নগর কৃষিঃ ভাবনা ও সম্ভাবনা

মোঃ আশরাফুল আলমঃ আমার ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে। খুব কাছ থেকে পরিবেশ ও প্রকৃতি দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। আমি আমার মাকে দেখেছি এক চমৎকার কৌশলে সন্ধ্যাবেলা একঝাঁক হাঁস-মুরগি এক এক করে খুপরিতে তুলতে। দেখেছি কীভাবে মায়ের হাতে লাগানো সিমগাছটি দুই পাতা তিন পাতা করে বাড়তে বাড়তে এক সময় বারান্দা ছাপিয়ে ঘরের আঙ্গিনা ছেয়ে ফেলতে।

ক্যালেন্ডারের পাতার মত সুন্দরভাবে শীতের সকালে কুমড়া ফুল ফুটে থাকতে। বাগান ভরে লালশাকের লাল রঙ্গে রক্তিম হয়ে যাওয়া কিংবা গাছে ঝুলে থাকা কোন লাউ বা কুমড়াটি খাওয়ার উপযোগী হয়েছে তা আমাদের মায়েরা বা নানী-দাদিদের এক আশ্চর্য কায়দায় বুজে ফেলা। এই সব শিক্ষাই প্রজন্ম শিক্ষা যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে শুহুরে প্রজন্ম এই শিক্ষা পায়না বললেই চলে। ফলে শহরে বেড়ে ওঠা এইসকল শিশুদের মধ্যে প্রজন্ম শিক্ষার অভাবটা দিনদিন বেশ স্পষ্টত হয়ে উঠেছে।

আর এতে করে তারা জানতে পারছে না কোন গাছে কোন ফুল বা ফল ধরে। যে কলা কিংবা আনারশ তারা খাচ্ছে সেটি দেখতে কেমন, তারা সেটা জানেনা। কবির ভাষায় বলতে গেলে – বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু। তাদের অধিকাংশের অবসর কাটে মোবাইলে গেমস খেলে কিংবা টিভিতে কার্টুন দেখে। ফলে প্রকৃতির প্রতি তাদের ভালোবাসা বোধ তৈরি হয় না। এ জন্য তারা বাসাবাড়ি বা বিদ্যালয়ে টবে সাজিয়ে রাখা কোনো গাছের পাতা ছিঁড়তে বা ডাল ভাঙতে আনন্দ অনুভব করে।

ইট, কাঠের যান্ত্রিক শহরে তারা পায়না সত্যিকারের সোনার বাংলার আমেজ। তবে আশার কথা এই, বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শহর ও নগরে বাড়ির ছাদে বাগান করা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নানা নকশার বাড়ির ছাদের দিকে তাকালেই বিভিন্ন ধরনের বাগান দেখা যায়। অবশ্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের ছাদে যেসব বাগান দেখা যায় তার অধিকাংশই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নেয়া হলে বাড়ির ছাদে যেকোন গাছ, এমনকি শাকসবজিও ফলানো সম্ভব। আঙুর, বেদানা, ডালিম, আমড়া, পেয়ারা ইত্যাদি নান ধরনের মৌসুমী ফল ছাড়াও কলমি শাক, কলা, ডাঁটা, লাউ ইত্যাদি অনায়াসে উৎপাদনকরাযায়।

প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে বর্তমানে ঢাকা শহরে রয়েছে স্বল্পসংখ্যক সবুজায়িত এলাকা। তন্মধ্যে ৪৫টি পার্ক, ২১টি খেলার মাঠ, ৯টি কবরস্থান, চারটি সংরক্ষিত এলাকা, রেলওয়ের সংরক্ষিত এলাকা এবং রোড ডিভাইডার, যা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি মন্ত্রনালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৮৯ সালে সবুজায়িত এলাকার আয়তন ছিল ঢাকার মোট আয়তনের প্রায় ২০ শতাংশ, যা যথাক্রমে ২০০২ ও ২০১০ সালে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১৫.৫ ও ৭.৩ শতাংশ এবং বর্তমানে তা ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ঢাকা শহরে বিদ্যমান নতুন বাড়ি ২০ শতাংশ আর পুরনো বাড়ি ৮০ শতাংশ। প্লটগুলোর আকার প্রধানত দুই কাঠা থেকে ১০ কাঠা। সুতরাং প্রতিটি বাড়ির আয়তন গড়ে পাঁচ কাঠা। তন্মধ্যে গাছ লাগানোর জন্য উপযুক্ত স্থান পুরনো বাড়ির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ এবং নতুন বাড়ির ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ। ঢাকা শহরের মোট বাড়ির সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। পুরনো বাড়ি তিন লাখ ৬০ হাজার প্রায়, যার মোট আয়তন ১৮ লাখ কাঠা প্রায়। এর মধ্যে সবুজায়নের জন্য উপযুক্ত পাঁচ লাখ ৪০ হাজার কাঠা প্রায়। নতুন বাড়ি ৯০ হাজার প্রায়, মোট আয়তন ৪.৫ লাখ কাঠা প্রায়, যেখানে সবুজায়নের জন্য উপযুক্ত দুই লাখ ৭০ হাজার কাঠা প্রায়। সব মিলিয়ে সবুজায়নের জন্য উপযুক্ত মোট জমির আয়তন আট লাখ ১০ হাজার কাঠা বা ৫৮ কোটি ৩২ লাখ বর্গফুট। রাজউক অনুমোদিত নকশায় ৫০ শতাংশ জায়গা ছেড়ে বাড়ি বানাতে হয়। আর পুরনো বাড়ির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ জমি ছেড়ে বাড়ি বানানোর বিধান ছিল। সুতরাং হিসাব মতে ঢাকা শহরে বিদ্যমান সাড়ে চার লাখ বাড়ির আঙিনা থেকে প্রাপ্ত সবুজায়নের জন্য নির্ধারিত জায়গা পাঁচ লাখ ৮৫ হাজার কাঠা।

অর্থ্যাত যে পরিমান যায়গায় বাড়ি নির্মান হচ্ছে তার চাইতেও অনেক বেশি জায়গা সবুজ করা সেইসব বাড়ির ছাদ কাজে লাগিয়ে।

ঢাকা শহরে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার প্রায় অন্তত অর্ধেক প্রতিষ্ঠানে সবুজায়নের সুযোগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাদ, বারান্দা, কেন্টিন, ক্লাশরুমের কর্নার কিংবা চলাচলের প্যাসেজে গাছ লাগান সম্ভব। এছাড়াও বাড়িঘর, হাসপাতাল, ব্যাংক সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও রোড সাইড প্লান্টেশনকে এই তালিকায় আনলে সেটা যে নাতিদ্বীর্ঘ হবে সে ব্যপারে ভাবনার অবকাশ নেই! আর এতে করেই হতে পারে পরিবেশবান্ধব এক সবুজ নগরির যাত্রা।

ইদানীংকালে দেখা যায়, শখ করে অনেকেই ছাদে বাগান করেন, এখন তো এটা বলতে গেলে রীতিমত এক প্রথা শুরু হয়েছে। তবে এর পাশাপাশি এই খাতকে অর্থনৈতিক এক সম্ভাবনার খাত হিসেবে অনেকেই দেখছেন। এমন অনেকেই আছেন যারা বাড়ির ছাদে বাগান করে পরিবারের চাহিদা মেটানর পাশাপাশি বাজারে বিক্রি করে থাকেন। তবে ছাদ বাগান মানে অনেকেই মনে করেন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই নেহাত ধারনা! ছাদ বাগান করতে হলে প্রতিদিন সকাল-বিকাল গাছে পানি দিতে হবে। এছাড়াও গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে ছাদ বাগানের গাছগুলো আর দশটা মাটিতে লাগানো সাধারণ গাছের মত নয়। তাই সার কিংবা ভিটামিন দিতে হবে খুব বুজেশুনে। এক্ষেত্রে কৃষি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়া কোন কিছু প্রয়োগ একদম উচিৎহবেনা।

মাত্র ৪-৫ কাঠা জমির উপর বাড়ির ছাদে পরিকল্পিতভাবে বাগান করলে অনায়শে ৪/৫ সদস্যের পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও বছরপ্রতি প্রায় ৪০-৫০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। এই ছাদে বাগান যা একটি পরিবারকে করবে ফর্মালিন কিংবা বিষ্মুক্ত শাকসবজি প্রদান এবং এনে দতে পারে আর্থিক স্বচ্ছলতা। আর সেই সাথে আমাদের পরিবেশ হবে আরো একটু সমৃদ্ব ও সবুজ। যান্ত্রিক নগর ফিরে পাবে তার হারানো রূপ।

মোঃ আশরাফুল আলম
কাস্টমার সার্ভিস এক্সিকিউটিভ, এসিআই ফার্টিলাইজার