গতানুগতিক নয়, নতুন ধারার ফিন্যান্সিয়াল প্রোডাক্ট আনছে ফার্স্ট ফাইন্যান্স

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে জাগাটায় অস্থির, সেটা হচ্ছে ফান্ডের ক্রাইসিস। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে অতিমাত্রায় নগদ অর্থ নেই। তারপর আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ পার্থক্য রয়েছে, এটা একটা প্রধানতম কারণ। দ্বিতীয়ত, বাজার থেকে প্রচুর টাকা বিভিন্নভাবে অন্য দেশের ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, ঐ টাকাগুলো বড় ব্যবসায়ীরা এখান থেকে নিয়ে অন্য স্থানে লগ্নি করেছে। সেটিও একটি কারণ হতে পারে।

ক্যাশ টাকার লেনদেন ব্যাংক ছাড়াও বিভিন্নভাবে হচ্ছে। যেমন, কয়েকদিন আগের আলোচিত ইস্যু ক্যাসিনোর মাধ্যমেও এটা হতে পারে। যে কারণে ব্যাংকগুলোর কাছে লিকিউডিটি ওরকম থাকছে না।

আবার মধ্যম আয়ের লোকজন, যারা সরকারি বেতনে চলেন অথবা বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তাদের বেতনও ওই মাত্রায় বাড়ছে না। ফলে জাতীয় সঞ্চয় বাড়ছে না।

আরেকটি প্রধানতম বিষয় হচ্ছে, ওয়েজার্নারদের ক্ষেত্রে। বেশ কয়েক বছর ধরে এই সেক্টরটিতে স্থবিরতা লক্ষণীয়। নতুন করে লোকজন বিদেশে যাচ্ছে না। তারপর বিদেশ থেকে বহু লোকের ফেরত আসার প্রবনতাও বেড়েছে। যে কারণে, রেমিটেন্স প্রবাহে একটা ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। এই ঘাটতির কারণে ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানলোতে এটার একটা বড় প্রভাব পড়েছে।

এডিবি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু হয়ে জুন প্রান্তিকে গিয়ে বেশি অর্থ খরচ হয়। অতিরিক্ত খরচের টাকাটা আগে ব্যাংক, বীমা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ছিল। এখন সরকারের নতুন সার্কুলারে বলা হয়েছে যে, সরকারের যেসব কোম্পানি আর্নিংস করে, তাদের আর্নিংস সরাসরি সরকার নিয়ে নিবে। এটা কোনো ব্যাংক, বীমার কাছে লগ্নি করবে না। সেজন্য একটা বড় অংকের টাকা সরকারের ট্রেজারিতে থেকে যাচ্ছে, ব্যাংক-বীমায় আসছে না।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পিপলস্ লিজিং-এর অবসায়নের বিষয়টি। এর ফলে শুধুমাত্র ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতেই নয়, বরং সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠা্নগুলোতে বড় ধরণের অস্তিরতার সৃষ্টি হয়েছে। একটি ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানি যদি অবসায়িত হয়, তাহলে অন্যান্য ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানির উপর বড় ধরণের প্রভাব পড়ে। আইডিএলসি, আইপিডিসি’র মত সুনামধন্য যেসব লিজ ফাইন্যান্স কোম্পানি রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে যতটা না প্রভাব পড়ে, তার চেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে মিড লেভেলের লিজিং কোম্পানিগুলোর ওপর। যাদের ব্যাডডেট পারসেন্টেজ একটু বেশি, যারা বছরের পর বছর লভ্যাংশ দিতে পারছে না অথবা তাদের আয় থেকে খুব স্বল্প মাত্রায় লভ্যাংশ দেয়, তাদের ওপর।

এখন কিন্তু মানুষ অনেক সচেতন। কোনো যায়গায় অর্থ লগ্নি করতে গেলে, ওই কোম্পানির ফাইন্যান্সিয়াল অবস্থা দেখে নেয়। আগে এমন একটি ধারণা ছিল যে, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখলে সময় মতো ফেরত পাওয়া যাবে। এটা নিয়ে কোন চিন্তা নাই। তখন মানুষ কোন ফাইন্যান্সে টাকা রাখছে তার রেটিং গ্রেডিং দেখত না। যে ফাইন্যান্সে বৃদ্ধির হার বেশি সেখানেই সে অর্থ লগ্নি করতো। এটা ছিলো তৎকালীন সাধারণ ভাবনা।

গত ২০১৮ সালেও পিপলস্ লিজিং ২০০০ কোটি টাকার এফডিআর নিয়েছে। তবে তাদের রেটিং অতটা ভালো ছিলো না। মানুষের ঐ আস্থার জায়গাটা ছিল যে, লিজিং কোম্পানিতে বা ব্যাংকে টাকা রাখলে সুধসহ সময় মতো ফেরত পাবে তারা। কিন্তু পিপলস্ লিজিং অবসায়ীত হওয়ার কারণে মানুষের তিন চার হাজার কোটি টাকা আটকে গেলো। তখন এই প্রশ্নটা ওঠে এসছে যে, লিজিং কোম্পানিতে রাখাও সেফ না।

তারপর সদ্য নাম পরিবর্তীত হওয়া পদ্মা ব্যাংকের (আগে ফার্মাস ব্যাংক ছিলো) এফডিআর নিয়ে অনেক রকম কথা হয়েছে যে, তাদের ব্যাংকের চেক দিয়েও সেটাও পাশ হয় না। এই সব কারণে একটা খারাপ প্রভাব ব্যাংকগুলোর উপরে পড়েছে। এই আস্থাহীনতার শুরুই হয়েছে পদ্মা ব্যাংক এবং পিপলস্ লিজিং দিয়ে। এর একটা ব্যাংক সেক্টরের, অন্যটি ননব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরের।

এদিকে সরকারি ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সময় ভর্তুকি পাচ্ছে, কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপো নেয়ার সুযোগ রয়েছে তাদের। আবার তারা বিভিন্নভাবে সরকারের থেকে ফান্ডিংও পায়। সুতরাং তাদের টিকে থাকাটা অনেকটা সহজ। তারপরও অধিকাংশ সময় তাদের ব্যাডডেট অনেক বেশি থাকে। তারা কিন্তু বছরের পর বছর লস দিয়ে যাচ্ছে। তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার পরও তারা ফান্ডিং পাচ্ছে। অন্যদিকে, যেসকল ছোট ছোট লিজিং কোম্পানি রয়েছে, তারা কিন্তু ওই মাত্রায় সাপোর্ট পাচ্ছে না।

আবার কোন কোন লিজিং এ সরকার ফান্ড রাখতে পারবে তার একটা রেটিং করে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এর বাইরের লিজিংগুলোকে সার্ভাইভ করতে কষ্ট হয়। অনেক বেশি সুদে তাদেরকে টাকা আনতে হয়।

ফার্স্ট ফাইন্যান্স, পিপলস্ লিজিংয়ের বাইরেও এনপিএল একটি জাতীয় সমস্যা। এর প্রভাব সরকারি ব্যাংকগুলোর উপরও পড়েছে। এনপিএল-এর পারসেন্টেজ বাড়ার কারণেই কাস্টমাররা সুদ মওকুফসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেয়ে পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ফলে অনেক ভালো গ্রাহক ইচ্ছাকৃতভাবে এখন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিদেশী ব্যাংকগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় যে, তারা অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে লোন দেয়। যার কারণে তাদের এনপিএলের মাত্রা অনেক কম হয়।

কিন্তু আমাদের দেশে যারা ক্যাশফ্লো বিশ্লেষন করে এবং কোলেটারাল সিকিউরিটিজিরে দিকে বেশি ঝুকে যাচ্ছে, তারাই বেশি পিছনে পড়ে যাচ্ছে। কারণ কোলেটারাল সিকিউরিটিজি দিয়ে টাকাকে সাবসিডিয়ারি করা যায় না।

বিদেশে এ্যসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে নতুন-পুরোনো লোন বিক্রি করে দেয়ার সুযোগ রয়েছে। এমনকি লোণকে ইন্সিউরড করা যায়। যেগুলোর মাধ্যমে অনেক সময় ব্যাংক অভিযোগ করে ইন্সুরেন্স কোম্পানি থেকে টাকা নিতে পারে। লোণের বিপক্ষ্যে ইন্সুরেন্স ও এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি করলে রিস্ক অনেক কমে যাবে ব্যাংকগুলোর।

প্রোডাক্টওয়াইজ নতুন কোনো কোম্পানি যখন নতুন আইডিয়া নিয়ে আসে, বাংলাদেশে ব্যাবসা করতে আসে, ওই ব্যাবসা পাঁচ দশ বছর টিকে থাকে। কারণ অনেক লোকজন ওই ব্যাবসা শুরু করলে তখন প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে। তখন নতুন ব্যাবসায় লোন দিলে পুরাতন পারসেন্টেজ কম হবে, কারণ তারা কিন্তু প্রথম কয়েক বছর ব্যাবসা করে যাবে।

আমাদের চেয়ারম্যান ইস্রাফিল আলম একজন শ্রমিকবান্ধব ও কৃষকবান্ধব মানুষ। আমরা কৃষকদের জন্য নতুন যে প্রোডাক্ট উদ্ভোধন করতে যাচ্ছি, যা জানুয়ারি থেকে মার্কেটে আসবে। তা থেকে গ্রাহকরা অন্যান্যদের তুলনায় বেশি সাপোর্ট পাবে। প্যারামেডিক বা ফিজিওথেরাপিস্ট ডাক্তারদের জন্য সেন্টার করে দেয়ার জন্য একটা নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে আমরা ভাবছি। পাশাপাশি টেকনিক্যাল সেক্টরগুলো যেমন, ইঞ্জিনিয়ারিং, নার্সিং ই্নিস্টি্টিউট রয়েছে, সেখানে আমরা ফান্ডিং করার চিন্তা করছি। কারণ এটার ভবিষ্যৎ অনেক ভালো। ফিজিওথেরাপি সেন্টারগুলো আমাদের দেশে বেশ প্রতিষ্ঠিত।

তারপর আমাদের যে ব্যাডডেট পোর্টফোলিও সে পোর্টফোলিও থেকে আমরা রিকভারি এজেন্ট নিয়োগ করেছি। স্পেশাল এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন খুলেছি, যারা স্পেশাল এ্যাসেটগুলিকে ম্যানেজ করে। তাছাড়া আমাদের ব্যাডডেট পার্সেন্টেজ অনেক কমে এসেছে। ডিসেম্বর প্রান্তিকে আমরা আমাদের ব্যাডডেট পার্সেন্টেজ আগে যা ছিল তার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারবো।

আমরা নতুন প্রোডাক্ট বাজারে আনছি এবং নতুন করে বেশ কিছু লোন দেয়ার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি আমরা সব ব্যাংকের সাথে আমাদের সম্পর্কের উন্নতি করার চেষ্টা করছি যেন তাদের থেকে আমরা ফান্ডিং সাপোর্ট পেতে পারি।

‘আমাদের ভিষণ ২০২০’ যেটা রয়েছে, সেই লক্ষ্যে আমরা ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ আমরা চেষ্টা করবো এবং আমাদের বিশ্বাস আমরা ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আমাদের কোম্পানিকে টপ লিজিং কোম্পানির সারিতে নিয়ে যেতে পারবো।

আমরা আমাদের গ্রাহক সংখ্যা অনেক বাড়াতে চাই। আমাদের শাখাও সম্প্রসারণ করতে চাই। ছোট ছোট কটেজ ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে গড়ার ক্ষেত্রে আমরা কাজে লাগতে চাই। আমরা চাই ফার্স্ট ফাইন্যান্স এর সাথে অনেক গ্রাহক আমাদের সাথে আসুক।

মো: তুহিন রেজা
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড