দেশে ঋণ খেলাপির জন্য ব্যাংকেরও দায় আছে

‘আপনারা বিসমিল্লাহ্ গ্রুপের কথা জানেন, যাদের ঋণ নিয়ে এখন অনেক কথা হচ্ছে। এখানে তাদের ঋণের সঙ্গে যে সব কার্যক্রম জড়িত, একজন এল সি খুলবে, একজন ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলবে, একজন ক্লিয়ারিং ফরওয়ার্ডিংয়ের কাজ করবে, একজন কাগজপত্র দেখে ব্যাংক থেকে টাকা ডিসবার্স করবে। অথচ তারা বিভিন্ন নামে, কখনও নিজেদের নামেই বিভিন্ন কোম্পানি খুলেছে। এভাবে কোনো আমদানি রপ্তানি না করেই, তারা শুধু কাগজ চালাচালি করে, এই টাকাগুলো নিয়ে নিল। ব্যাংক যদি দেখত যে এসব কোম্পানির অস্তিত্ব আছে কি না বা এর পরিচালক কারা কিংবা যে কোম্পানি মাস্টার এল সি করেছে তার ডিরেক্টর কারা, তাহলে দেখতে পেত যে, তারা সবাই একই লোক। এভাবেই গ্রুপটি হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বা অন্য কোনো মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার করে দিল। অর্থাৎ এতে করে জাতীয় ক্ষতি হলো। আমার জানা মতে, ব্যাংক ওইসব পরিচালককে ডেকে এনে এনে ঋণ দিত। ঋণ খেলাপি সৃষ্টিতে,বেশিরভাগ ক্ষেত্রে না হলেও উল্ল্খেযোগ্যভাবে, ব্যাংকগুলো নিজেরাই এজন্য দায়ী। কারো যদি শত কোটি টাকা থাকে, তা রক্ষা করার জন্য কিছু কৌশল তাকে নিতে হয়’— এসব কথা বলেছেন, লিগ্যাল স্টেপস বাংলাদেশ লিমিটেডের হেড অব চেম্বার, ব্যারিস্টার মোকসেদুল ইসলাম। আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন এবি টিভির সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতার সারাংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

ঋণ দেয়া-নেয়ার ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়া
আমি মনে করি যে, যারা ঋণ নিচ্ছে তাদের চাইতে যারা ঋণ দিচ্ছে তাদের দায়-দায়িত্ব বেশি। কারণ যাদের টাকার প্রয়োজন তারা তো টাকা নেবেই। কিছু মানুষ আছেন যারা বিভিন্ন ফাঁক- ফোকর খোঁজেন, কেমন করে ঋণের টাকা থেকে কিছুটা অন্য ভাবে সরিয়ে নেয়া যায়। এমন সব মানুষ সব সময়, সব কালে, সব জায়গায়, সব জাতিতেই আছেন। সুতরাং আমি মনে করি ঋণের টাকার দায় নির্ভর করে ব্যাংকের উপর। যে প্রতিষ্ঠান ঋণ দিচ্ছে তাদের উপর। তাদেরই যাচাই বাছাই করে দেখতে হবে,সবকিছু ঠিক আছে কি না। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসা দেখানোর জন্য ঋণ দিতে উদগ্রীব হয়ে থাকে। অনেক সময় মানুষকে ডেকে এনে, জোর করে, কাগজপত্র না দেখেই, ঋণ দেয়ার কথাও আমি শুনেছি। তারা মুখে মুখে সব বিশ^াস করার চেষ্টা করে। বেশিরভাগ সময় না হলেও অনেক সময় এটা বেশ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আপনারা বিসমিল্লা গ্রুপের কথা জানেন, যাদের ঋণ নিয়ে এখন অনেক কথা হচ্ছে। এখানে তাদের ঋণের সঙ্গে যে সব কার্যক্রম জড়িত, একজন এল সি খুলবে, একজন ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলবে, একজন ক্লিয়ারিং ফরওয়ার্ডিংয়ের কাজ করবে, একজন কাগজপত্র দেখে ব্যাংক থেকে টাকা ডিসবার্স করবে। তারা বিভিন্ন নামে, কখনও নিজেদের নামেই বিভিন্ন কোম্পানি খুলেছে। এভাবে কোনো আমদানি রপ্তানি না করেই তারা শুধু কাগজ চালাচালি করে এই টাকাগুলো নিয়ে নিল। ব্যাংক যদি দেখত যে এসব কোম্পানির অস্তিত্ব আছে কি না বা এর পরিচালক কারা কিংবা যে কোম্পানি মাস্টার এল সি করেছে তার ডিরেক্টর কারা, তাহলে দেখতে পেতো যে, তারা সবাই একই লোক। এভাবেই তারা হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বা অন্য কোনো মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার করে নিল। অর্থাৎ এতে করে জাতীয় ক্ষতি হলো। আমার জানা মতে, ব্যাংক ওইসব পরিচালককে ডেকে এনে এনে ঋণ দিত। ঋণ খেলাপি সৃষ্টির জন্য,বেশিরভাগ ক্ষেত্রে না হলেও উল্ল্খেযোগ্যভাবে ব্যাংকগুলো নিজেরাই এজন্য দায়ী।

কারো যদি শত কোটি টাকা থাকে, তা রক্ষা করার জন্য কিছু কৌশল তাকে নিতে হয়। অথচ ব্যাংকের আইনগত দিকটাতে মনোযোগ খুব কম। তাদের যদি পাঁচ হাজার কোটি টাকার মামলাও হয় এর কোর্ট ফি পাঁচশ’ টাকা। আবার পাঁচ টাকা হলেও কোর্ট ফি পাঁচশ’ টাকা। পাঁচ হাজার কোটি টাকা যে ঋণ খেলাপ হলো তার ফি যদি পাঁচশ’ টাকা হয়, সে সার্ভিস কী পেতে পারে ? একটা ঋণ খেলাপির মামলা বিশাল একটা মহাভারতের মতো। অনেক ধরনের জটিলতা এখানে জড়িত থাকে। তো যাকে আপনি নিয়োগ দিবেন, এই কাজটা পরিচালনা করার জন্য তাকে ৫০০-টা টাকা দিবেন, তাহলে তার কাছ থেকে আপনি কেমন করে সেবা পাবেন? প্রতিটা কেসের জন্য তাদের বিশেষ উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আইনে আছে যে, এই লিগ্যাল চার্জের ব্যাপারে তারা ক্লেইম করতে পারে। কিন্ত তারা তা না করে কোনোমতে দায়সারাভাবে একটা মামলা করে দিয়ে বসে থাকে।

আমি মনে করি সঠিক প্রক্রিয়ায় যদি মামলা পরিচালনা করা যায় তাহলে কোর্ট কিন্ত ব্যাংকের প্রতি আলাদা নজর দিয়ে কাজ করবে। তারা চেষ্টা করেন ব্যাংকের যেন ক্ষতি না হয়। কারণ ব্যাংক পাবলিক প্রোপার্টি। কিন্ত কোর্টকে তো আইন মেনে চলতে হয়। এই আইনটার ব্যত্যয় যখন ব্যাংক নিজেই করে তো কোর্টের তখন করার কিছু থাকে না। একটা মানুষ বিভিন্ন সময় যখন কোর্টে আসে তখন তার প্রটেকশন চাওয়ার তো অধিকার রয়েছে। কোর্ট তো বোঝে না তখন কার পক্ষে যাওয়া উচিত। কোর্ট আইনের বাইরে যেতে পারে না। সে আইনের মধ্যে থেকেই কাজ করে। কেউ স্টে-অর্ডার পাওয়ার হলে সে পাবে, ব্যাংক এসে তার আইনজীবীর মাধ্যমে সেটা খন্ডানোর চেষ্টা করবে। এই কাজটি ব্যাংক ঠিকভাবে করে না।

চেক জালিয়াতির ব্যাপারে
এখানে দুটো দিক রয়েছে, এক. চেকটা কে দিল ? দুই. চেকটা কে নিল ?
যদি একটা সাধারণ লোক অন্য কাউকে একটা চেক দেয় তার জন্য আমাদের দেশে পর্যাপ্ত আইন রয়েছে। এবং এর সুফল জনগণ ভোগ করছে। আবার যদি ব্যাংক কাউকে কোন চেক প্রদান করে তাহলে ব্যাংক যেটা করে তারা লোনের বিপরীতে একটা কিছু মর্টগেজ করে রাখে। লোন দিল এক কোটি এর বিপরীতে সমপরিমাণ অর্থের মটর্গেজ রাখলো। সেই এক কোটি টাকার বিপরীতে আবার ২০ লাখ টাকার পাঁচটা চেক নিল। সে তখন প্রয়োজনে সবার আগে করবে কি এই এক কোটি টাকার জন্য মামলা করে দিবে রিপোর্ট পার্টির জন্য। আবার এদিকে চেকের জন্য মামলা করে দিবে। তখন কোর্ট দেখবে যে একটা লোক যখন সিকিউরিটি চেক দিবে তার বিপরীতে মামলা করা ঠিক হচ্ছে কি হচ্ছে না। এ নিয়ে কোর্ট প্রায়ই অবজার্ভেশন দিচ্ছে। কিন্ত ব্যাংক এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে চেকের মাধ্যমে চরমভাবে হেনস্তা করে।

চেক জটিলতার সমাধান তাহলে কী
আমি যখন চেক দিলাম আবার প্রপার্টিও দিলাম । দুটো দেয়ার দরকার কী ? দ্বৈত সিকিউরিটির তো দরকার নাই। অনেক সময় ব্যাংক ডাবল সিকিউরিটি নিয়েও টাকা তুলতে পারছে না। তার দায় দায়িত্ব ব্যাংককেই নিতে হবে। কারণ ব্যাংক যখন তার লোনটা দিয়েছে তখন সে সঠিকভাবে যাচাই বাছাই করে নেয় নি। দেখা গেল একটা প্রপার্টির মূল্য পাঁচ লক্ষ টাকা, কিন্ত তার বিপরীতে ব্যাংক আপনাকে লোন দিল পাঁচ কোটি টাকা। তো কোন সমস্যা হলে ব্যাংক ঐ প্রপার্টি বিক্রি করে তো পাঁচ কোটি টাকা তুলতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক লোনের জন্য দুই ক্ষেত্রে মামলা করতে পারে। কিন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ছোটখাটো বিশেষ করে যারা ফ্ল্যাট কেনে, তাদের ফ্ল্যাটটাই বন্ধক রেখেছে। এবং এর সমপরিমাণ টাকার বিভিন্ন চেক নিয়েছে। কখনও দুটো ৫০ লাখ টাকার চেক, কখনও পাঁচটা বিশ লাখ টাকার চেক, কখনও ২৫ লাখের চারটা এভাবে এক কোটির বিপরীতে তিন কোটির চেক নিল। এর সাথে ঐ প্রপার্টিটাও বন্ধক রাখলো। এই যে দুই দিক থেকে একটা ব্যাংক মানুষকে বিপদে ফেলছে, এটা বন্ধ করা দরকার। এখানে ব্যাংকের দেখা উচিত একটা লোনের বিপরীতে যদি কেউ যথেষ্ঠ সিকিউরিটি দেয় তাহলে আর চেকের প্রয়োজন পড়ে না। আর চেক নিতে হলে চুক্তিতে সেটা উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। আর ইন্টারেস্টের টাকার জন্যও চাইলে আলাদা একটি চেক নিয়ে নেয়া যেতে পারে। তাহলে উভয়ের মধ্যে আর সমস্যা থাকে না। সুতরাং চুক্তির মধ্যেই সব কথা থাকতে হবে । চুক্তির বাইরে যাওয়া যাবে না। চুক্তির মধ্যেই সব কিছু লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। যার যে লোনই হোক না কেন চুক্তির সময় অবশ্যই একজন আইনজীবীর উপস্থিতি থাকতে হবে। সে যেন দেখে কী কী আছে চুক্তিপত্রে। দু‘পক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতিতে এটা হতে হবে। না হলে যে যত প্রভাবশালী সে সময়মতো তার প্রভাব খাটাবে। না হলে একজন তো আর এমনি এমনি লোন নেয় না । সে বিপদে পরেই লোন নিতে আসে। তখন ব্যাংকও সে সুযোগটা ভালো করে কাজে লাগায়। ব্যাংক তখন যা বলে লোকটা তখন তাতেই রাজি হয়ে যায়। কারণ লোকটার তখন টাকাটাই বেশি প্রয়োজন হয়।

তাহলে কী বুঝলাম? দু’পক্ষের মধ্যে যখন আদান-প্রদান হবে তখন তাদের আইনজীবীদের উপস্থিতিতেই তা সম্পাদন করা উচিত । তা হলে কেউই আর সমস্যার মধ্যে পড়বে বলে আমার মনে হয় না।

ঋণের জন্য বিভিন্ন আইনের ব্যাপারে আমরা কী করে জানবো: এক্ষেত্রে যে সাপোর্ট নেয়া দরকার তা খুব ব্যয়বহুল না। আপনার লোনের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়ার সব কিছু দেখে দেবে, এ রকম একজন আইনজীবীর সম্মানী হতে পারে দশ হাজার, বিশ হাজার। একটা ব্যাংকও তো এর বেশি দেয় বলে আমার জানা নেই। সুতরাং এর বেশি টাকা লাগার কথা না। বরং অনেক হেনস্তা থেকে ব্যক্তি, জাতি, প্রতিষ্ঠান বাঁচতো। যারা লোন নিচ্ছে তারা বিভিন্ন সমস্যা থেকে বাঁচতো এবং ব্যাংকের সুবিধা হতো।

ঠিক কোন ধরনের সমস্যা ফেইস করতে হয়

আমি তো এখন নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। তবে এটা বলতে পারি যথেষ্ঠ পরিমাণে মামলা মোকদ্দমা আমাদের সামলাতে হয়। কোর্টে অনেক মামলা রয়েছে এর জন্য দীর্ঘ সময় নষ্ট হচ্ছে। বছরের পর বছর মামলা জটের কারণে সমাধানের গতি ধীর হয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে একটি দুটি বেঞ্চ করা হয় যারা এসব মামলাই চালান। এ থেকে বলতে পারি কোর্টেরও অফুরন্ত সময় নষ্ট হয় কাজগুলো করার জন্য। শেষে আমার একটাই কথা, তা হলো যারা লোন নেবেন, তখন তিনি অবশ্যই একজন আইনজীবীকে উপস্থিত রাখবেন। না হলে এসব সমস্যা চলতেই থাকবে। একজন আইনজীবী থাকলে সে এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতো, সবধরনের আইনি কাগজ তৈরি করতো। যেখানে সবকিছুর উল্লেখ থাকতো। এতে নিজেরা বিপদ থেকে বাঁচতো, ব্যাংকও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারতো না। উভয়েরই উপকার হতো।

দাদন ব্যবসা বন্ধ হওয়া দরকার
দাদন ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে। মানুষের দুঃসময়ের সুযোগ কাজে লাগিয়ে মানুষকে একসময় বিপদে ফেলে দেয় এসব ব্যবসায়ীরা। এব জন্য একটা সময়ে সে টাকা সুদে আসলে পরিশোধের সময় এককালীন বিপুল পরিমাণ টাকা সুদ দিতে হয়। এটা অবশ্যই অমানবিক, বেআইনি। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

ডিড অব এগ্রিম্যান্টের বাইরে কোন কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না। তা ছাড়া দু’জনের মধ্যে এর বাইরে যদি কিছু থাকে সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আইনগত দিক দিয়ে এর বিরুদ্ধে কোন আইন আছে বলে আমার মনে হয় না। চুক্তি অনুযায়ী সময় মতো টাকা পরিশোধ না করলে চুক্তি ভঙ্গের কারণে যে কেউ কোর্টে আপিল করতে পারেন। কোর্টই তখন চুক্তি ভঙ্গের ব্যাপারে আইনের ধারা অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিবে।
সব শেষে আমি যা বলব, প্রাতিষ্ঠানিক যা কিছু করেন না কেন, অবশ্যই একজন, দুজন সাক্ষী বা প্রয়োজনে আইনজীবীকে সামনে রেখে করা উচিত। তা হলে ব্যক্তি, সমাজ , প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র সবারই উপকার হবে।

ব্যারিস্টার মোকসেদুল ইসলাম
হেড অব চেম্বার
লিগ্যাল স্টেপস বাংলাদেশ

আজকের বাজার: আরআর/ ১৬ আগস্ট ২০১৭