশমিক ৮৯ ডলারে নেমে আসে। এযাবৎ কালে সবচেয়ে কম দাম ছিল ২০১৬ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে, প্রতি এমএমবিটিইউ ৬ দশমিক ৬৮ ডলার। বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, গত নভেম্বর মাসে এ দর বেড়ে ৭ দশমিক ৭৫ ডলারে দাঁড়ায়।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর বলছে, চীন তাদের দেশে বায়ুদূষণ কমাতে কয়লার ব্যবহার কমাতে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ায় সেখানে এলএনজি আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এশিয়ার বাজারে হঠাৎ এলএনজি’র দাম বৃদ্ধির পেছনে এটা অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া যুক্তরাজ্যের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতিও দামের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
বর্তমানে বিশে^ এলএনজি আমদানির শীর্ষে রয়েছে জাপান। এরপরই রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারত ও তাইওয়ান। অন্যদিকে রপ্তানির তালিকায় শীর্ষে আছে কাতার, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। বৈশ্বিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, চলতি বছর জাপান ৮ কোটি ৩৫ লাখ টন এলএনজি আমদানি করেছে। চীন ৩ কোটি ৮০ লাখ টন এলএনজি আমদানি করে তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। কোরিয়ার আমদানি দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখ টনে।
এলএনজির এই মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয় বটে। কারণ, এ বছরে বাংলাদেশও এলএনজির বাজারে ক্রেতা হিসেবে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। সরকার আগামী বছরগুলোতে এলএনজির মাধ্যমে গ্যাসের চাহিদার একটা বড় অংশ পূরণ করার চিন্তা করছে।
বাংলাদেশে আগামী বছর দৈনিক গ্যাসের সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়াবে ৩৮০ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলার হিসাবে দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২৭০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা যাবে। আর এলএনজি আমদানি করে মেটানো হবে ১০০ কোটি ঘনফুটের চাহিদা। সরকার ২০২৫ সাল নাগাদ ৪০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি করতে চায়। ইতিমধ্যে এলএনজি আমদানিকে মাথায় রেখে দেশে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, এ দাম আরও বাড়ানো হলে পণ্য উৎপাদনে ব্যয় আরও বাড়বে। এদিকে গ্যাসের বিদ্যমান চাহিদা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এলএনজি আমদানি কোন দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধান না। দেশের অভ্যান্তরে বিশেষ করে সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিতে হবে। যদি সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, আমদানির পাশাপাশি দেশের অভ্যান্তরে অনুসন্ধান কাজও চলমান রয়েছে।
সরকারের পরিকল্পনা হলো-আগামী এপ্রিলে প্রথম দফায় ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা। এরপর পর্যায়ক্রমে এর পরিমান বাড়ানো। কিন্তু দাম কতটা সহনশীল হবে তা নিয়ে হিসেব নিকেশ চলছে বিভিন্ন মহলে।
দামের পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে গ্যাস আমদানি করা হলে তা ঠিকমত সরবরাহ করা নিয়েও এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। কারণ এই গ্যাস সরবরাহ করতে বিশেষ করে দুটি পাইপলাইনের কাজ এখনও অনেক বাকি। জ্বালানি বিভাগের আশঙ্কা, এ দুই পাইপলাইন যথাসময়ে প্রস্তুত না হলে আমদানি করা পুরো এলএনজি ব্যবহার করা যাবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দেশে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ ও সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড-জিটিসিএল দুটি গুরুত্বপূর্ণ পাইপলাইন নির্মাণে বড় ধরনের ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এর একটি হলো, বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ গ্যাস পাইপলাইন। যার কাজ ১০ বছরেও শেষ হয়নি। অপরটি ধনুয়া-এলেঙ্গা গ্যাস পাইপলাইনের কাজ গত তিন বছরে মাত্র ২৫ শতাংশ কাজ হয়েছে।
প্রায় সাড়ে ৮শ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ পাইপলাইনটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে। ১০ বছর পর এখনও ২০ শতাংশ কাজ বাকি। অন্যদিকে
অন্যদিকে ধনুয়া-এলেঙ্গা পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য ৬৬ কিলোমিটার। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৭৯ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের জুনে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০১৯ সালে। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
এ নিয়ে কিছুটা হতাশা পোষণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পাইপলাইন প্রস্তুত না থাকলে ২০১৮ সালে যে এলএনজি আমদানি করা হবে সেই গ্যাস পুরোটা সঞ্চালন করা যাবে না। এতে বলা হয়- প্রকল্প পরিচালকের যোগ্যতা, দক্ষতা, কর্মস্পৃহা এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর কওে প্রকল্পের সফল সমাপ্তি। এই প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে এই দীর্ঘ সময় নেওয়া প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের অদক্ষতার পরিচয় বহন করে।
সূত্র বলছে, বর্তমানে অনেক গ্যাসের অভাবে অনেক বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। বিশেষ সময়ে রেশনিং ব্যবস্থায় সারকারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দেওয়া হয়। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ব্যয়বহুল জ¦ালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। ফলে সরকারকে বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনা হলো-এলএনজি আমদানির পর প্রথমে তা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করা। এরপরই অগ্রাধিকারভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহ করা হবে শিল্পকারখানায়।
বর্তমানে সিরাজগঞ্জে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও খুলনাতে দ্বৈত জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলো বর্তমানে ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। সরকার চাইছে এলএনজি আমদানি শুরু হলে প্রথমেই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবাহ করা হবে। এ জন্য ধনুয়া-এলেঙ্গা ও বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ পাইপলাইনের প্রয়োজন পড়বে। এ ছাড়া ঢাকার আশপাশের শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বাড়াতেও এ দুই পাইপলাইনের গুরুত্ব অনেক। ফলে নির্ধারিত সময়ে পাইপলাইন নির্মাণ না হলে সরকারকে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হবে। এছাড়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শিল্প-কারখানায় গ্যাস দেওয়াও সম্ভব হবে না।
সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগে পাইপলাইন নির্মাণের অগ্রগতি নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে ওই দুই প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সংশ্নিষ্টরা দরপত্র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করেন। বৈঠকে প্রকল্প পরিচালকদের সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
এ ব্যাপারে জিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতিকুজ্জামান বলেন, বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ পাইপলাইন প্রকল্পের ইআরপির (এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট-সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা) কাজ ছাড়া অন্যান্য কাজ শেষ হয়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়ায় দেরির কারণে এ কাজ এখনও বাকি রয়েছে। অন্যদিকে ধনুয়া-এলেঙ্গা পাইপলাইনের ৬৬ কিলোমিটারের মধ্যে ১২ কিলোমিটার বসে গেছে। বাকিটার কাজ চলতি (২০১৮) বছরের মধ্যে শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
কয়েক বছর ধরেই শিল্প-কারখানাগুলোয় চলছে গ্যাস সংকট। এতে ভীষণভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া গ্যাসের অভাবে নতুন শিল্প-কারখানার অনেকগুলোতেই উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হয়নি। এমনকি সরকার ঘোষিত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোও গ্যাস সংকটে থমকে আছে। এ সংকট সমাধানের জন্য সরকারের ওপর অনেক দিন থেকেই চাপ দিয়ে আসছেন শিল্প মালিকরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুরুতে মহেশখালীতে নির্মীয়মাণ টার্মিনাল থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এলএনজি আমদানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পরে তা বদলে ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ এবং সর্বশেষ তা এপ্রিল মাস নির্ধারণ করা হয়। চলতি বছল এলএনজি চালু হলে এ সংকট অনেকটাই কমে আসবে বলে দাবি করছে জ্বালানি বিভাগ।
আজকের বাজার: সালি / ৩১ জানুয়ারি ২০১৮