কৃষি অর্থনীতিতে পড়াশোনা এবং চাকরির বাজার

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি কৃষি। ফসল উৎপাদন, সংরক্ষণ ও ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যেই এখন আর কৃষি শিক্ষা-গবেষণা সীমাবদ্ধ নেই। কৃষি এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ফলে দেশে ও বিদেশে কৃষির উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্র দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নতুন ধারণা, বাড়ছে কর্মক্ষেত্র। সম্ভাবনাময় এ ক্ষেত্রটিতে তাই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে গবেষক ও অর্থনীতিবিদের চাহিদা। দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রটি আগে প্রতিষ্ঠিত থাকলেও, কৃষি অর্থনীতি গবেষণার ধারণাটি সম্প্রতি ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো বটেই, কৃষি অর্থনীতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এ বিষয়ে পাঠদান করা হচ্ছে। বিসিএসসহ সরকারি ও বেসরকারি বহুজাতিক কোম্পানিতে কৃষি অর্থনীতিবিদদের চাহিদা দিনদিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কৃষি অর্থনীতি কি
কৃষি অর্থনীতি একটি সম্পূর্ণ প্রয়োগিক অর্থনৈতিক বিজ্ঞান। অর্থনীতির বিভিন্ন নীতি যখন কৃষি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তখন তাকে কৃষি অর্থনীতি বলে। এটি মুলত ফসল, গৃহপালিত পশু ও মৎস্য উৎপাদন ও উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠ বিপণনের ক্ষেত্রে অর্থনীতির বিভিন্ন নীতি প্রয়োগ করে। কৃষি অর্থনীতি বিভিন্ন প্রায়গিক বিষয়ের সমন্বয় এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রচলিত অর্থনীতির সঙ্গে পুনরাবৃত্তি হয়ে যায়।

কৃষি অর্থনীতি গুরুত্ব
কৃষি অর্থনীতি কৃষক কে বিভিন্ন ফসল, পশু, মাছ ইত্যাদির লাভজনক প্রজাতি নির্বাচন ও উৎপাদন করতে পরামর্শ প্রদান, ফসল উৎপাদনের জন্য জমি নির্বাচন ও তাতে বিভিন্ন ইনপুট যেমন সার, বীজ, পানি ইত্যাদি ব্যবহারে দিক নির্দেশনা প্রদান, কৃষি ঋণ গ্রহণ ও এর যথার্থ ব্যবহারে তথ্য প্রদান, কৃষি সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান, কৃষি পণ্য বিপণন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করে এবং সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতির বিবেচনায় কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহনে সহায়তা করে। কৃষি অর্থনীতি ব্যাংকিং বিষয়ক তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে অবদান রাখতে সহায়তা করে। কৃষি অর্থনীতি ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তা তৈরিতে শিক্ষা প্রদান, কৃষি ব্যবসা পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক শিক্ষা প্রদান, ফার্ম ব্যবস্থাপনা বিষয়ক শিক্ষা প্রদান, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা বিষয়ক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদের দারিদ্র্য দূর করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়নে সহায়তা করে।

যা পড়ানো হয়
কৃষি অর্থনীতি সাধারণত সাধারন অর্থনীতি, মার্কেটিং, ম্যানেজমেন্ট, ব্যাংকিং, সমাজ বিজ্ঞান, গ্রামীণ উন্নয়ন এর প্রায় সব প্রধান দিকগুলো পড়িয়ে থাকে। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে মৌলিক অর্থনীতি, ব্যষ্টিক অর্থনীতি, সামস্টিক অর্থনীতি, উৎপাদন অর্থনীতি, গাণিতিক অর্থনীতি, প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থনীতি, পরিবেশ অর্থনীতি, কৃষিনীতি ও পরিকল্পনা, কৃষি উন্নয়ন অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, বাংলাদেশের অর্থনীতি, খামার ব্যবস্থাপনা, কৃষি ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, কৃষি বিপণন, গ্রামীণ উদ্যোক্তা তৈরিকরন, দাম বিশ্লেষণ ও দাম নির্ধারন, কৃষি সমবায়, হিসাববিদ্যা, অর্থ সংস্থান বিদ্যা, ব্যাংকিং-র নীতি ও অনুশীলন, ব্যাংকিং-এ বিনিয়োগ ও আধুনিকায়ন, কৃষি ঋণ ও টাকার বাজার, কৃষি ঋণ ব্যবস্থাপনা, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, গ্রামীণ সমাজ বিজ্ঞান, দারিদ্র্য গবেষণা, গ্রামীণ উন্নয়ন, সরকার এবং রাজনীতি, নৃবিজ্ঞান, মৌলিক পরিসংখ্যান, প্রায়গিক পরিসংখ্যান, গবেষণা পদ্ধতি, মান নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়। সেই সাথে কৃষিতত্ত্ব, উদ্যানতত্ত্ব, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, কৃষি সম্প্রসারণ, পশু বিজ্ঞান, মাৎস্যবিজ্ঞান, ইংরেজি, কম্পিউটার বিজ্ঞান, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, এগ্রিকালচারাল ইনফরমেশন সিস্টেম, ই-কমার্স ও ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়।

অনার্সের শেষ সেমিস্টার বা টার্মে সরকারি বেসরকারি ব্যাংক, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এগ্রিবিজনেস ফার্ম অথবা কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপ করানো হয়ে থাকে।

চাকরির ক্ষেত্র
কৃষি অর্থনীতি গ্রাজুয়েটরা দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, পরামর্শদানকারি প্রতিস্থান, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক, এগ্রিবিজনেস ফার্ম, বহুজাতিক কোম্পানি ইত্যাদিতে সাফল্যের সাথে শীর্ষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত রয়েছে। কৃষি অর্থনীতি গ্রাজুয়েটরা নিম্মোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে আবেদন করার যোগ্যতা রাখে।

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের আওতাভুক্ত সরকারি সকল প্রথম শ্রেণীর চাকুরীতে আবেদন করতে পারে।

কৃষি বিপণণ অধিদপ্তর
কৃষি বিপণণ অধিদপ্তরের অধীনে কৃষি অর্থনীতির বিশেষ ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে যা বর্তমানে উপাজেলাওয়ারি করার কাজ চলছে।

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই), বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি), আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট (ওঋচজও), আন্তর্জাতিক ফসল গবেষণা ইনস্টিটিউট (ওঈজওঝঅঞ), মার্কিন শ্রম পরিসংখ্যান অধিদপ্তর, আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র (ঈওগগণঞ) ইত্যাদিতে কৃষি অর্থনীতির সতন্ত্র বিভাগ রয়েছে যেখানে কৃষি অর্থনীতি গ্রাজুয়েটদের নিয়োগ দেয়া হয়।

স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান
সকল স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান বিশেষভাবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো), বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি), বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড), পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (আরডিএ), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি), সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিস্থান (বিআইডিএস), বাংলাদেশ পল্লি বিদ্যুতায়ন বোর্ড ইত্যাদিতে কৃষি অর্থনীতি গ্রাজুয়েটদের সতন্ত্র বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়।

ব্যাংক
কৃষি অর্থনীতি গ্রাজুয়েটরা সকল সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে আবেদনের যোগ্যতা রাখে । বিশেষভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ইত্যাদিতে কৃষি অর্থনীতি গ্রাজুয়েটদের বিশেষ চাহিদা রয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এ কৃষি অর্থনীতি গ্রাজুয়েটদের আলাদা ভাবে নিয়োগ দেয়া হয়।

কনসালটেন্সি ফার্ম
ক্যাসেড (ঈঅঝঝঊউ), ইনোভিশন (ওহহড়ারংরড়হ) ইত্যাদিতে কৃষি অর্থনীতি গ্রাজুয়েটরা খুব সহজেই চাকুরী পেতে পারে।

কোম্পানি
প্রায় সকল সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানিতে কৃষি অর্থনীতি গ্রাজুয়েটদের চাহিদা রয়েছে। বিশেষভাবে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিঃ, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিঃ, জিল বাংলা সুগার মিলস লিঃ, পাবনা সুগার মিলস লি. ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক এনজিও: এশিয়া ফাউন্ডেশন, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ, প্রাক্টিক্যাল অ্যাকশন, ইউএসএআইডি, আইএফএডি, ইউএসডিএ, ড্যানিডা, এফএও, আইডিই, কেয়ার, ব্র্যাক, ওয়ার্ল্ড ভিশন, সানেট, ডেভেক্স, আশা, প্রশিকা, ডিএফআইডি, ওয়ার্ল্ড ফিশ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (ব্যাট), হরটেক্স ফাউন্ডেশন, কারিতাস, এসএফডিএফ, বিএমডিএ, জিআইজেড, পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র, এসকিউ গ্রুপ, মাহদিন গ্রুপ, এগ্রো ডাইভারসিটি কমপ্লেক্স ইত্যাদিতে কৃষি অর্থনীতি গ্রাজুয়েটদের বিশেষ চাহিদা রয়েছে ।

কোথায় পড়বেন
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ উন্নয়ন অনুষদ, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

আজকের বাজার: আরআর/ ২৭ আগস্ট ২০১৭