চা শিল্প হতে পারে অপার সম্ভাবনার আরেক নাম

চা ছিল এক সময় বাংলাদেশে প্রধান অর্থকরী ফসলের একটি। তখন পাটের পরই চা রপ্তানি থেকে আয় হতো বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। সারাবিশে^ চা রপ্তানিতে সেসময় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫ম। কিন্তু আস্তে আস্তে সোনালী আঁশের (পাট) মত চা শিল্পও হারাতে থাকে নিজস্বতা। দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে চায়ের চাহিদা, কিন্তু সে হিসাবে বাড়চে না উৎপাদন। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও যথাযথ পদক্ষেপে চায়ের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে আয় করা সম্ভব প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।

২০১৮ সালে দেশের ১৬৬টি বাগানে ৮ কোটি ২১ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে, চাহিদার ঘাটতি থাকলেও এটি দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদন। এর আগে ২০১৬ সালে রেকর্ড ৮ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল। উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বছরে ১০ কোটি (১০০ মিলিয়ন) কেজি চা উৎপাদনের তালিকায় স্থান করে নেবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ টি বোর্ড।

জানা গেছে, গত বছর দেশের বাগানগুলো থেকে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭ কোটি ২৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি। কিন্তু উৎপাদন হয়েছে ৮ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার কেজি। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১ কোটি কেজি বেশি চা উৎপাদন হয়েছে। আর ২০১৭ সালে উৎপাদন হয়েছিল ৭ কোটি ৮৯ লাখ ৪৯ হাজার কেজি। যদিও ২০১৬ সালে বাংলাদেশে রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ ৮ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল।

তবে বছরের প্রথমে অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের কারণে চা কম উৎপাদন হয়। তবে বছরের শেষদিকে চা উপযোগী আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন বাড়তে থাকে। আর তাই শেষ কয়েক মাসে পর্যাপ্ত পরিমাণ চা উৎপাদনের ফলে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড করে বাংলাদেশ। চা উৎপাদন কেমন হবে এটা সম্পূর্ণ নিভর করে আবহাওয়ার ওপর। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে চা বেশি উৎপাদন হয়। এর সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়াটাও জরুরী।

এদিকে, দেশে যেমন চা উৎপাদন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে চাহিদাও । ২০১৫ সালে দেশে চায়ের চাহিদাও ছিল ৭ কোটি ৭৬ লাখ কেজি। যদিও ওই বছর দেশে চা উৎপাদন হয়েছিল ৬ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার কেজি। এর পরের বছর ২০১৬ সালে ৮ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার কেজি চাহিদাও বিপরীতে উৎপাদন হয় ৮ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার কেজি। এছাড়া ২০১৭ সালে চাহিদা বেড়ে ৮ কোটি ৫৯ লাখ ৩০ হাজার কেজিতে উন্নীত হলেও দেশে চা উৎপাদন কমে যায়। উৎপাদন হয় মাত্র ৭ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা। সর্বশেষ ২০১৮ সালে চায়ের বার্ষিক চাহিদা আরো বেড়েছে। প্রায় নয় কোটিতে উন্নীত হয়েছে। তবে চাহিদা পূরণ না হলেও চা উৎপাদন আগের বছর থেকে বেড়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৮ কোটি ২২ লাখ কেজি।

যেহেতু প্রতিনিয়ত বাড়ছে চায়ের চাহিদা কিন্তু উৎপাদন চাহিদার কম হওয়ায় বিশ্ববাজার থেকে আমদানির করেই ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে। দেশের শীর্ষ একাধিক ব্র্যান্ডের চা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, দেশে চায়ের ভোক্তা বাড়ছে, এটা খুশির খবর হলেও আমাদের উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে উন্নত মানের চায়ের কদর বেশি হলেও গুণগত মানে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে। ফলে অতিরিক্ত শুল্ক সত্ত্বেও ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলোকে নিভর করতে হচ্ছে বিশ^বাজারের উপর। তারা বলেন, চাহিদা পূরণের জন্য উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে। পাশাপাশি চায়ের মানের দিকে নজর দিতে হবে।

এছাড়া বাংলাদেশে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। ফলে অন্য দেশের চেয়ে উৎপাদন কম হচ্ছে। আর তাই চাহিদার জোগান দিতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ চা আমদানি করতে হচ্ছে। প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। এ শিল্পের ওপর নানাভাবে নিভর্রশীল মানুষের সংখ্যা প্রায় চার লাখ। পাশাপাশি চা শিল্প শ্রমিকদের উন্নয়নেও নানা কমর্সূচি নিতে হবে। যাতে তারাও এ শিল্পের প্রসারের বিষয়ে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে।

অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য হতে নিয়েছে পরিকল্পনা ভিশন-২০২৫।
বাংলাদেশ টি বোর্ড সরকারের ভিশন-২০২৫ বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছে। এর আওতায় ২০২৫ সালের মধ্যে বাষির্ক ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের মাইলফলক অতিক্রমের লক্ষ্য নিধার্রণ করা হয়েছে। বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে চায়ের শ্রেণিবিন্যাস করার পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। সাধারণ কালো চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঠা-া চা, সুগন্ধি চা, মসলাযুক্ত চা, ঔষধি চায়ের মতো বিশেষ ক্যাটাগরির চা রপ্তানি করা হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, চা শিল্প খাতে একটু নজর দিলে চায়ের দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। চা চাষের সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে উত্তরের জেলাগুলোতে। এ অঞ্চলের মাটি উন্নতমানের চা উৎপাদনের জন্য বেশ উপযোগী। এখানে চা উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পঞ্চগড়ের অগাির্নক চা তো বিদেশে রপ্তানি হচ্ছেই। ঠাকুরগাঁতেও সীমিত পরিসরে চা চাষ হচ্ছে। লালমনিরহাট, নীলফামারিতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। একটু উন্নতব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সিলেট, মৌলবীবাজার, হবিগঞ্জের চায়ের মান বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বাড়তি চাহিদা মেটাতে দেশের উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলায় উন্নতমানের চা উৎপাদন বেগবান করতে হবে।

এ সব সহযোগিতা ও সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগালে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের ক্রমবধর্মান চাহিদা পূরণ হবে। এরপর বিপুল পরিমাণ চা বিদেশে রপ্তানি করাও সম্ভব হবে। এ ছাড়া চায়ের আমদানিকে নিরুৎসাহিত করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। চায়ের বাজার ধরে রাখতে হলে আমাদের উচ্চফলনশীল জাতের চা চাষ বাড়াতে হবে। তাহলেই দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে।

যেহেতু চা বাগান বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকেও বিকশিত করছে । প্রতিবছর দেশি-বিদেশি বহু পর্যটক সিলেটসহ পাহাড়ি অঞ্চলের চা বাগানে ভ্রমণ করতে আসেন, যা দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি অবদান রাখছে। শুধু দরকার সঠিক নজরদারি ও পদক্ষেপ । সঠিক নজরদারিতে অপার সম্ভাবনার এ খাত সমৃদ্ধ করতে পারে দেশের অর্থনীতিকে।

 

 

আজকের বাজার/মিথিলা