গত কয়েক বছরে বিজনেস পরিবেশ বেশ ভালো হয়েছে:এখন বিনিয়োগের সময়

বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থাপনা আলোচনায় থাকে প্রায় সারা বছরই। ঋণ কেলেঙ্কারি থেকে মূলধনের সংকট কিংবা পরিচালক নিয়োগ নানা প্রসঙ্গে ব্যাংকিং খাতের সরব উপস্থিতি মিডিয়াজুড়ে। বেসরকারি ব্যাংক পরিচালনায় খন্দকার ফজলে রশিদের অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। আমাদের ব্যাংকিং খাতের ভলো-মন্দ সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি দৈনিক আজকের বাজার আজকের বাজার টেলিভিশন-এবিটিভির সঙ্গে। সেসব আলাপচারিতা তাঁর নিজের ভাষাতেই ছাপা হলো পাঠকদের জন্য।

ব্যাংকিং খাতের সার্বিক অবস্থা নিয়ে বলতে গেলে বলব, বর্তমান সময়ে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা খুব ভলো বা খারাপ কোনোটাই না। আমাদের কিছু লিকুইডিটি সারপ্লাস আছে, ইনভেস্টমেন্ট কাক্সিক্ষত পর্যায়ে হচ্ছে না। আবার অনেকে চিন্তিত দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে। কারণ যে অঙ্কের ইনভেস্টই তিনি করেন, সব খরচ মিটিয়ে তাঁর মূলধনসহ প্রফিটটা ফিরে পাওয়ার একটা বিষয় আছে, যার জন্য ইনভেস্টমেন্টের অবস্থা কিছুটা স্থবির, তবে আবার একদম স্থবিরও না। আমরা এখনো প্রচুর ইনভেস্টমেন্টের অফার পাচ্ছি, প্রচুর ফান্ডিং রিকোয়েস্ট পাচ্ছি। পাশাপাশি রেগুলেটররাও দিনে দিনে কড়া হচ্ছে।

তার মানে হচ্ছে, আমরা একটা স্টাকচার্ড ওয়ের দিকে এগোচ্ছি। মার্কেট তার নিজস্ব গতি ঠিক করে নেবে। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ দিনে দিনে কড়া হচ্ছে, আমাদের ভেবে-চিন্তে ইনভেস্ট করতে হচ্ছে। টাকা হাতে থাকলেই যে হুট করে ইনভেস্ট করে ফেলব, সেটা কিন্তু এখন আমরা করছি না। এখন বলব, আমরা ধীরে-সুস্থে এবং স্থির লক্ষ্যে এগোচ্ছি।

ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জ
যে টাকাটা আমরা মার্কেট থেকে ওঠাই, সে টাকাটা একসময় প্রফিটসহ ফেরত দিতে হয়। একই সময়ে আমাদের প্রফিট করতে হয়, আমাদের শেয়ারহোল্ডার ও অংশীদার পরিচালক সবাইকেই তাঁদের ইনভেস্ট লাভসহ ফেরত দিতে হয়। মার্কেটে একটা প্রতিক্রিয়া থাকে যে যদি আমি সঠিকভাবে লভ্যাংশ না দিই, ক্লাসিফাইড লোন যদি কন্ট্রোলে না থাকে, রেট অব ইন্টারেস্ট বা লেন্ডিং রেট অ্যাজপার যদি না থাকে, ডিপোজিট মার্কেটের সামঞ্জস্য না হয়, তখন আমাদের বিভিন্ন রকম সমস্যা ফেস করতে হয়। আমরা চেষ্টা করি সব কিছুকে একটি ব্যালেন্সড সিচুয়েশনে আনার জন্য।

ব্যাংকের ব্যবসা এখন কেমন
ফিক্সড ডিপোজিটের বিপরীতে সুদের হার এখন সর্বনিম্ন, নতুন ইনভেস্টমেন্টের প্রস্তাব ও ইনভেস্টমেন্টে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এই অবস্থায় ব্যাংকের ব্যবসা কেমন হচ্ছে? বড় বিজনেস হাউজগুলো বসে নেই। দেশে বড় বিজনেস হাউজের সংখ্যা ৫০০ থেকে ১০০০ হবে। তবে ১৬ কোটি মানুষের দেশে লার্জ চাংক যদি চিন্তা করে কী করব কী করব না, তাহলে পরিস্থিতি বদলাতে সময় লাগবে। যাদের হাতে টাকা আছে, বিজনেসে এসে যদি তারা ভালো না করতে পারে, তারা তো একটা ঝামেলার মধ্যে পড়ে যায়। যার কারণে বড় বড় হাউজ থেকে বিজনেস রিকোয়েস্ট আসছে এবং তারা খুব ক্যালকুলেট ওয়েতে বিজনেস করে। তারা পুরোনো ইউনিটের সাথে নতুন ইউনিট যোগ করছে। নতুন করে ইনভেস্টমেন্টের বিষয়ে অনেকে চিন্তা করছে কতটুকু সারভাইভ করতে পারবে। বলা যায় পুরোনোগুলোর সঙ্গে নতুন ইউনিট যোগ করে পুরোনোরা বেশ কমফোর্টেবল অবস্থায় আছে।

ব্যাংকিং খাতের সমস্যা
অনেকেই বলছেন, ব্যাংকে ক্রাইসিস চলছে। আমি মনে করি তেমনটা না। অনেকেই চিন্তা করছেন বিজনেসে স্থিতি নেই। আমি দেখছি গত তিন-চার বছরে বিজনেস কন্ডিশন অনেক ভালো হয়েছে। এখন মনে করি ইনভেস্ট করার সময়। সবকিছুর দাম মোটামুটি কমে এসেছে, ইনফ্লেশন কমে এসেছে, লেন্ডিং রেট কমে এসেছে। এর কারণ হচ্ছে, যেহেতু আমার ইভেস্টমেন্ট নেই, আমার কাছে অনেক টাকা জমে আছে। যে রেটে ডিপোজিট কালেক্ট করছি, তার চেয়ে বেটার রেট পেলেই আমি তাতে ইনভেস্ট করব। রাজনৈতিক অবস্থাও ভালো। আমি কোনো কারণ দেখছি না ইনভেস্ট না করার।

লোন-বৈষম্যের কারণ
দেশের সাধারণ মানুষ যদি আরও একটু বেশি পরিমাণে বিজনেস করতে এগিয়ে আসত, এই সুযোগটা যদি নিতে পারত, অ্যাভেইল করত। তাহলে কিন্তু আমাদের বড় গ্রুপে অতটা যাওয়ার কথা না। আমরা চিন্তা করি, টাকাটা ইনভেস্ট করে কোথা থেকে ফেরত নিয়ে আসব? ৫০০ কোটি টাকা লোন রেখে নতুন লোন দেওয়া, এটা একাটা রেয়ার কেস। এখানে অনেক সময় নিয়মিত করার জন্য তাদের টাকা দিয়ে রিরোলিং করা হয়। পুরোনো টাকাটাকেই রিফুয়েলিং করা বা এটাকে চালু করে দেওয়া হয়। তবে নতুন লোনের ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু সহজে লোন দিচ্ছি। গত বছর আমাদের ক্রেডিট গ্রোথ ছিল ৩৩ পার্সেন্ট।

আমাদের ডিপোজিট গ্রোথ ছিল ২৭-২৮ পার্সেন্ট। এটা সর্বোচ্চ। সব সময়ই যে বড় জায়গায় লোন দিতে হবে, এটা প্রয়োজনীয় না। এসএমইর মাধ্যমে আমরা প্রায় ২ হাজার নতুন ক্লায়েন্ট যোগ করেছি। এখানে মাত্র দশমিক ২ পার্সেন্ট হচ্ছে ক্লাসিফিকেশনস। সুতরাং বড় গ্রুপকে লোন দিলেই ভালো হবে সেটা না। আমি মনে করি, বড় একটি লোন দেওয়ার চেয়ে ছোট ১০টি দেওয়া অনেক ভালো। একজনকে ৫০০ কোটি টাকা দেওয়ার চেয়ে পাঁচজনকে দেওয়া ভালো। এদের মধ্যে একজনেরটা খারাপ হলে আটকাবে ১০০ কোটি টাকা। আর বাকি ৪০০ কোটি টাকা আমার নিরাপদ থাকছে। তাই মিডিয়াম ও স্মলই ভালো।

এসএমই প্রসঙ্গ
আমরা চিন্তা করি, লোকটার ব্যবসা করার যোগ্যতা কতটুকু আছে, লোন ফেরত দিতে পারবে কি না। ক্লায়েন্ট সিলেকশনে আমরা জোর দিই। ভৈরবের বাঁশগাড়িতে আমাদের একটি ব্রাঞ্চ আছে। সেখানে আমরা ২০ হাজার, ৫০ হাজার, ১ লাখ দিয়ে শুরু করেছি। আমরা অবশ্যই মনে করি আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে সেখানে গরিব মানুষ থাকবে না। আমি মনে করি, আমাদের দেশের উন্নতি হলে আমারও উন্নতি হবে। যারা বড়, তাদের বড় দিতেই হবে। তবে যারা ছোট বা মাঝারি, তাদেরও আমরা ফেলে দিই না। সবাইকে নিয়েই আমরা একটা সমৃদ্ধির দিকে যেতে চাই।

করপোরেট ট্যাক্স কমলে ব্যাংকিং খাতে প্রভাব
ট্যাক্স কম হলে, সেই টাকাটা অনেক কাজে লাগবে। এটা বিজনেসের কাজে আসবে। জনহিতকর কাজে আসবে। ট্যাক্স কম দেওয়া মানে আমাদের টাকাটা আবার বিজনেসেই ইনভেস্ট হচ্ছে। তখন বিজনেস বাড়বে।

ব্যাংকিং খাতে দক্ষ জনশক্তি
দেশে এখন ৫৭টা ব্যাংক। সারা দেশে যদি বছরে প্রতিটির জন্য ১০টি করে নতুন ব্রাঞ্চ হয়, তাহলে প্রচুর কর্মী দরকার। সেই হিসাবে প্রশিক্ষিত লোকবল পাওয়া খুব কষ্টকর। এখন আমরা ম্যানেজার খুঁজে পাচ্ছি না। তবে রাতারাতি দক্ষতা গড়ে ওঠে না। সময় লাগে। আমাদের ব্যাংকের জন্য অনেক মেধাবী ছেলেমেয়েকে আমরা ট্রেনিং করাই। এরা এক-দুই বছরের মাথায় দক্ষ হয়ে ওঠে। দক্ষতার পাশাপাশি জনবলেরও ঘাটতি আছে। তবে এখন প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব ট্রেনিং ইনস্টিটিউটও গড়ে উঠেছে।

১৫ বছর ধরে আমরাও ট্রেনিং চালাচ্ছি। এখানে আমাদের ব্যাংকিং থেকে শুরু করে অপারেশন প্রসিডিউর, জেনারেল ব্যাংকিং, ফরেন ট্রেড, ট্রেজারিÑ সব দিকেই আমরা ট্রেনিং দিচ্ছি। এ ছাড়া যেসব ট্রেনিং আমরা দেশে করাতে পারি না, সেগুলো বিদেশে পাঠিয়ে ট্রেনিং করিয়ে আনি। যেখানে যখন ভালো ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকে, সেখানে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করি। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোতে এ বিষয়ে পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকলেও লাভ হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, তারা প্র্যাকটিক্যাল কাজ করছে না। এখানে ব্যাংকিং বিষয়ে একটি করে সাবজেক্ট শেষ হওয়ার পর পর সরাসরি ব্যাংক বা কোনো প্র্যাকটিক্যাল ইনস্টিটিউশনে কাজের সুযোগ করে দিলে ছাত্ররা দক্ষ হয়েই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবে।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের বিশেষত্ব
আমরা ক্লায়েন্টের নিডটাকে এসেস করার চেষ্টা করছি। আমরা আমাদের প্রডাক্ট সেভাবেই ডিজাইন করি। ক্লায়েন্টের নিড কিন্তু পরিবেশের ওপরও নির্ভর করে। আগে আমাদের ক্লায়েন্টের নিড ছিল শুধু ক্যাশ, কিন্তু এখন অনেক ক্লায়েন্টকে ক্যাশ দিতে চাইলেও ওনারা নিতে চান না। তাঁদের প্রয়োজন ব্যাংকিং ফ্যাসিলিটিজ। যত ব্যাংকিং সেবা রয়েছে, তাঁরা সেগুলো চাচ্ছেন। অনেকে ক্যাশ কিন্তু নেনও না। আমরা ক্লায়েন্টের কী দরকার, সেভাবেই আমাদের প্রডাক্টগুলো ডিজাইন করি। তাতে আমরা খুব সাড়া পাচ্ছি। ঢাকার বাইরে প্রচুর কাজ হয়। সেখানে যখন ক্লায়েন্টরা রিটার্ন নিতে যান, তখন তাঁদের প্রচুর পে-অর্ডারের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় দেখা যায় যে অনেকগুলো পে-অর্ডারের প্রয়োজন হয়, তখন সেটা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা তাঁদের একটি ক্রেডিট লিমিট করে দিচ্ছি, সে অনুযায়ী তাঁরা তাঁদের প্রয়োজনমতো পে-অর্ডার করতে পারছেন।

এখন এসএমইতে অনেক বিজনেস আসছে। যেমন গাজীপুরে অনেক পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। এই পোলট্রি কিন্তু একটি বিরাট বিজনেস। এখানে আমারা অনেক ফান্ড দিচ্ছি। ছোট ছোট অনেক ফার্ম আছে, যারা আমাদের থেকে ফান্ড নিচ্ছে। আমরা স্টুডেন্টদের বাইরে পড়ার জন্য লোন দিয়ে থাকি। তবে এটার অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো না। আমরা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ক্ষেত্রে যারা টাকার অভাবে পড়তে পারছে না, তাদেরকে চার-পাঁচ বছরের জন্য ফান্ড দেব। তারা পড়া শেষ করে কোনো একটা ফার্মে জয়েন করে আস্তে আস্তে টাকা পরিশোধ করবে। তাদের সার্টিফিকেট আমাদের কাছে জমা থাকতে পারে লোন শোধ না করা পর্যন্ত। তবে এখনো এর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য প্রিমিয়ার ব্যাংক
অনেকেই ভাবেন নতুনদের লোন না দিলে কোথায় তাঁরা ক্যাপিটাল পাবেন? আমাদের দেশের একটি প্রবণতা হলো প্রথমেই অনেক বড় করে শুরু করা। এটা উচিত না। আপনি শুরু করেন বিজনেসটা। সবকিছু প্ল্যান করে এগোন। হঠাৎ করে বিরাট কিছু করতে চাইলে ধাক্কা খাবেন। আমরা সবাইকে বলি, আপনারা শুরু করেন, আমরা আছি আপনাদের সাথে। বিরাট যে গ্যারান্টি বা সিকিউরিটি দিতে হবে, এটা কোনো বিষয় নয়। কিন্তু আপনার প্ল্যানটা থাকতে হবে কীভাবে আপনার বিজনেসটা লাভজনক হবে। আপনি একটু ইনভেস্ট করবেন, আমিও আপনাকে ফান্ড দেব। তবে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি সততার সঙ্গে বিজনেস করে ব্যাংকের টাকা শোধ করবেন। এভাবে অনেকেই কিন্তু এগোচ্ছেন।

ভালো করার জন্য পরামর্শ
আমাদের ব্যংকে সবার আগে অনেস্টি অ্যান্ড ইন্টিগ্রিটি টু আওয়ার বিজনেস। আমরা যদি মনে করি রাতারাতি আমরা টাকা বানিয়ে ফেলব, এটা কিন্তু ঠিক না। আপনাকে পরিশ্রমী হতে হবে, সৎ থাকতে হবে, আপনার বিজনেসের জন্য প্রপার প্ল্যানিং থাকতে হবে। যেকোনো কাজেই প্রপার প্ল্যান না করে এগোলে সফল হওয়া যাবে না। যেকোনো বিজনেস করার আগে আপনি কোথায় যেতে চান, কীভাবে যেতে চান, এর সমস্যা যেগুলো আসবে, সেগুলো সমাধান কীভাবে করবেন, তা চিন্তা করে এগোতে হবে। আমি মনে করি, সব কাজেই সমস্যা থাকবে আর এই সমস্যার সমাধান কীভাবে করতে হবে তার রাস্তা বের করতে হবে।

খন্দকার ফজলে রশিদ
এমডি, প্রিমিয়ার ব্যাংক