এবারের বাজেট তথ্য প্রযুক্তি সহায়ক : রফিকুল আনোয়ার

প্রস্তাবিত বাজেটের উপর তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, গ্লোবাল ব্র্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আনোয়ার। আজকের বাজার ও এবি টিভির কাছে বাজেটের নানা দিক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তাঁর সঙ্গে কথপোকথনের অনুলিখন তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

প্রথমত এবারের বাজেটকে একজন ব্যবসায়ীর দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে পারি ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাজেট হয়নি। আবার পাশাপাশি যেহেতু ব্যবসার মধ্যে আমি প্রত্যক্ষভাবে আইটি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত,আইটি ব্যবসার উপরে আমাদের ভ্যাট দিতে হবে না। এটা আমার জন্য ভালো। কম্পিউটার,কম্পিউটার যন্ত্রাংশ বা কম্পিউটারের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত এরকম জিনিসের আমদানি ও সরবরাহ ব্যবসায় ভ্যাট মওফুক করেছে সরকার। বলা যায়, ইনফরমেশন টেকনোলজি ব্যবসায়ীদের জন্য এবারের বাজেট যথেষ্ট ভালো। এ ছাড়া সার্বিকভাবে কিছু কিছু পণ্য ছাড়া যেমন জরুরি ওষুধ,খাদ্যপণ্য,নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও এগ্রিকালচারার প্রোডাক্ট সর্বোপরি কম্পিউটার ও কম্পিউটার যন্ত্রাংশকে ভ্যাট মুক্ত রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া বলা যায় যে শতকরা ৯০ শতাংশ প্রোডাক্ট বা তার থেকে বেশি ভ্যাটের আওতায় পড়েছে। এবারের ভ্যাটের আওতায় স্ল্যাপ নেই, অর্থ্যাৎ সবার জন্য ১৫ ভাগ ভ্যাট। ১৫ শতাংশ ভ্যাট সবার পক্ষে দেওয়াটা আমার মনে হয় খুব কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ আপনি হোটেল বা রেস্টুরেন্টে গেলেন সেখানে ১৫ ভাগ ভ্যাট দিতে পারেন কিন্তু আপনি যখন স্বর্ণ কিনতে যাবেন সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। মানে ১ লাখ টাকায় ১৫ হাজার টাকা ভ্যাট দিতে হবে। এটা খুব কষ্টকর হবে। স্বর্ণ বা স্বর্ণ দিয়ে যখন অলংকার বানানো হয় বা বিক্রি হয় তখন,আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও কিন্তু স্বর্ণের উপর ১% ভ্যাট। সে তুলনায় আমাদের দেশে ১৫ ভাগ ভ্যাট অনেক বেশি। সার্বিকভাবে বলতে পারি সব ধরনের পণ্যে যে পরিমাণ ভ্যাট সরকার নির্ধারণ করেছে তাতে আমাদের জীবন যাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে। ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনমুখী শিল্পে স্বাভাবিকভাবেই প্রোডাকশন কমে যাবে। উৎপাদন যখন কমে যাবে তখন তাদের কর্মসংস্থানও কিন্তু কমে যাবে। তার মানে উৎপাদনমুখী দেশীয় শিল্পে যখন বিক্রি কমে যাবে,সরবরাহ কমে যাবে,উৎপাদন কমে যাবে,তখন দেশে নতুনভাবে এমপ্লয়মেন্টটা হবে না। তাহলে কী হবে? কর্মসংস্থান কম হবে। সেটা পরোক্ষভাবে দেশের জন্য ক্ষতিকর। সবমিলিয়ে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, ভ্যাট শতাংশ হারে বাড়ালে ভালো তো। এ বছর ৮ ভাগ পরের বছর ১০, এভাবে হলে আমাদের জন্য ভালো হতো। গ্রহণযোগ্য হতো।

আর একটি বিষয়, সরকার ব্যাংকে ১ বা ৫ লক্ষ টাকার উপরে থাকলে এবং কোটি টাকা থাকলে স্ল্যাপ বেসিস যে আবগারি শুল্ক বসাতে চাচ্ছে আমি অত্যন্ত ভারাকান্ত মনে বলছি, এখন সময় নয় যে আমাদের দেশের মানুষকে আবগারি শুল্ক দিতে হবে। আবগারি শুল্ক জনস্বার্থ উপযোগী নয়। তামাক,সিগারেট,অ্যালকোহল এ জাতীয় পণ্য ব্যবহারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আবগারি শুল্ক বসানো হয়। আমি এখন ব্যাংকে টাকা রাখব বা আমার একজন ভাই গরিব,মধ্যবিত্ত ১ বা ২ লক্ষ টাকা ব্যাংকে ৩ মাসের জন্য এফডিআর করে রাখবে তাতে সে যা লভ্যাংশ পাবে তাতে তার কোন লাভই থাকবেনা। ২ বা ৪ লক্ষ টাকা যারা ব্যাংকে রাখে সরকার তাদের প্রতি ভ্যাট না বসালেও পারতো। সরকার যদি সিদ্ধান্ত দেয়, যাদের ৫০ লক্ষ টাকার উপরে ব্যাংকে টাকা থাকবে তারা আবগারি শুল্ক দিবে। তাহলে তারা দিতে পারবে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভালো হয়নি। এতে সার্বিকভাবে সকল মানুষের উপর চাপ বেড়ে যাবে।

বাজেট বড় আকারের করার অর্থ হচ্ছে এই বছরে আমি এই বাজেটটাকে বাস্তবায়ন করবে। গত কয়েক বছর কিন্তু আমাদের বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এটা একটা উচ্চাভিলাষী বাজেট। এবারের বাজেটও সম্ভবত বাস্তবায়ন হবে না। জনগণের উপরে অতিরিক্ত করের বোঝা চাপবে। পাশাপাশি নিন্মবিত্ত, নিন্ম মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য ভ্যাট দেওয়া কষ্টকর হবে।

সঞ্চয়পত্রে ভ্যাট কমানো
যারা সরকারি চাকরি করে অবসর নেন তখন তারা এককালীন একটা ভাতা পান অর্থ্যাৎ সঞ্চয় পত্র। তাদের সঞ্চয়পত্রের উপর ২% ইনন্টারেস্ট কমানো হবে। এটা তাদের জন্য অনেকটা কষ্টের হবে। কারণ এই সঞ্চয়ের টাকা দিয়েই তাদের সংসারে বড় ধরনের একটা সার্পোট হয়। সব মিলিযে বাজেটটা ভালো হয়নি। তবে আমি যেহেতু আইটি ব্যবসা করি সেহেতু এই ব্যবসার জন্য সরকার বাজেটে যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।

ভ্যাট-ট্যাক্স সহনীয় পর্যায়ে আনার উপায়
সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অর্থমন্ত্রী সম্ভবত এই বাজেটকে তাদের আয়ের তাদের আদর্শ জায়গা হিসেবে ভেবেছেন। উন্নয়ন, রাজস্ব, জিডিপির গ্রোথ সবকিছুকে ধরে রাখার জন্য তাদের তো টাকা লাগবে। তাই তাদেরকে এমন বাজেট করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে উন্নয়নের দরকার আছে। আর উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমি যদি বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার সহযোগিতা নিতে পারি, বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আইএফসি, ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাইকার মতো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে উন্নয়ন কাজ করতে পারি। এতে করে জনগণের উপর করের বোঝাটা একটু কমে যেত। ট্যাক্স যারা দেয় তাদের সংখ্যা ট্যাক্সের আওতা বাড়ানো উচিত। এখন যে পরিমাণ মানুষ ট্যাক্স দেয় তার থেকে ১০ গুণ বেশি মানুষের কাছ থেকে ট্যাক্স নিতে হবে। বিবেচনা করলে ভ্যাট কমানো সম্ভব।

বাজেট পাশ হওয়ার আগে ব্যবসায়ীদের চাওয়া
আমাদের ফেডারেশন আছে, চেম্বার আছে। প্রায় প্রতিটি সেক্টরের ব্যবসায়ী নেতারা বক্তব্য দিয়েছেন। বাজেট পাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে ভ্যাটের বিষয়টাকে নমনীয় করুন। আবগারি শুল্ক প্রত্যহারের অনুরোধ জানাবো।

ব্যক্তি হিসেবে ভ্যাট দিতে হবে
আমি ট্যাক্স দিই। ভ্যাট দিবো। এবার ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়েছে। মানুষ যখন ভ্যাট দিবে তখন আমাকে তো দিতে হবে। ভ্যাট ও ট্যক্সের টাকাটা সরকার আমার কাছ থেকে নিচ্ছে। নিচ্ছে কেন? সরকার তার রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্যই নিচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কয়েকটি ধাপ আছে। যেমন-সরকার তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিবে। টোটাল বাজেটের ২২% যাবে সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার জন্য। ৫০ হাজার কোটি টাকা যদি আমি এই কাজে খরচ করি বা উন্নয়নমূলক কাজে খরচ করি, তাহলে আমার শেষ চাওয়া থাকবে যে প্রতিটি ধাপে আমি যে পরিমাণ খরচ করবো তা যেন সঠিকভাবে হয়। বাজেটের ২২ ভাগ যদি সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন দিতে হয় তাহলে তাদের কাছ থেকে জনগণের জন্য অনেক কিছু চাওয়ার আছে। তাদের দেশের জন্য অনেক কিছু করতে হবে,দিতে হবে। কারণ ওনাদের বেতন অনেক বেড়েছে। জনগণ তাদের কাছ থেকে কিছু আশা করে।

সরকার উন্নয়নের যে কাজগুলো করবে যেমন, ২৭ হাজার কোটি টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু করলো,১৫হাজার কোটি টাকা দিয়ে মেট্রো করলো এসব কাজে স্বচ্ছতা রাখতে হবে। কারণ জনগণের টাকা দিয়ে করা হচেছ এসব কাজ। ফলে স্বচছতা খুবই দরকার। এখানে যেন অন্য কিছু না হয়। সরকারকে চেক এ্যান্ড ব্যালেন্সের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে। জনগণের কষ্টের টাকা লুটপাট করা যাবে না।

রফিকুল আনোয়ার
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
গ্লোবাল ব্র্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড