গার্মেন্টস ব্যবসার মন্দা কাটাতে চাই সরকারের সহায়তা : মুনির হোসেন

তৈরি পোশাক শিল্প আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস। মাননীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, পোশাক শিল্প কিছুটা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আছে। ধরে নেওয়া যায় এটি মন্ত্রীর সত্যকথন। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির জন্যেও এটি ভালো খবর নয়। অতি দ্রুত এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। বিজিএমইএ’র পরিচালক মো: মুনির হোসেন আজকের বাজার ও এবি টিভির সঙ্গে আলাপচারিতায় পোশাক শিল্পের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর কথপোকথনের অনুলিখন তাঁরই ভাষায় ছাপা হলো।

তৈরি পোশাক শিল্প খাতের সার্বিক অবস্থা নিয়ে প্রথমেই বলবো, অর্থমন্ত্রী তার বাজেট প্রস্তাবনায় বলেছেন যে গার্মেন্টস খাত বেশ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এটা এখন প্রতিষ্ঠিত যে তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিকূল অবস্থায় আছে, ক্রান্তিকাল পার করছে। এছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও মাঝে-মধ্যে বলেন, আমাদের তৈরি পোশাক খাতে দর পতন ক্রমাগত অব্যাহত আছে। কিন্তু কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস, কমপ্লায়েন্স, বায়ারদের চাহিদা এই সব কিছু পূরণ করার পরও সেই তুলনায় বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের দাম তো দিচ্ছেই না বরং তা আরও কমাচ্ছে। আমাদের দুই ধরনের সমস্যা চলছে। প্রথমটি দেশের বাইরের ক্রেতা, দেশের পরিস্থিতি এবং ক্রেতার চাহিদার সাথে সম্পর্কিত। দ্বিতীয়ত দেশের অভ্যন্তরীণ পোর্ট, ট্যাক্স, ভ্যাট বিষয়ক নীতিমালা।

বাইরের সমস্যা নিয়ে বলা যায়, আমাদের দেশের বাবসার ধরণটা একটু অন্য রকম। আমাদের রপ্তানির প্রায় ৬২ থেকে ৬৫ ভাগ ইউরোপকেদ্রিক।?

এই দেশগুলোর কারেন্সির দর পতন হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। যখন মুদ্রার দরপতন হয় তখন রপ্তানিকারকরা কিছুটা স্বস্তিতে থাকেন আর অস্বস্তিতে থাকেন আমদানিকারকরা। তো বিদেশে আমাদের ক্রেতারা আমদানি করছেন ফলে তারা তিগ্রস্ত, অস্বস্তিতে আছেন। অন্যদিকে আমাদের টাকার মান শক্তিশালী হয়েছে। ফলে এ দেশের রপ্তানিকারকরা অস্বস্তিতে আছেন। সবমিলিয়ে আমাদের দ্বিমুখী সমস্যা। মুদ্রার দরপতনের ফলে ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। আগে ডলারের এক্সচেঞ্জ রেট ছিল ৮৫ টাকা, কিন্তু এখন ১ ডলারে পাওয়া যায় ৮০ টাকার নিচে। যখন ডলারের রেট ছিল ৮৫ টাকা তখন ব্যবসা চলছিল একরকম আর যখন কমে গেছে তখন সেই গ্যাপটি পূরণ হয়নি। বিদেশি ক্রেতারা দাম কমিয়ে দিয়েছে। যেহেতু তাদের দেশে কারেন্সির ডিভ্যালুয়েশন হয়েছে। এখানে ব্রেক্সিটের একটা প্রভাব আছে- পাউন্ড ও ডলারের যে ক্রসরেট আছে সেখানেও প্রায় ২৫ থেকে ৩০ পার্সেন্টের একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে। আমেরিকাতেও আমাদের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ইউরোজোন, ব্রেক্সিট, আমেরিকা এই তিনটি বড় বাজারে আমাদের গত দশ বছরে গ্রোথ ১০ ভাগের উপরে ছিল। অথচ এবার তা ২.২১ ভাগে নেমে এসেছে। অন্যদিকে আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভারত, কম্বোডিয়া, চীনে মুদ্রার মানে পতন হয়েছে। ফলে সেখানকার রপ্তানিকারকরাও সুবিধার মধ্যে আছেন। ভারত সরকার ভারতের রপ্তানিকারকদের জন্য ৬০০০ কোটি রুপির ইনটেনসিভ দিচ্ছে। তো তারা যখন ৬০০০ কোটি রুপি দিয়ে তাদের ক্রেতাকে অফার করবে, আর যখন আমরা করবো তখন তো আমরাই পিছিয়ে যাই ফলে গ্রোথ কমে যাবে। তাই আমাদের বিশেষ সহায়তা দরকার।

দেশের ভিতরের সমস্যার মধ্যে আছে – চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রমাগত পণ্যজট চলছে, ঘূর্ণিঝড় মোরার প্রভাব, বন্দরে জট থাকায় মালামাল এয়ারে দিলে খরচ বেশি। এই ধরনের নানা সমস্যার কারণে খরচ বাড়ছে আর কমিটমেন্টে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। ফলে আমাদের রপ্তানি কমে যাচ্ছে, কারখানা দুর্বল হয়ে পড়ছে । পাশাপাশি পোশাক খাতের অস্থিরতা নিয়ে সবাই চিন্তিত। সার্বিকভাবে আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ।

সোর্স ট্যাক্স বাড়ানোর প্রভাব
এইবারের বাজেটে সোর্স ট্যাক্স গতবারের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। এটা যদি সংশোধন বা কমানো না হয় তাহলে পয়লালা জুলাই থেকে এক পার্সেন্ট করে দিতে হবে এখন আমরা যা দিচ্ছি .৭০ হারে।

ভ্যাট নিয়ে সমস্যা
আমাদের ভ্যাট মুক্ত রাখা হয়েছে কিন্তু আমরা স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয় করলে ভ্যাট দিতে হয় ও পরে রিফান্ড দিতে হয়। এই রিফান্ড ব্যবস্থা বেশ জটিল। যেহেতু এই খাত থেকে ৮০ ভাগ রপ্তানি আয় হচ্ছে। এছাড়া এই খাতে কৃষির পর এককভাবে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় তাই বলবে ভ্যাট নিয়ে সংশোধন ও সরকারের সহায়তা প্রয়োজন।

বাজেট থেকে প্রাপ্তি
এ বছর বাজেট থেকে কী পেয়েছি তা সঠিকভাবে বলা যাবে না কারণ এটা প্রস্তাবিত বাজেট। এই বাজেট অনুযায়ী সোর্স ট্যাক্স ০.৭০ থেকে ০.৩০ বেড়ে ১ পার্সেন্ট হবে। শুধুমাত্র কর্পোরেট ট্যাক্স ২০ ভাগ থেকে কমিয়ে ১৫ পার্সেন্ট করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ২০ বা ১৫ উভয় ক্ষেত্র একই পরিমাণ সোর্স ট্যাক্স দিতে হয়। এটা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুবিধা দেয় কিন্তু আমাদের দাবি ছিল ১০ পার্সেন্ট। ১০ ভাগ দিয়ে কেউ নতুন ইনভেস্টমেন্টে যেতে পারবে। নতুন বিনিয়োগে গেলে ট্যাক্স যেটুকু কমে তার বেশিরভাগ সরকার পাবে।

কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোর সুবিধা
কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোর ফলে ইনভেস্টমেন্ট বাড়বে। ফলে অন্য কোনো ট্যাক্সে প্রভাব পড়ে না বরং এর ফলে ইনভেস্টমেন্ট বাড়ে কিংবা কমে। ইনভেস্টমেন্ট বাড়লে অন্যদিক থেকে সরকার ট্যাক্স পাবে।

চূড়ান্ত বাজেট নিয়ে প্রত্যাশা
চূড়ান্ত বাজেট নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা হলো, তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যবসা যেন ভালোভাব করা যায় সে ব্যাপারে সরকার সহায়তা করবে। সরকারকে ভ্যাট দিতে হবে তা না হলে সরকার চলবে কী করে? আবার যে ভ্যাট দিবে তার ব্যবসা যদি সচল না থাকে তাহলে সে তো ভ্যাট দিতে পারবে না। ভ্যাট শুধু এক জায়গা থেকে নিলে হবে না ব্যবসার নানা খাতে ভ্যাটজাল বাড়াতে হবে। আর বাংলাদেশের মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে ভ্যাট দেয় তা না হলে আয় কর মেলায় এত ভিড় হতো না। আমার কথা হচ্ছে সব ভালো যার শেষ ভালো।

ঈদে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে প্রস্তুতি
ঈদের বেতন শ্রমিকেরা সময়মত সবাই পেয়ে যাবে। গত কয়েক বছরে কোনও সমস্যা হয়নি। এবারও সমস্যা হবে না।

গার্মেন্টস খাত উন্নয়নে করণীয়
আমাদের পোর্টের সমতা বাড়াতে হবে, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বাড়াতে হবে। সব কাজে দ্রুত গতি আনতে হবে, সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে, বাজার বাড়াতে হবে, নতুন বাজার খুঁজতে হবে। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক ৪ লেন করা হয়েছে কিন্তু প্রয়োজন ৮ লেনের । পাশাপাশি এয়ারপোর্টের কার্গো হ্যান্ডলিং ব্যবস্থা উন্নত করা, সহজ মুদ্রানীতি প্রণয়ন জরুরি।

গার্মেন্টসের জন্য বিদ্যুৎ
অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি । এগুলো ছাড়া বিনিয়োগের অর্থ থাকলেও বিনিয়োগ করা যায় না। তাই এই জ্বালানি খাতে সামর্থ্য বাড়াতে হবে। লোডশেডিং সহনশীল পর্যায়ে রাখতে হবে।

পায়রা বন্দরের সম্ভাবনা
পরিকল্পনা অনুযায়ী পায়রা বন্দর গভীর সমুদ্র বন্দর । এটা হয়ে গেলে শুধু গার্মেন্টস নয়, অন্যান্য সব ব্যবসায়ের জন্য ভালো হবে, দেশের উন্নতি হবে। মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে পায়রা বন্দর যোগ হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে আরো গতি আসবে। কারণ বন্দরগুলো হলো আমদানি ও রপ্তানির মূল কেন্দ্র।

মো: মুনির হোসেন
পরিচালক
বিজিএমইএ