নতুন প্রজন্মের জন্য উন্নত পেশা ‘বীমা’

সাধারণত দুই ধরনের বীমা আছে। এটা হচ্ছে লাইফ এবং নন্ লাইফ। সাধারণ বীমাটাকেই আমরা বলি নন্ লাইফ। লাইফের সাথে এটার কোনো সম্পর্ক নাই। বাংলাদেশে এখন লাইফ এবং নন্ লাইফ মিলে মোট ইন্সুরেন্স সংখ্যা হচ্ছে ৭৮টি। এর মধ্যে ৪৬টি হচ্ছে নন্ লাইফ, আর ৩২টি লাইফ ইন্সুরেন্স।

বীমা খাতের পরিধি: এখন যদি দেখতে যাই ইন্সুরেন্সের এরিয়া, তাহলে দেখবো, বেশিরভাগ মানুষ লাইফ আর নন্ লাইফকে গুলিয়ে ফেলে। আলাদা করতে পারে না, কোনটা লাইফ আর কোনটা নন্ লাইফ। লাইফ এবং নন্ লাইফের মধ্যে বিরাট একটা ফারাক আছে। নন্ লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি হচ্ছে, যেটা জেনারেল ইন্সুরেন্স, সেটা। মুলতঃ আমাদের দেশের জন্য এটা ব্যাধতামূলক। এটাকে এজন্য ব্যাধতামূলক বলবো, একটা গাড়ি রাস্তায় নামাতে হলে তার ইন্সুরেন্স লাগবে। কাভারেজ বা মোটর সার্টিফিকেট লাগে। তা নাহলে ট্রাফিক পুলিশ ধরবে। আমরা যখন এলসি করি, তখন কাভারনোট দরকার হয়। মেরিন পলিসি দরকার হয়, তা নাহলে এলসি ওপেন হবে না। আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত, যে একটা এলসি করতে গেলে প্রথমেই তার মেরিন কাভারেজ লাগবে। যখন আমরা কোনো মালামাল বা গুড্স নিয়ে আসবো, সেটা যা-ই হোক কার্গোতে আনি আর এয়ারে আনি, সেটার একটা রিস্ক ফ্যাক্টর আছে। সমুদ্র দিয়ে তো জাহাজগুলো আসে। এটাতে যে কোনো সময় ক্ষতি হতে পারে। জাহাজ ডুবে যেতে পারে। যে কোনো কারণে আমার ম্যাটেরিয়াল নষ্ট হতে পারে। ধরুন, আমি একজন ব্যবসায়ী। আমি কোটি কোটি টাকার মালামাল আনতেছি। কিন্তু আমি যে কোনো ধরণের একটা রিস্কে পড়লে, আমার মাল নষ্ট হলে, আমি পথের ফকির হয়ে যেতে পারি। কে নেবে এটার দায়-দায়িত্ব? এটার যে রিস্ক কাভারেজ দরকার, সে জন্যই ইন্সুরেন্সের ব্যাপারটা আসছে। যাতে এই মালে যদি কোনো ক্ষতি হয়, কোনো কিছু নষ্ট হয়, যদি লোকশান হয়, ডেমারেজ হয়, এনি টাইপস অব লস, ইন্সুরেন্স কোম্পানি সেই লস বা ক্ষতি পূরনের জন্য সব সময় পাশে তার থাকে। সার্পোট দিয়ে যায়। এই জন্যই ইন্সুরেন্সের একটা গুরুত্ব আছে। ইন্টারন্যাশনালি এটা গুরুত্ব পেয়েছে।

ক্লেইম না দেয়ার অভিযোগ: ক্লেইম দেয় না এমন অভিযোগ প্রায়ই লাইফ ইন্সুরেন্সের ক্ষেত্রে ঘটে। এটার কিছুটা টেকনিক্যাল ব্যাপারও আছে। যেমন ধরুন, এক জন লোক মারা গেলে কিছু ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়। সাকসেশন সার্টিফিকেট, ডেথ সার্টিফিকেটসহ অনেক কিছু দিতে হয়। পলিসি সার্টিফিকেট, পলিসি, দীর্ঘ মেয়াদি পলিসি আছে, তার পলিসির কপি। এইসব কাগজপত্র হয়তো ঠিকমত ইন্সুরেন্স কোম্পানিকে সরবরাহ করা গেল না। সাকসেশন সার্টিফিকেট নিয়ে একটা ঝামেলা হতে পারে। কে পাবে এই টাকাটা, কে যাবে, কে নিয়ে আসবে ইত্যাদি নানা রকম জটিলতার বিয়ষ রয়েছে। এ গেলো লাইফ ইন্সুরেন্সের ক্ষেত্রে। তবে লাইফ ইন্সুরেন্সের ক্ষেত্রে ক্লেইম পাওয়ারই কথা, না পাওয়ার কিন্তু কোনো কারণ নাই।
জেনারেল ইন্সুরেন্সের ক্ষেত্রে হচ্ছে কি, এখানে যারা রিইন্সুরেন্স করে, তাদের পক্ষে ক্লেইমটা দিয়ে দেওয়া খুব সহজ। ধরুন, আমি দশ কোটি টাকার ইন্সুরেন্স কাভারেজ দিয়েছি। আমি আমার ঘাড়ে রাখছি মাত্র ৫০লাখ বা ১ কোটি টাকা। বাকী ৯ কোটি টাকা আমি বাহিরে বা সাধারন বীমায় যেখানেই হোক রিইন্সুরেন্স করছি। যদি ক্ষতি হয়, তাহলে ্ওই ৯ কোটি টাকা কিন্তু সাধারন বীমা বা বাহিরের রিইন্সুরেন্স কোম্পানি থেকে এটা রিকোভারি করতে পারবো। সুতরাং এই টাকাটা নিয়ে আমার গ্রহককে দিতে পারবো সহজে। এতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। এখন কথা হলো যে, কোনো কোনো কেম্পানি রিইন্সুরেন্স বাদ দেওয়ার চেষ্টা করে, যাতে এই টাকাটা তাদের খরচ না হয়। এটার একটা কারণ আছে, এখন ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলোর যে পরিস্থিতি দাড়িয়েছে, এখানে কমিশনের একটা ব্যাপার আছে। এই কমিশনের ব্যাপারটা নিয়ে আনহেলদি প্রতিযোগিতা আছে আমাদের দেশে।

আনহেলদি প্রতিযোগিতা: আমাদের দেশের ইন্সুরেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী আমরা ১৫শতাংশ কমিশন নিতে পারি বা অনুমোদিত। কিন্তু আমাদের খাতের ব্যবসাটা এখন এতই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গেছে যে, আমরা এই ১৫শতাংশ কমিশন দিয়ে কাঙ্খিত আর্নিং পাচ্ছি না। বিজনেস পাবার জন্য বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ এমনকি ষাট শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে হচ্ছে। এটাকেই আনহেলদি প্রতিযোগিতা বলছি আমি। এটার জন্য আমার মনে হয় থার্ড জেনারেশন, ফোর্থ জেনারেশনের কোম্পানিগুলো বেশি দায়ী। কারণ, প্রথম জেনারেশনের যেসব ইন্সুরেন্স কেম্পানি গুলো আছে, তাদের ফান্ড অনেক আছে, ক্লেইম দেওয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু তৃতীয়, চতুর্থ জেনারেশনের কোম্পানিগুলোর ফান্ডটা এত বেশি হয় নাই। এই সময় তাদের যদি ক্লেইম আসে, তাদের সেটা মিট আপ করার সক্ষমতা হয় নাই।

বীমাখাতে চ্যালেঞ্জ: এখন বীমা খাতের জন্য চ্যালেঞ্জের জায়গা হচ্ছে মুলতঃ, আমাদের যে রেগুলেটারি বডি আছে, ‘ইন্সুরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটি-আইডিআরএ’ এটাকে খব শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে তাদের সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছে এবং সেখান থেকে কন্ট্রোল করছে। আমার মনে হয়, আইডিআরএ’র এমন একটা সফ্টওয়্যার তৈরি করা উচিৎ, যেন সবগুলো বীমা কোম্পানি বাধ্যতামুলক ওই সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে। প্রত্যেকটা ইন্সুরেন্স কেম্পানির সাথে সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে যেন আইডিআরএ’র লিংক থাকে। আইডিআরএ যেন নিজ জায়গায় বসে টোটাল ইন্সুরেন্স সেক্টরটাকে কন্ট্রোল করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, এই কমিশন জিনিষটাকে উঠিয়ে দেওয়া উচিত। কমিশন পাবে একমাত্র যারা এজেন্ট, হাউজ আছে যাদের। কমিশন এজেন্ট হাউজ আছে যাদের। অন্যান্য দেশের সাথে যদি

আমি তুলনা করি, অন্য দেশে কমিশন আছে, কিন্তু তারা বিজনেস করে এজেন্ট হাউজের মাধ্যমে। না কোনো ডেভেলপমেন্ট অফিসার, না কোনো মার্কেটিং অফিসার, বাহিরেএই ধরণের কোনো পদও নাই, এই ধরণের কোনো জবও নাই। কিন্তু আমরা এজেন্ট এর কাছে না গিয়ে, এজেন্ট হাউজে না গিয়ে, আমরা এরকম পদ সৃষ্টি করছি এবং সেসব পদে নিয়োগ দিচ্ছি। নিয়োগ দিয়ে এই আনহেলদি প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করছি। আর এই আনহেলদি প্রতিযোগিতা বলতে শুধু কমিশন, আনহেলদি পেমেন্ট। এই জিনিসটা তৈরি হয়ছে এবং এটাকে পুরোপুরি বিলুপ্ত করা উচিত। এটা যদি বিলুপ্ত করা যায়, তাহলে আমাদের ইন্সুরেন্স কেম্পানিগুলোর ফান্ডটা বাড়বে, গ্রোথ হবে এবং আমাদের ক্লেইম দেওয়ার সক্ষমতা অনেক বাড়বে।

আকর্ষণীয় চাকরি হবে এই খাতে: আমাদের যে স্টাফ আছে, আমরা বলছি যে ব্যাংকের মতো আমাদের এই খাতে চাকরিটা লুকরেটিভ না। কিন্তু কেন না? আমার মনে হয়, ইন্সুরেন্সে যারা আসবে, যারা এখানে চাকরি করবে, ব্যাংকের থেকে অনেক লুকরেটিভ হবে এ খাত। যদি আমার ফান্ডটা পর্যাপ্ত থাকে, তার বেতন ভালো থাকে। তাদের ট্রেনিং দিতে পারি আমরা। তাদেরকে আরো বেশি বোনাস দিতে পারি, ইনসেন্টিভ দিতে পারি। এই ধরণের যদি সুযোগসুবিধা থাকে তাহলে, অনেক,বেশি লুকরেটিভ জব হবে এই খাত।

পেশা হিসেবে ইন্সুরেন্স: পেশা হিসাবে ইন্সুরেন্স সেক্টরটা অনেক বড়। জেনারেল ইন্সুরেন্স সেক্টরটা অনেক বড় টেকনিক্যাল সাইড। এটার ভিতরে এতো সুন্দর জিনিস আছে যে, আমরা বাইরে থেকে বুঝতেই পারি না এর মধ্যে কি আছে। এয়ার ইন্সুরেন্স, কার্গো, জাহাজ, মটর, ফায়ার এই ইন্সুরেন্সগুলোর আমরা রিস্ক কভারেজটা কিভাবে দেই। এই যে টেকনিক্যাল সাইডগুলো যে আছে। প্রত্যেকটা ইন্সুরেন্স ক্লাশের মধ্যে অনেক জিনিস আছে, যা অন্য কোনো পেশার মধ্যে নাই। সুতরাং এইগুলোকে ডেভেলপ করতে পারি আমরা। টেনিং দিয়েএইগুলোতে যদি ম্যানপাওয়ার বাড়াতে পারি আমরা। তাহলে সত্যই এটা একটা লুকরেটিভ জব হবে।

এতদিন এই খাতে পড়াশুনা করার তেমন সুযোগ ছিল না আমার মনে হয়। এখন কিছুটা সরকার থেকে অনুমোদন আসছে। অ্যাকচুয়ারি নামে একটা সাবজেক্টও খুলেছে ইউনির্ভাসিটিতে, যেটা লাইফ ইন্সুরেন্সের জন্য খুব দরকার। বাংলাদেশে খুবই অভাব এই অ্যাকচুয়ারির। এই সাবজেক্টটা সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন চালু করছে। এখানে অনেক ছাত্র ছাত্রী বেশ আগ্রহ নিয়ে আসতেছে। আমিতো সব সময় বলি, যারা নতুন প্রজন্ম যারা শিখতে আগ্রহী, বিশেষ করে ইন্সুরেন্স শিখতে আগ্রহী, তাদের আসা উচিত এবং তারা এলে, ইন্সুরেন্স সেক্টর আসলেই আরো সমৃদ্ধ হবে, ভালো হবে।

ইন্সুরেন্স যে পেশা এটার মধ্যে অনেক টেকনিক্যাল সাইড আছে, অনেক দিক আছে, এখানে যদি আমরা নিজেদেরকে ইকুইপ্ট করতে পারি, তাহলে অনেক উন্নত পেশাদার হওয়া যাবে। আপনি হয়তো জানেন, বিদেশে যারা ইন্সুরেন্সে চাকরি করে, তারা সব চাইতে বেশি সম্মান পায়। আমি একজন ইন্সুরেন্স চাকরি করি, এমন কথা বলতে তারা স্বাছন্দ বোধ করে। আমাদের এখানে উলটা হয়। তারা কিভাবে এতো লুকরেটিভ এবং এতো সম্মান পায়, এতো রেসপেক্ট পায়, যারা ইন্সুরেন্সে চাকরি করে। আসলে সেই ধারাগুলোকে ফলো করা উচিত। আমি একজন ভালো আন্ডার রাইটার। আমি শুধু বাংলাদেশে না, সারা বিশ্বে আমি গ্রহণযোগ্যা হবো। ইন্সুরেন্সে যে হায়ার ডিগ্রিগুলো আছে, যেমন জেনারেল ইন্সুরেন্সের জন্য আছে এসিআই,লাইফের জন্য আছে অ্যাকচুয়ারি, এগুলোর হিউজ বেতন। এগুলো যদি আমরা পাশ করতে পারি, আমাদের এপেশাতে তাহলে অনেক সম্মান পাবো। এসিআই যদি পাশ করা যায়, এসিআই’র সার্টিফিকেট আসে লন্ডন থেকে। অ্যাকচুয়ারিও বাইরের সিলেবাসে পড়া। এই ধরণের সার্টিফিকেট যদি আমরা অর্জন করতে পারি, অনেক অনেক টাকা বেতন আছে। বর্তমান অনেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চাইতে বেশি বেতন পান একজন অ্যাকচুয়ারি ডিগ্রিধারী। আমি যদি একজন ভালো বীমাকারী হতে পারি, আমি যদি ভালো আন্ডাররাইটার হতে পারি, আমি যদি ভালো মার্কেটিং করতে পারি, তাহলে অবশ্যই ব্যাংকের থেকে ইন্সুরেন্সের জব অনেক অনেক ভালো।

মো. শফিকুল ইসলাম
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিএফও
প্রগতি ইন্সুরেন্স লিমিটেড