দশ লাখ ছাড়াতে পারে রোহিঙ্গা শরণার্থী

১৯৪৮ সালে মায়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর সেদেশের পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব প্রদাকারী রোহিঙ্গারাই আজ পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। ১৯৭০ এর দশক থেকে এ যাবৎ নির্যাতনের শিকার হয়ে মায়ানমার ছেড়েছে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। যার অধিকাংশই শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে বসবাস করছে। বর্তমান সংখ্যাটি সাত লাখের বেশি হবে। তবে বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা অতি শ্রীঘ্রই তা দশ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
এছাড়া ভারত, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, থাইল্যান্ডে উল্লেখযোগ্য রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে।
গত মে মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০১২ সালের পর থেকেই ১ লাখ ৬৮ হাজার রোহিঙ্গা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের হিসাব মতে, গত বছরের অক্টোবরে সহিংসতা শুরুর পর থেকে এ বছর জুলাই পর্যন্ত শুধু বাংলাদেশেই অনুপ্রবেশ করেছে ৮৭ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী। শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক রোহিঙ্গাই সামান্য নৌকায় করে বঙ্গোপসাগর, আন্দামান সাগর পার হয়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই ঝুঁকি নিয়েছে এমন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ১২ হাজারের বেশি।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বর্তমানে ৪ লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। আর এই দফায় আগস্টের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর এ যাবৎ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল কমছে না। থামছে না বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ।
বিভিন্ন সূত্রমতে, ছয় দশক ধরে নির্যাতন ও নির্মূলের মুখে পড়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমার সরকার নতুন করে রোহিঙ্গা নিধন ও উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। গত ২৪ আগস্ট পুনরায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সে দেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশের সংঘাত শুরু হলে গত ১৬ দিনে ১ লাখ ৭৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক উইং ইউএনএইচসিআর তথ্য দিয়েছে। তবে এ সংখ্যা অন্তত আড়াই লাখ বলে দাবি করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সর্বমোট ৮ লাখেরও বেশি। সর্বশেষ নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন যারা আসছেন, তাদের কারও পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন পাওয়া গেছে। কারও গায়ে আবার পোড়া ক্ষত দেখা যাচ্ছে। গত শুক্রবার সীমান্তের ওপার থেকে যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবশে করেছে তাদের মধ্যে শতাধিক নারী-পুরুষের শরীরে এ ধরনের নির্যাতনচিহ্ন দেখা গেছে। কার্যত মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা সে দেশের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর গত ১৬ দিন ধরে যে টানা নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছেÑ তারই করুণ চিত্র তুলে ধরছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। এ বিষয়ে শুক্রবার পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা যুবক নেয়ামত উল্লাহ বলেন, ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশের লোকেরা এখন রোহিঙ্গাদের দেখামাত্রই গুলি করে মারছে। আমরা যারা বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর প্রাণ বাঁচাতে স্বজনদের নিয়ে পালিয়ে আসছিলাম তাদেরও পেছন থেকে গুলি ছুঁড়লে আমরা আহত হই। এ ছাড়া অনেককে বাড়ির ভিতরে আটকে রেখে বাইরে পেট্রল-কেরোসিন ও ছোট ছোট ককটেল বোমা ফাটিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে।’ এই নারকীয় আগুন থেকে ভাগ্যগুণে কেউ কেউ আহত হয়ে বেঁচে যান। তারাই কেবল পালিয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছেন।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে, অং সান সুচি ওই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদমান বিভক্তির সমাধানে পথ খুঁজে বের করার জন্য জাতিসংঘের সাবেক প্রধান কফি আনানের ওপর আস্থার কথা জানান। তবে সুচির এই পদক্ষেপ যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে বাড়তে থাকা সমালোচনাকে সাময়িকভাবে ঠা-া করার জন্য ছিল, বা এ বিষয়ে যতটা সম্ভব পারা যায়, চেষ্টা করে যাচ্ছেন তা বিশ্ববাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, তা বুঝতে দেরি হয়নি কারোরই। কেননা কোনো সুনির্দিষ্ট ঘটনা বা অভিযোগ ধরে তদন্ত করতে দেওয়া হয়নি কফি আনানকে। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার এখতিয়ার দেওয়া হয় তাকে। এই কমিশন গঠনের সময় অং সান সুচি নিজে বলেছিলেন, কমিশনের সুপারিশগুলো তার সরকার মেনে চলবে। এই কমিশন সরকারকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা অভিযান বন্ধ করার ও তাদের স্বাভাবিক চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পরামর্শ দেয়।
এই সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর সেটিকে স্বাগত জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই সুপারিশগুলো পরিস্থিতি সাপেক্ষে সর্বোতভাবে বাস্তবায়নের জন্য পূর্ণভাবে বিবেচনায় নেওয়া হবে। এর পরেও সরকার রাখাইন রাজ্যে সাংবাদিক, সাহায্য সংস্থার কর্মীদের চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে।
তবে আবার অং সান সুচির কার্যালয় থেকেই কিছুদিন আগেই হুঁশিয়ার করা হয়েছে যারা রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে আসবে তাদেরও সন্ত্রাসী গণ্য করা হবে।
এ বছরের জানুয়ারি ইয়াঙ্ঘি লি নামে মায়ানমারে জাতিসংঘের এক মানবাধিকার দূত বলেন, তাকে রাখাইনের বেশ কয়েকটি চিহ্নিত অঞ্চলে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। আর কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে শুধু সরকারের ঠিক করে রাখা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে।
রোহিঙ্গা গ্রামের ৭০০ বাড়িতে আগুন
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দেওয়া তথ্যমতে, মিয়ানমার থেকে পাওয়া নতুন উপগ্রহ-চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে একটি রোহিঙ্গা মুসলিম গ্রামের ৭০০-রও বেশি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
সংস্থাটি বলছে, এসব ছবি গভীরভাবে উদ্বেগজনক, এবং এতে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে রাখাইন প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে ধ্বংসলীলার মাত্রা আসলে আগে যা ভাবা হয়েছিল তার চাইতে অনেক বেশি।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং সন্দেহভাজন রোহিঙ্গা জঙ্গিদের মধ্যে সংঘর্ষের পর গত সপ্তাহে হাজার হাজার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে ঢুকেছে।
পালিয়ে আসা এই শরণার্থীরা বলছে, মিয়ানমারের সৈন্যরা তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
তবে মিয়ানমারের সরকার এ কথা অস্বীকার করেছে। সরকার বলছে, তাদের নিরাপত্তা বাহিনী গত মাসে ঘটা একটি আক্রমণের মোকাবিলা করছে – যাতে রোহিঙ্গা জঙ্গীদের হাতে ২০টি পুলিশ ফাঁড়ি আক্রান্ত হয়েছিল।

অনুপ্রবেশে স্থানীয়দের উদ্বেগ
স্থল ও নৌসীমান্ত দিয়ে গত শনিবার অন্তত ৫ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন টেকনাফ ও উখিয়ার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, কক্সবাজারের উখিয়া, রামু ও হ্নীলা, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িসহ সীমান্তবর্তী উপজেলার লোকজনকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। উখিয়ার রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, ‘উখিয়া উপজেলায় আমাদের লোকসংখ্যা আছে ৩ লাখের কাছাকাছি। তার ওপর রোহিঙ্গারা আছেন প্রায় ৫ লাখের মতো। এখানে তারাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে এখানকার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা ভাবাই যাচ্ছে না।
রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন ব্যবস্থা
বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কথা বলা হচ্ছে। তবে কাজটি কঠিন বলে মনে করছেন বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাজ করে যাওয়া নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।
নতুন-পুরনো মিলিয়ে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার কোনো তথ্যভান্ডার না থাকাটাই বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

রোহিঙ্গা শুমারির একটি প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন মনে করেন, রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিরূপণ, কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে ডেটাবেইজ তৈরি এবং রোহিঙ্গা পরিবার খুঁজে বের করাই বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের বড় তিন চ্যালেঞ্জ।
প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে চার দশক আগে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের শুরু। তারপর বিভিন্ন সময়ে অনুপ্রবেশ ঘটতে ঘটতে এই সংখ্যা ৫ লাখে দাঁড়ায়।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মুখে নতুন করে উদ্বাস্তদের ঢল নামে বাংলাদেশ পানে। নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৩ লাখের কাছে পৌঁছে গেছে বলে জাতিসংঘের হিসাব।
বাংলাদেশে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির রয়েছে তিনটি; এগুলোতে ৩০ হাজারের মতো নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে। বাকি সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম জেলা থেকে শুরু করে দেশের নানা প্রান্তে।
আশ্রয় পেতে বাংলাদেশে আসা এই রোহিঙ্গারা পরিচয় গোপন করে ভোটার হয়েছেন বলে যেমন তথ্য পাওয়া গেছে; তেমনি অনেকে পাসপোর্ট করে বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন।

উদ্বাস্তু এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে যেমন জঙ্গি তৎপরতা ও অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে বলে সরকারের ভাষ্য।
এই কারণে উদ্বেগ থেকে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধন ঠেকাতে সজাগ রয়েছে নির্বাচন কমিশন, যারা বাংলাদেশের ১০ কোটির বেশি ভোটারের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ জানান, নতুন ও পুরনো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় নিয়ে এসে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে একটি ডেটাবেইজও তৈরি করা হবে।
জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য চোখের আইরিশের ছাপ নেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশিদের জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য চোখের আইরিশের ছাপ নেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশিদের। ইসি বাংলাদেশের নাগরিকদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আগে তাদের তথ্য নিয়ে তথ্যভা-ার তৈরি করে। এরপর হাতের ১০ আঙুল ও চোখের আইরিশের ছাপ নেয়।
দেশের নাগরিকদের নিয়ে এ কারিগরি কাজটি করতে যেখানে ইসিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মিয়ানমারের এই নাগরিকদের সুশঙ্খলভাবে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনা কঠিন বলছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে আগে থেকে থাকা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে আগে থেকে থাকা রোহিঙ্গারা। ইতোমধ্যে পরিসংখ্যান বুরোর তত্ত্বাবধানে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে একটি শুমারি হয়েছে। ছবিসহ ৪৬টি তথ্য নিয়ে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের ‘ডেটাবেইজ’ তৈরি হয়েছে। তবে তাদের কোনো বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হয় নি।
সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীতে থাকা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিরূপণ করা হয় এই প্রকল্পের আওতায়।
পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল টাস্কফোর্সের অধীনে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এ প্রকল্পের শুরুতে রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিদেশি নাগরিকদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আগে কোথায়, কীভাবে, কত সংখ্যক রয়েছে তার সংখ্যা নিরূপণ; কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে ডেটাবেইজ করা ও নিবন্ধনের ডিভাইস সরবরাহ; রোহিঙ্গা সদস্যদের ফ্যামিলি ট্র্যাকিং- নিবন্ধনের এই তিনটি বড় কাজ বলেও মন্তব্য করেন কর্মকর্তারা ।
শুমারির অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আলমগীর বলেন, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের তথ্য সংগ্রহ করা সহজ হবে না। কারণ, তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি রয়েছে তথ্য দিতে। ক্যাম্পের বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কেন্দ্রে আনাটা বেশ কঠিন। আবার এদের পরিবারের সব সদস্যকে একসঙ্গে পাওয়াও দুষ্কর।
শিশুদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের জটিলতা তুলে ধরে তিনি বলেন, নয় বছরের কম বয়সীদের আঙুলের ছাপ পরে পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে চোখের আইরিশ নেওয়াটা কাজে দেবে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) তথ্য অনুযায়ী, কুতুপালং ও নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে নিবন্ধিত ৩০ হাজারসহ দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এস এম রিজুয়ান নুর হাসান গত ২৬ অগাস্ট চট্টগ্রামে এক সভায় বলেছিলেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা কোনো ধরনের সেবা নিলে বা অনুপ্রবেশের সময় তাদের ‘বায়েমেট্রিক ডেটা’ নেওয়া গেলে ভালো হয়।
অনেকে নিজেদের জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ ও অন্যান্য কাগজপত্র ভোটার হওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করছে বা ভাড়া দিচ্ছে বলেও ওই বৈঠকে জানান তিনি।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে ভুয়া জন্মসনদ ইস্যু করা বা বাবা-মা হিসেবে ভুয়া পরিচয় দাখিল বন্ধে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে একটি আধা সরকারি পত্র জারি করা হবে। এছাড়া সহযোগিতাকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক করে চিঠি পাঠানো হবে।
মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দেওয়া হয়েছে : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া গতকাল বিকালে উখিয়ার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা বস্তি পরিদর্শন শেষে বলেন, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশানুযায়ী মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আশ্রিত রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। মিয়ানমারে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
গণজাগরণ মঞ্চের মায়ানমার দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচী : মায়ানমার দূতাবাস ঘেরাওয়ের ঘোষণা দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে পূর্ব ঘোষিত র‌্যালি শেষে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার।
তিনি জানান, আগামী ১১ সেপ্টেম্বর সোমবার বেলা ৩টায় মিয়ানমার দূতাবাস ঘেরাও করা হবে।
এর আগে শাহবাগ জাদুঘরের সামনে থেকে একটি র‌্যালি শেরাটন হোটেলের মোড় ঘুরে পুনরায় জাদুঘরের সামনে এসে শেষ হয়।

র‌্যালি পূর্ব সমাবেশে ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা ও মানবিকতা এ দুটো বিষয় মাথায় রেখে সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর আহ্বান জানাই।
রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধের দাবিতে বাংলাদেশি বৌদ্ধরা
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশের মিয়ানমার দূতাবাসে স্মারকলিপি দেবেন বৌদ্ধরা। একই স্মারকলিপি ঢাকায় জাতিসংঘের স্থানীয় কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে পাঠাবেন তারা।
গত শুক্রবার ০৮ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশের সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ আয়োজিত এক মানববন্ধনে একথা জানান বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা।
এ সময় তারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা এবং বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজের মুখ্য সমন্বয়ক অশোক বড়ুয়া মানববন্ধনে বলেন, ‘বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, অহিংস নীতি ও গৌতম বুদ্ধের সর্বজীবে দয়ার অনুসারী। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি হিংসা দিয়ে কখনো হিংসার অবসান হয় না। তাই মিয়ানমার সরকার ও জনগণকে অহিংস পথে সমস্যা সমাধানের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আগামী ১০ অক্টোবর মিয়ানমার দূতাবাসে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হবে। যার অনুলিপি বাংলাদেশে জাতিসংঘের স্থানীয় কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরেও পাঠানো হবে।
তিনি জানান, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ফেলোশিপ অব বুদ্ধিস্টের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারকে এ নির্যাতন বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে চাপ দেওয়া হবে।
মানববন্ধনে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ধর্মমিত্র মহাথের, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি ডা. অসীম রঞ্জন বড়ুয়া, বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি ঢাকা অঞ্চলের সভাপতি দিলিপ চন্দ্র বড়ুয়া, আশুলিয়া বিহারের অধ্যক্ষ আসীন জীন রক্ষী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
আজকের বাজার: সালি / ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭