করোনাজয়ী গণমাধ্যমকর্মীর বর্ণনা

হাসাপাতালে চতুর্থ দিন, সময় দুপুর আড়াইটা। ভীষণ ক্লান্ত অনুভব করছি। কিছুই ভাবতে পারছি না। নিজেকে শূন্য মনে হচ্ছে। গেলো তিনদিন খুব জোর করে মানসিক শক্তি ধরে রেখেছিলাম। সব কিছুই এখন ভীষণ এলোমেলো লাগছে। হাসপাতালে থাকা ওই দিনটার কথা স্বরণ করে এভাবেই বলছিলেন করোনাজয়ী গণমাধ্যমকর্মী শাহাদাত হোসেন।

শাহাদাত হোসেন। যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার ও প্রেজেন্টার। কিভাবে করোনাকে হারিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন পুরো পরিবার নিয়ে, কী করে কাটিয়েছেন এমন বিভিষিকাময় সময়। এসব বিষয় নিয়ে একান্ত সাক্ষাতে কথা হয় ডেইলি বাংলাদেশের সঙ্গে।

গণমাধ্যমকর্মীরাও সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবেই কাজ করছে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে। আর গণমাধ্যম হিসেবে কাজ করা শাহাদাত হোসেনও তাদের মধ্যে একজন।

হাসপাতালে কাটানো নয়দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে শাহাদাত হোসেন বলেন, হাসপাতালে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে নয়দিন পার করেছি। ওখানে মনে হয়েছিল রোগীরা একেবারে অভিভাবকহীন। আমি খুবই অসহায় বোধ করেছি। দেখতাম চোখের সামনে রোগীরা মারা যাচ্ছেন। মরদেহ ওয়ার্ডেই পড়ে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যেহেতু নির্দিষ্ট ব্যক্তি দাফন করেন, আর এমন লোকের সংখ্যাও কম, তাই হয়তো এমন পড়ে থাকছে। হাসপাতালের এ পরিস্থিতির মধ্যে একজন অসুস্থ রোগীর মনের অবস্থা কী হয় ভাবুন।

কীভাবে আক্রান্ত হলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এপ্রিল মাসের শেষের দিকে সামন্য জ্বর অনুভব করছিলাম। একটি প্যারাসিটামল খাওয়ার পর একরাতেই জ্বর সেরে গিয়েছিল। পরে পেশাগত দায়িত্বও পালন করেছিলাম। এরপর বাড়িতে আমার শ্বশুর কয়েকদিনের মধ্যে ব্যাপক জ্বর ও মাথা ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে করোনা পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়ার পর ভাবলাম আমিও একটু পরীক্ষা করিয়ে নেই। তবে উপসর্গ না থাকলেও করোনা পজিটিভ আসে আমার। এরপর শ্বশুরসহ পুরো পরিবারের সবাই আক্রান্ত হয়।খবর ডেইলি বাংলাদেশের।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাস পজিটিভ জানার পর শুরুতে খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছিলাম। কী করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সহকর্মীদের সহায়তায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। হাসপাতালে ভর্তির পর মনে হয়েছে জীবনে এতোটা অসহায় কোনোদিন বোধ করিনি।

চিকিৎসার সময় হাসপাতালে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে সাংবাদিক বলেন, হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় একজন চিকিৎসক আসতেন। অনেক দূর থেকে কথা বলে চলে যেতেন। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে একটি মানুষকেও পাওয়া যেতো না। এরকমও হয়েছে, নার্স আসেনি বলে একবার সকালের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়া হয়নি। চিকিৎসক দিনে একবারো আসেননি এমনও হয়েছে।

চিকিৎসার সময় কোনো ডাক্তার বা নার্সের কথায় আতঙ্কিত বা হতাশায় পড়েছিলেন কি না?

তিনি বলেন, হ্যাঁ, একদিন হালকা একটু ঝিমুনি আসছে; হঠাৎ দূর থেকে ডাক এলো আপনার নাম কি? মাথাটা তুলে দেখলাম দূরে একজন নার্স দাড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন। নাম বললাম। কথার একপর্যায়ে আমি যখন নার্সকে বললাম আমি পুরোপুরি সুস্থ, তখন তিনি আমাকে বললেন লন্ডনের এক ডাক্তারের করোনা ধরা পড়ছিলো, কিন্তু তার কোনো সিম্পটম ছিলে না, আপনার মতো। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার লুজ মোশন হওয়ার পর ফেরানো যায়নি তাকে। এমনিতে নানান দুশ্চিন্তায় রয়েছি, তার উপর নার্সের এমন কথায় মনে হয় আমিই মরে যাচ্ছি।

নার্সের এমন কথায় হতাশার সুরে শাহাদাত বলেন, সংকটে নেতিবাচক কথা মানুষকে আরো বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। যেনে সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছি আমি। কিন্তু একজন চিকিৎসকের কথায় আমার ভরসা পাওয়ার কথা। তার কথায় আমার মনোবল বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে মানসিক সাপোর্ট দেয়ার কেউ ছিল না।

নিজের চোখে দেখা করোনা রোগীদের বর্ণনায় শাহাদাত বলেন, প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। তাই সারাক্ষণই নতুন নতুন রোগী আসতেই থাকে। আমাদের ওয়ার্ড যেদিন চালু করেছিল (অর্থাৎ আমার হাসাপাতালে থাকার দ্বিতীয় দিনে) সেদিনই সব বেড পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। পরদিন থেকে আমাদের ওয়ার্ডের পাশে বিশাল আরো একটি ওয়ার্ড তৈরি করা হয়।

করোনায় আক্রান্ত রোগীর শ্বাসকষ্টে মৃত্যু যন্ত্রণা নিজে চোখে দেখেছেন কিনা জানতে চাইলে এই সাংবাদিক বলেন, যেখান থেকে ফিল্টারের পানি নেই, সেখানে গেলে সব কিছু সামনে থেকে দেখা যায়। ওয়াশ রুমের পাশে রাখা ফিল্টার থেকে পানি আনার সময় দেখলাম একজন কোভিড-১৯ রোগী প্রায় মারা যাচ্ছেন। তাকে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে রাখা হয়েছে তবুও তিনি নিশ্বাস নিতে পারছিলেন না। মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। হাসপাতালে আসার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই এমন চিত্র চোখে পড়ছে।

হাসপাতালে কাটানো সময়ে পরিবার ও ছোট সন্তান সম্পর্কে কি মনে হয়েছিলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেদিন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখে মনে হচ্ছিলো শরীরে কোনো শক্তি নেই। বারবার শুধু আমার নিষ্পাপ সন্তানের মুখ মনে পড়ছিলো। আহ! কত আদর আর ভালোবাসায় তাকে জড়িয়ে চুমু খেয়েছি। সেই ভালোবাসা আমার সন্তানকে হুমকিতে ফেলেছে।

পরিবারে স্ত্রী ও সাড়ে তিন মাস বয়সী কন্যা সন্তানের করোনা আক্রান্তের বিষয়ে বলতে গিয়ে আতঙ্ক ও কান্না জড়িত কণ্ঠে শাহাদাত বলেন, সেদিন দুপুর সাড়ে বারোটা, বিছানায় শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিলাম এমন সময় হঠাৎ ফোনের শব্দে উঠে বসি। শবনম (আমার সহধর্মিণী) ফোন করেছে। হঠাৎ মনে পড়লো আজ ওদের কোভিড-১৯ এর টেস্টের রেজাল্ট দেয়ার কথা। মনে মনে শুধু আল্লাহকে স্মরণ করছিলাম। শবনম জানালো সে, আমার সাড়ে তিন মাস বয়সী কন্যা, আমার শাশুড়ির কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে। মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো।

চিন্তায় দেহ, মন সব অবস হয়ে আসছিলো। তবুও নিজেকে শক্ত করে শবনমকে শক্ত থাকতে বললাম। আপাতত ফোন বন্ধ করে কিছু ওষুধের নির্দেশনা দিয়ে বললাম সবকিছু যেনো সহজ হয় সে ব্যবস্থা নিবো। সেদিন দুপুর দেড়টায় খাবার দেয়ার জন্য পিপিই ম্যান এলো। আমি খাবার নিতে উঠলাম না।

হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতা ও সেবা সম্পর্কে তিনি বলেন, একদিন ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ সবাইকে বেশ তৎপর এবং গুছানো মনে হচ্ছিলো। ওয়ার্ডে যারাই আসে পিপিই পরে খুব সাবধানে কার্যক্রম চালান। সকাল ১০টায় পুরো ওয়ার্ড ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার পর সাড়ে ১০টায় দু’জন নার্স আর একজন ডাক্তার আসেন। আজই দেখলাম ডাক্তার সবার কাছে গিয়ে কথা শুনছেন,সবার জন্য আলাদা নির্ধারিত ফাইলে চিকিৎসাপত্র লিখে দিচ্ছেন। আমাদের সঙ্গে কথা বলে নার্সরা ওষুধ বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান। কিন্তু আগে এমন হয়নি।

কিভাবে হাসপাতালের পুরো সময় পার না করে বাসায় গেলেন? এমন প্রশ্নে সাংবাদিক শাহাদাত বলেন, সহকর্মী নাজমুল হোসেনের অনুরোধে ডাক্তার সামন্ত লাল সেনের পরামর্শে ঢামেকের একজন অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলে চিকিৎসা পরামর্শ নেই বাসার সবার জন্য। এদিকে আইইডিসিআরের পরিচালক সেব্রিনা ফ্লোরা সেন সারকে পরামর্শ দেন সমস্যা বেশি না হলে বাসায় থেকে ট্রিটমেন্ট করাই উত্তম হবে আমার পরিবারের সদস্যদের। আমরাও মনে প্রাণে সেটাই চাচ্ছিলাম।

অন্যান্য সুবিধাদির বর্ণনা দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, তিনি যে ওয়ার্ডে ছিলেন সেখানে একশ’র মতো রোগী ছিল। এতো রোগীর জন্য মাত্র তিনটি টয়লেট, তিনটি গোসলখানা। একপর্যায়ে রোগী বাড়তে শুরু করার পর চিকিৎসকদের অনুরোধ করে তার শ্বশুরসহ বাড়ি চলে আসেন।

সবশেষ শাহাদাত হোসেন বলেন, আল্লাহর রহমতে এখন আমি ও আমার পরিবারের সবাই সুস্থ রয়েছি। তবে এখনো অফিস করছি না।