আনট্যাক্সড টাকা পাচার রোধ করতে হবে: মাহবুব এইচ মজুমদার

বাজেট উপলক্ষে সমস্ত ক্যাপিটাল মার্কেটেই একটা আশা থাকে। প্রত্যেকটা অ্যাঙ্গেল থেকে, মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে তারা একটা প্রপোজাল দেয়, স্টক এক্সচেঞ্জগুলো একরকম প্রপোজাল দেয় আরও অন্যান্য সবাই তাদের মতো করে প্রপোজাল দেয়। যেহেতু সবাই তাদের মতো করে একটা প্রপোজাল দেয়, এই কারণে বাজেট নিয়ে একটু বেশি আলাপ-আলোচনা হয় এবং মানুষের ভিতরে একটা প্রত্যাশা বাড়ে। আর সেই প্রত্যাশাকে কেন্দ্র করে দেখা যায় যে, মার্কেট অনেক সময় আপ হয়, ডাউন হয়, মানে উত্থান-পতন হয়। আসলে বাজেট নিয়ে মানুষের যে পরিমাণে প্রত্যাশা ছিলো, সেই পরিমাণে প্রতিফলন আসে নাই বাজেটে। প্রথমত, মানুষের প্রত্যাশা যেগুলো ছিলো, সেগুলো সবগুলো যে সংখ্যাত্বক ছিলো তা নয়, নীতিগত কিছু পরিবর্তন ছিলো। সেই নীতিগত যে পরিবর্তনগুলো বা অন্যান্য যে পরিবর্তনগুলো, সেগুলোর তেমন কোনো প্রভাব বাজারে আসেনি। তথাপি যা এসেছে, সেটাও খারাপ বলা যাবে না। কিছু না কিছু বাজেটে তো আসছেই। যেমন : সাবসিডি, কিছু কিছু ট্যাক্স মওকুফের ব্যাপার এসেছে, যেগুলো খারাপ আসেনি বলা যাবে। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা ছিলো আরও অনেক বেশি।

অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি
আমাদের দেশে বাজেট নিয়ে যেমন বিশাল একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়, মানুষের মধ্যে একটা আগ্রহ জমে, অন্যান্য দেশে পুঁজিবাজারগুলো আলাদাভাবে পরিচালিত হওয়াতে অনেক ম্যাচিউর্ড হওয়ার কারণে ওই সকল দেশে আসলে বাজেটের সাথে মানুষের যে প্রত্যাশা বা প্রস্তাবনা বলেন, এই এত বড় পার্থক্য বা উত্থান-পতনের কোনো ঘটনা ঘটে না। কারণ বাজেট নিয়ে এগুলো থাকে না, অনেক ম্যাচিউর্ড হয়ে গেছে ওদের দেশের মার্কেটটা। তাই ওদের দেশে এমন কোনো প্রতিফলন হয় না।

মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রস্তাবনার বাস্তবায়ন
আমাদের মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে আমরা মূলত ছয় দফা প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম বিভিন্ন ব্যাপারে। যেমন একটা ছিলো আনট্যাক্স মানিগুলোকে ক্যাপিটাল মার্কেটে আনার ব্যাপারে, মার্জিন অ্যাকাউন্টের উপরে যে আন-নেসেসারি ট্যাক্স বার্ডেন আসে সেটা করা, লিস্টেড কোম্পানীর আমরা ১৫% ট্যাক্স ইনসেনটিভ চেয়েছিলাম। আর প্রত্যেকটা ক্যাপিটাল মার্কেটে ইন্টারমিডিয়েট যে সিন ট্যাক্স রেট চেয়েছিলাম, ক্যাপিটাল মার্কেটে যে গেইন ট্যাক্স, সেই গেইন ট্যাক্সটাকে কমানোর জন্য বলেছিলাম কিছুটা, ডিসকাউন্টেড ভ্যাট চেয়েছিলাম লিস্টেড কোম্পানীগুলোর জন্য। কারণ লিস্টেড কোম্পানী যে পরিমাণ ট্যাক্স দেয়, বাজারে টেক্সটাইলের যে লিস্টেড কোম্পানী আছে, ৪৮টা যে লিস্টেড কোম্পানী আছে, আর যে নন লিস্টেড কোম্পানী আছে কয়েকশো। এই কয়েকশো কোম্পানী যে ট্যাক্স দেয়, আর ৪৮টা কোম্পানী যে ট্যাক্স দেয় তাদের ট্যাক্স পরিশোধের যে প্রপোরশন রেট সেটা অনেক বেশি।

লিস্টেড কোম্পানীর ক্ষেত্রে ওদের আইন-কানুন ও স্বচ্ছতা অনেক ভালো থাকে। ওদের ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার কোনো ব্যবস্থা এখানে নাই। ট্যাক্স অ্যাভয়েড করতে পারবে না আইনের কারণে। কিন্তু ননলিস্টেড কোম্পানীগুলোতে এই সুযোগটা থেকে যায়। সেজন্য আমরা একটা ট্যাক্স/ভ্যাট ডিফারেন্সিয়েট রেট চেয়েছিলাম, বা ট্যাক্স রেটটা ননলিস্টেড কোম্পানীর চেয়ে লিস্টেড কোম্পানীর ডিফারেন্সটা ১৫% আমরা আপীল করেছিলাম, যেন এটা ১৫% হয়। বর্তমানে এটা ১০% আছে। এটা করলে সরকারের বরঞ্চ ট্যাক্স কালেকশন বাড়তো, কারণ যেগুলো ননলিস্টেড কোম্পানী সেগুলো ট্যাক্সের কারণে লিস্টেড হতে চাইতো। আরেকটা  বিষয় আমরা চেয়েছিলাম যে, কালো টাকা বা আনট্যাক্সড মানি যেটা বাইরে চলে যাচ্ছে, যখন নাকি টাকাটা করহীন হচ্ছে বা কালো টাকা হয়ে যাচ্ছে, যাতে না হয়,  শুরুর পয়েন্টেই আপনাকে আটকাতে হবে টাকাটা। একবার যখন এটা কালো হয়ে যায়, তখন যাতে এটা  আবার দেশের বাইরে চলে না যায়; অ্যাটলিস্ট দেশের মূল প্রবাহতে যেন থাকে, অর্থনীতিতে যেন থাকে, সেই ব্যবস্থা করা দরকার। কারণ এটা একবার তো করহীন হলো বা কালো টাকা হলো বা আনডিক্লেয়ার্ড মানি হলো। এটা যদি এর পরে দেশ থেকে বের করে দেয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করি, সেটা তো আরেকটা অন্যায় করা হচ্ছে। এই টাকাটা দেশের মূল অর্থনীতিতে কীভাবে নিয়ে আসা যায়? আমরা কখনোই কালো টাকার পক্ষে না, কখনোই আনট্যাক্সড মানির পক্ষে না। আমরা সবসময়ই এটার বিরুদ্ধে বলে যাচ্ছি, যেন  কালো টাকা না হয়, আনট্যাক্স মানি যাতে না হয়, সেটা আমরা চাচ্ছি। কিন্তু আবার আমরা চাচ্ছি, একবার এটা কালো টাকা হয়ে গেল বা আনডিক্লেয়ার্ড মানি হয়ে গেল, সেটা যেন আবার বাইরে চলে না যায়, সেই রাস্তাটা বন্ধ করা। এই রাস্তাটা আপনি জোর জুলুম করে করতে পারবেন না, আপনাকে সেই টাকাটা ইনভেস্ট করার পথ করে দিতে হবে। সাময়িকভাবে মনে হতে পারে, তাহলে কি আমি অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছি? মোটেই না। আপনি আরেকটা অন্যায় প্রতিহত করছেন, যাতে বাইরে টাকাটা চলে না যায়। আমরা পত্রিকা খুললেই দেখি হাজার হাজার কোটি টাকা এই গরীব দেশ থেকে চলে যাচ্ছে বিদেশে। তো সেটা ঠেকানোর জন্য যে ব্যবস্থা করতে হবে, আপনি ক্যাপিটাল মার্কেটে অ্যাট লিস্ট প্রাইমারী মার্কেটে টাকা যদি ইনভেস্ট করা হয়, সেটা কোশ্চেন হবে না বা সেটা কোনো একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ট্যাক্স দিয়ে প্রাইমারী মার্কেটে যাতে বিনিয়োগ করা যায়। হ্যাঁ, সেকেন্ডারী মার্কেটে বিনিয়োগ করলে অনেকের প্রশ্ন থাকে যে, আন-নেসেসারি মার্কেট বুম হয়ে যেতে পারে, আসলে কোনো সম্ভাবনাই নাই। তারপরও যদি সরকার মনে করে যে, সেফ সাইডে থাকার জন্য প্রাইমারী মার্কেটে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ট্যাক্স দিয়ে বিনিয়োগ করলে এই টাকার উৎস খোঁজা হবে না, এরকম একটা আসা উচিত ছিলো। যদি আপনি ভালো ভাবে অনুধাবন করেন, ম্যাক্রো লেভেলে গিয়ে অ্যানালাইসিস করেন, আমরা যারা ফিল্ড লেভেলে কাজ করছি, যেটা দেখছি, এগুলো যদি অনুসন্ধান করেন, সবাই এটার পইে বলবে। আসলে এটা কালো টাকার পে বলা না, কালো টাকাটা যাতে দেশের বাইরে না চলে যায় সেটার জন্য এটা চাচ্ছিলাম, কিন্তু এটা বাজেটে আসে নাই, দুঃখজনক বলতে হবে।

ট্যাক্স কমালে সরকারি খাত পূরণের বিকল্প
আমরা আসলে ট্যাক্স রেট এবং ট্যাক্স সিস্টেম এর কিছু পরিবর্তনের কোথা বলছিলাম। সিস্টেম পরিবর্তন করা হোক যাতে কালেকশন বেশি হয়। ট্যাক্স রেট কমানোর উদ্দেশ্য হল যাতে মানুষ ট্যাক্স বেশি দিতে পারে। কোন কোন েেত্র কয়েক ধাপে ট্যাক্স নেয়া হতছে। যেমন- ওলটারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফাণ্ড নামে আইন পাস হয়েছে।এখানে চার ধাপে ট্যাক্স হটছে-কোন একটি ফা- এর আন্ডারে অনেকগুলো কম্পানি ইনভেস্ট করে তাহলে কোম্পানিগুলোতে ট্যাক্স হয়, ফাণ্ডের ট্যাক্স হয়, ফাণ্ড ম্যানেজারের ট্যাক্স হয়, ডিভিডেনড দেওয়ার সময় ট্যাক্স দিতে হয়। আমারা এই লেভেলগুলকে কমাতে বলছিলাম। কারণ এই লেভেলগুলোকে যদি কমানো না হয় তাহলে দেশের টাকা দেশে থাকবে না বাইরে চলে যাবে। অপ্রয়োজনীয় বিলাসবহুল পণ্য, তামাক, এলকোহল এসকল পণ্যের দাম অন্যান্য দেশের চেয়ে আমদের দেশে অনেক কম তার কারণ এইগুলর ট্যাক্স কম। যা জনস্বার্থে আসে না। পরবর্তীতে জনসাস্থ থাতে সরকারকে বিনিয়োগ করতে হয়। তাহলে কেননা এই খাতে ২০০-৫০০% ভ্যাট বাড়ান কিন্তু অনন্যাও প্রয়োজনীয় জিনিস এর প্রতি ঘুরে ফিরে নজর কেন পড়ছে।

সেকেন্ডারি ক্যাপিটাল মার্কেটকের মূলায়ন
বর্তমানে সেকেন্ডারি ক্যাপিটাল মার্কেট বার বার হোচট খাচ্ছে। আসলে শুধু সিকুরিটিস এক্সচ্যানজ কমিসন, ডিএসসি,সিএসসি নয় অ্ন্য  রেগুলাটরদের অনেক কাজ আছে। যেমন- সেন্ট্রাল ব্যাংক, এনবিআর যদি এতাকে দেশের অর্থনীতির অংশ, প্রোডাকটিভ খাত মনে না করেন ও সমর্থন না করেন তাহলে বার বার পুঁজি বাজার হোঁচট খাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এর যে আচরণ তা কোন ভাবেই পুজিবাজার বান্ধব নয় তাই তাদের এই আচরণ যদি পরিবর্তন না হয় তাহলে পুজিবাজারের ঘুরে দারাতে অনেক কস্ট হবে।

প্রাইমারী ক্যাপিটাল মার্কেটের মূলায়ন
আমাদের দেশের প্রাইমারী ক্যাপিটাল মার্কেট ছোট একে অনেক বড় করতে হবে। যতদিন যাচ্ছে প্রাইমারি ক্যাপিটাল মার্কেট ছোট হচ্ছে। ২০১০ সালে জিডিপি ও মার্কেট ক্যাপিটালের অনুপাত ছিল ৫০%  কিন্তু সাত বছর পর তার উন্নতি না হয়ে কমে ১৮% হয়েছে। যদি অনন্যা দেশের কথা বলি যেমন ভারতের জিডিপি ও মার্কেট ক্যাপিটালের অনুপাত ১৪০%।

বিনিয়োগকারীদের প্রতি
বিনিয়োগকারী যারা আসেন তারা প্রথমত আপনাদের সেভিংস থেকে বিনিয়োগ করবেন। লোন করে বা কারো কাছে থেকে টাকা ধার করে বিনিয়োগ করা যাবে না। বিনিয়োগের যে অর্থ তার পুরাটুকু না করে একটা অংশ বিনিয়োগ করা। বিনিয়োগের সময় কোম্পানির গত ২-৫ বছরের ডিভিডেনড রেট খেয়াল রাখা। প্রথম পর্যায়ে খেয়াল রাখতে হবে যে কম্পানিতে বিনিয়োগ করা হতছে তার ডিভিডেনড দেয়ার সমতা আছে কিনা, দ্বিতীয়ত ক্যাপিটাল গেইন এর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে আর যে কম্পানিতে বিনিয়োগ করা হতছে সেখানকার এনটারপ্রিনিওরা কেমন তার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

মাহবুব এইচ মজুমদার
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেড