পুরনো আইনের জটিলতাই বিনিয়োগে বড় বাধা

মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বহু বছর ধরে কাজ করছেন। বিদেশি কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে কাছ থেকে অনুধাবন করেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনোভাব। হয়েছেন একাধিক ফরেন চেম্বারের চৌকস নেতা। অভিজ্ঞতার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরতে পরতে। তিনি ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-এফআইসিসিআই ও আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ-এ্যামচেম-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট সৈয়দ এরশাদ আহমেদ। কয়েকদিন আগে খোলামেলা কথা বলেছেন আজকের বাজার-এবিটিভির সঙ্গে। বিনিয়োগ, ব্যবসা বাণিজ্যের নানাদিক বিশ্লেষণ করেছেন। অনুলিখন আকারে সেসব আলোচনার কিছু অংশ আজকের বাজার-এর পাঠকদের জন্য ছাপা হলো

আসলে বাংলাদেশে অনেক সুযোগ আছে, আমি পজিটিভ মানুষ। আমি সব সময় বলি সুযোগ আমাদের অফুরন্ত কিন্তু সুযোগটাকে আমরা ঠিক মত গ্র্যাব করতে পারছি না, মানে আমরা সুযোগের সদ্বব্যবহার করতে পারছি না। এটি করতে না পারার অনেকগুলো কারণ আছে। এক নম্বর হচ্ছে- আমাদের কিছু পুরনো আইন। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা যতই বলি না কেন আমাদের দেশে বিজনেসের উপযুক্ত আইন আছে; হ্যাঁ আছে, কিন্তু কিছু পুরনো আইনের জটিলতার কারণে এই আইনগুলো ঠিক মত ইমপ্লিমেন্ট করা যাচ্ছে না। আমি একটা উদাহরণ দেই- আমাদের যে লিগ্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার, এটা খুবই ক্রিটিক্যাল। কেন এটা ক্রিটিক্যাল, কারণ একটা ব্যবসাকে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা মিলে মনিটর করে।

সাপোজ, আমি যদি একটা সিম্পল বিজনেসের কথা বলি, আপনি দেখবেন যে উদ্যোক্তাদের প্রথমে যেতে হচ্ছে জয়েন্ট স্টকে, এরপর ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশের ছাড়পত্র, যদি সেটা সেই ধরণের কো¤পানি হয়। যদি না হয় তাহলে বিজনেস রিলেটেড পারমিশন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যেমন এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, এটা সেটা। এরপরও আপনি দেখবেন যে আরও কিছু বিষয় আছে সেটা হচ্ছে, আপনি যদি আইটিতে শক্তিশালী হন- আইটি ইকুইপমেন্ট যদি রাখেন, সার্ভার রাখেন তাহলে আপনাকে টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি অথরিটির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। আরও বিভিন্ন জায়গা থেকে, এই যেমন- পোর্ট অথরিটির পারমিশন, যোগাযোগ মন্ত্রাণালয়ের পারমিশন লাগবে। এতটাই বেশি ক্রিটিক্যাল আমাদের লিগ্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার।

আমার মনে হয়, আমাদের সরকারের উপস্থিতিটা বিভিন্ন আরগানাইজেশনে অনেক বেশি। এরা যদি ফ্যাসিলিটেটর হত তাহলে কিন্তু সহজ হত। যেমন, সিটি কর্পোরেশন কিন্তু ফ্যাসিলিটেটর। আমরা দেখছি সিটি কর্পোরেশন অনেক ইজি হয়ে আসছে, এখন তারা বুঝতে পেরেছে তাদের রোলটা কি হওয়া উচিৎ। কিন্তু এখনও পর্যন্ত অনেক আরগানাইজেশন আছে যেমন, ডেসা। তাদের কিন্তু মানসিকতায় পরিবর্তন আসেনি। তারা পটপট করে প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক লাইন কেটে দিচ্ছে। অথচ তারা ঠিকমত সার্ভিস দিতে পারছে না। হয়তো তারা তাদের দিক থেকে ঠিক আছে। গ্যাস লাইনের একই অবস্থা, পুকুর চুরি হচ্ছে একদিকে আর অন্যদিকে কিন্তু তারা ব্যবসার পরিবেশ বজায় রাখতে পারছে না। তারা ব্যবসায়ীদেরকে হ্যারাজমেন্ট করছে। তো এই জিনিসগুলো কিন্তু রয়ে গেছে। এদের  যদি পুরোপুরি অটোনমি করে বা প্রাইভেটাইজ করে ক¤িপটিশন আনা যেত তাহলে হয় তো সার্ভিসটা একটু বেটার হত। সরকারের ব্যুরোক্রেসি হয়তো একটু কমতো। রেভিনিউ কালেকশন ডিপার্টমেন্ট সরকারের হাতে আছে থাকুক, হোম মিনিস্ট্রি সরকারের হাতে আছে থাকুক, এগুলো থাকা দরকার। কিন্তু এর বাইরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ কিছু এজেন্সি আছে, এগুলোকে যদি ফ্যাসিলিটের হিসেবে রিপ্লেস করতে পারত তাহলে অনেক ভাল হত।

বেসরকারিকরণ বা প্রাইভেটাইজেশন

শতভাগ বেসরকারি না করে এগুলোকে পুরোপুরি অটোনমি করে দিয়ে একটা একাউন্টিবিলিটির মধ্যে নিয়ে আসা । যেমন এরা কতগুলো অনুমতি দিল, কেন দিচ্ছে না, কী সমস্যা আছে এগুলো যদি অটোমেশন করা যায়, মনিটর করা যায় তাহলে কিন্তু ইজি হবে। অটোমেশনটা কিন্তু আমাদের বাড়ানো দরকার। কাস্টমসে দেখা যাচ্ছে ফাইলের পর ফাইল জমা হচ্ছে, ক্লিয়ার হচ্ছে না। বিমান বন্দরে মালামাল খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে, এটা তো ঠিক না। এগুলো কিন্তু ইনভেস্টমেন্টে একটা বৈরি পরিস্থিতি তৈরি করছে। যে কারণে কিন্তু ইনভেস্টমেন্ট হচ্ছে না। তার মানে সত্যি কথা বলতে গেলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা একটা বড় কারণ। এর পাশাপাশি আমাদের দুর্বল ইনফ্রাস্ট্রাকচার।

অবকাঠামোর থেকেও আমাদের বড় দুর্বলতা হচ্ছে, আমাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ম্যানেজমেন্ট। আমাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচারটা আমরা যেভাবে ম্যানেজ করছি, আমাদের এই ম্যানেজমেন্টটা খুবই পুওর বা খুবই অনুন্নত। আমাদের এটার প্রসেসটাকে মডার্নাইজ করা দরকার, অটোমেটেড করা দরকার এবং এই ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করা দরকার। যেমন সী-পোর্ট বলেন, এয়ারপোর্ট বলেন; এয়ারপোর্টে যেটুকুই ব্যবস্থাপনা আছে, এটার ব্যাবস্থাপনা ও প্রসেসটাকে উন্নত করা যায় তাহলে দেখবেন ফ্লো টা অনেক বাড়বে। এতো জটিলতা তৈরি হবে না। একই রকম চট্টগ্রাম পোর্ট। এক সময় অনেক খারাপ ছিল, এখন অনেক ভালো হয়েছে এবং আরও ভালো করা যায়। এই বিষয়গুলো কিন্তু আমাদের বাঁধা। এর সাথে সাথে এনার্জির অভাবতো আমাদের রয়েই গেছে। এখনও অনেক কো¤পানি এনার্জির সমস্যায় সাফার করছে।

অনেক সিরামিক কো¤পানি কিন্তু এখনও ঠিক মত গ্যাস পাচ্ছে না। অথচ সিরামিক হলো আমাদের অলটারনেটিভ সোর্স অব এক্সপোর্ট ডাইভারসিফিকেশন। এসব সমস্যার সমাধান কিন্ত আমরা করতে পারছি না। আপনি দেখেন গ্যাস এর কিন্তু ভীষণ অব্যবস্থাপনা। সিএনজি দিয়ে যে সব কার মালিকেরা গাড়ি চালাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগেরই কিন্তু সিএনজি দরকার নেই। তারা অকটেন বা পেট্রোল দিয়ে গাড়ি চালাতে পারেন, সে সামর্থ্য তাদের রয়েছে। অথচ তারা সিএনজি ব্যবহার করছেন। এগুলো পরিষ্কার অব্যবস্থাপনা। এর প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ছে শিল্পখাতে। সার্বিক অর্থনীতিতে। বলা যায়, বাংলাদেশে ‘গুড গভর্ন্যান্স’ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা। আমাদের গভর্ন্যান্সটাকে আরও ইমপ্র“ভ করতে হবে। সুতারাং ব্যুরোক্রেসির সাথে সাথে গভর্ন্যান্সটাকে ঠিক হতে হবে।

আরো কিছু বিষয় আছে, আমি আগেই বলেছি আমাদের ‘পুরনো আইন’। যেমন ধরুন আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেটরি অ্যাক্ট। এটা অনেক পুরনো। অনেকবার ফে­ক্সিবল করা হয়েছে। কিন্তু এটা এতই পুরনো আইন যে, অনেকবার ফে­ক্সিবল করার পরও এটা বিশ^বাজারের সাথে তাল মেলাতে পারছে না। এটাকে এখন আমুল পরিবর্তন না করা পর্যন্ত কিন্তু আমরা ওয়ার্ল্ড ফেইজের সঙ্গে যেতে পারছি না। আপনি এক্সপোর্ট বেইজ্্ড ইন্ডাস্ট্রি এখানে তৈরি করবেন, এক্সপোর্ট করতে গেলে বিশ্বে এক্সপোর্ট বিজনেস যেভাবে চালু আছে, অর্থাৎ অন্যান্য দেশ যারা আমাদের কমপিটিটর, তারা যেভাবে এক্সপোর্ট করছে, সেটাকে কিন্তু আমাদের ফলো করতে হবে।  তারা যে প্রসেস মেইনটেইন করছে, আমরাও যদি তা না করি, তাহলে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবো না। আর এটাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হচ্ছে। বিষয়গুলো কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ন। আমাদের কাস্টমস্্ অ্যাক্টও একই রকম পুরনো। সেই ১৯৬০ সালের। এই অ্যাক্টটা নিয়ে কিন্তু অনেক কথা হয়েছে, অনেক চেঞ্জ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এর সফলতা আমরা দেখিনি।

আরও সমস্যা হল আমাদের মিনিস্ট্রিগুলোর কো-অর্ডিনেশনে। এতগুলো মিনিস্ট্রি যে, আন্ত মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কোঅর্ডিনেশনের খুব বেশি অভাব। কোনো একটা অ্যাক্ট বা আইনের কোনো পরিবর্তন বা চেঞ্জ আনতে হলে এতোগুলো মন্ত্রণালয়ে ঘুরতে হয় যে, এটা চেঞ্জ করা কঠিন হয়ে যায় অনেক সময়। সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি আছে, মন্ত্রণালয় আছে, আইন মন্ত্রণালয় আছে এটা সেটা চেঞ্জ করতে করতে দেখা যায় সরকারের পুরো মেয়াদই শেষ হয়ে যায়। আবার নতুন সরকার আসে। নতুন সরকার এসে নতুন ফোকাস দেয় অন্য দিকে। সেই আইন বা অ্যাক্ট আর বদলায় না।

আসলে কিন্তু এই জিনিসগুলো দেখা দরকার। পুরনো আইন, আমাদের ব্যুরোক্রেসি বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, আমাদের গুড-গভর্নেন্স এবং আমাদের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন লাগবে। আমাদের নতুন সী-পোর্ট লাগবে, আমাদের এয়ারপোর্ট ফ্যাসিলিটিজ দরকার, রাস্তা দরকার। কিন্তু সেই সাথে দরকার এগুলোর ব্যবস্থাপনা। আজকে ট্রাফিক জ্যামে যে ভোগান্তিটা আমরা করছি, এটা হত না, যদি আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাটা ঠিক থাকতো। আমি অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উন্নত বা বেটার সিচুয়েশন প্রিভেইল করতাম যদি আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভালো থাকতো। আপনি আমাদের ট্রাফিক পুলিশকে দেখবেন- কোন কোন জায়গাতে ম্যানুয়ালি চালাচ্ছে আবার কোথাও অটোমেটিক চলছে। এর ফলে কিন্তু জ্যামটা বেশি লাগছে। ইদানিং গুলশানের মধ্যে বাস দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। খুবই ভাল পদক্ষেপ।

আমি কিন্তু এর আগেও বলেছিলাম আমরা যদি উত্তরাতেও এমন করতে পারি, মোহাম্মাদপুর-মিরপুরে করতে পারি, তাহলে এগুলো কানেক্ট করবে ইন্টারসিটি বাসের সাথে। এগুলো করলে আপনি দেখবেন ট্রাফিক সিচুয়েশন বেটার হচ্ছে। তারপর দেখেন রাজউক; আমাদের বাড়ি গুলো উঠে যাচ্ছে রাজউক কিছু বলে না, বাড়ি উঠে যাওয়ার পর লাফালাফি করে। বাংলাদেশে রানা প্লাজার মত বড় দুর্ঘটনা হয়ে গেছে, এরপরও কিন্তু আমরা শিক্ষা নেয়নি। আমরা ২০ তলা, ২৫ তলা বিল্ডিং বানাচ্ছি, কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার রাস্তা রাখছি না। এগুলো কিন্তু এলারমিং সিচুয়েশন বাংলাদেশের জন্য। এটা ব্যাড সিগন্যাল দেয় দেশের বাইরে। একটা ২০ তলা বিল্ডিং-এ যদি হঠাৎ আগুন লেগে যায় তাহলে কিন্তু নেভানো কঠিন হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। কয়েকদিন আগে কিন্তু আমরা দেখেছি, একটি প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে গেছে, নেভানো যায়নি। আবার মাত্র কদিন আগে গুলশানের একটি মার্কেটে আগুন লেগেছিল, সেটাও নেভাতে তিন দিন লেগেছে। এটা নেভাতে তো তিন দিন লাগার কথা না। তাহলে এখানে অভাবটা কোথায়? আমি মনে করি এখানে অব্যস্থাপনার অভাব আছে। এখানে ইন্টারমিনিস্ট্রি কোঅর্ডিনেশনের অভাব আছে, আমাদের বরাদ্দেরও অভাব আছে।

আরেকটি বড় বিষয় আমাদের হিউম্যান রিসোর্স। আমাদের ‘হিউম্যান রিসোর্স’ রিয়েলি রিসোর্স। দেশের প্রায় ৭০ ভাগ লোক, যাদের বয়স ৩০ এর নিচে। এটা ব্লেসিং অব গডস্ বা স্রস্টূা’র বিশেষ নিয়ামক। অথচ আমরা এদেরকে কর্মী বানাতে পারছি না। আজকে একশোর বেশি বিশবিদ্যালয়। এখান থেকে পাশ করে বের হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, তাদের চাকরি হচ্ছে না বা আমরা দিতে পারছি না। কেন পারছি না, কারণ তাদের সেই কোয়ালিটি নিয়ে তারা বের হচ্ছে না। শিক্ষার মান এতো নিচে নেমে গেছে যে, জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে কিন্তু মান নেই। বলতে গেলে এখনকার শিক্ষার না আছে এথিক্স, না আছে কোয়ালিটি।

আমাদের দেশে দরকার হলো কারিগরি শিক্ষা। অথচ এটার দিকে আমরা একটুও নজর দিচ্ছি না। আজ যদি আমরা ভাল কারিগরি শিক্ষা দিতে পারতাম, তাহলে আমাদের দেশের শ্রমিকরা দেশের বাইরে গিয়ে তাদের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে যথাযথভাবে ভাল রোজগারের টাকা রেমিট্যান্স আকারে দেশে পাঠাতে পারতো। এখানে আমরা একটা বিরাট সফলতা অর্জন করতে পারতাম। এটাও আমাদের আসলে দুর্ভাগ্য। সেদিক থেকে আমি আমাদের এগ্রিকালচার সেক্টরকে ধন্যবাদ দেই। তারা কিন্তু অনেক এগিয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের ইন্ডাস্ট্রি সেভাবে এগোতে পারেনি. যেভাবে এগোনোর কথা ছিল।

দক্ষ জনশক্তি কীভাবে বাড়ানো যাবে:

আমাদের দক্ষ জনশক্তি বাড়াতে হলে সবার আগে আমাদের শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে হবে। যে টিচাররা শিক্ষা দিচ্ছেন, তাদের সেই ক্যাপাসিটি আছে কি না। তাদেরকে স্ট্যাটাস দিতে হবে। ভারত সিস্টেম করেছে, পাঁচ বছর কেউ যদি স্কুলে শিক্ষকতা করেন তবে তিনি কলেজের শিক্ষক হতে পারবেন। এভাবে সরকার যদি ম্যানেজমেন্টা ঠিক করে তবে শিক্ষার মান বাড়বে। আমাদের দেশের শিক্ষকরা খুবই নিম্ন বেতনে কাজ করেন। এটা একটা বড় সমস্যা। এ কারণে একটু ভাল বা মেধাবীরা শিক্ষক হতে চায় না। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য। স্কুল কিন্তু শিক্ষার বেইজ। আপনার ভালো ভিত্তি করতে চাইলে, তা স্কুল থেকেই করতে হবে। একটা ছাত্র তার স্কুল জীবন থেকে যা শেখে, সেটার ওপর ভিত্তি করেই সে তার ইমারতটা তৈরি করে। স্কুলটা হলো তার ভিত্তি, আর ভিত যদি কারো নড়বড়ে হয়ে যায়, তাহলে তার সারা জীবনটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে।

যারা মাদ্রাসায় পড়ছে, তারা একধরনের শিক্ষা পাচ্ছে। তারা হয়তো ধর্মীয় শিক্ষা বেশি পাচ্ছে, কিন্তু যে শিক্ষাটা পেলে তার আয়-রোজগার করা সহজ হতো, অর্থাৎ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অন্য সবার মতই দক্ষতা দিয়ে উপার্জন করতে পারতো, তা কিন্তু পারছে না। আবার আমাদের যারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে, তাদেরও একই অবস্থা। তারা বিদেশি বই পড়ছে, দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য জানছে না। দেশের পরিবেশ ও সমাজ ব্যবস্থা জানছে না। এটা কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার বিরাট একটা সমস্যা। এর প্রভাব নানাভাবে সমাজে পড়ছে। ফলে ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা নিতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে এবং প্রকৃত শিক্ষিত হতে পারছে না। হয়তো তাদের সার্টিফিকেট আছে, ভালো মার্কস আছে কিন্তু আসল শিক্ষা নেই।

আবার আমাদের সবারই কিন্তু বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার দরকার নেই। চার পাচ লাখ টাকা খরচ করে সবার বিবিএ, এমবিএ পড়ার দরকার নেই। আমাদের দরকার অনেক কারিগর। আমরা এগ্রিকালচার, বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি, ইলেক্ট্রিশিয়ান, প্লামবারসহ নানা বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা দিতে পারি। আপনি দেখুন আমাদের পেশাদার ড্রাইভার খুবই অভাব। আমরা ভাল ড্রাইভার বানাতে পারি। ধরুন মাধ্যমিক পাশ করে ড্রাইভিং শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে অনেক ভালো ড্রাইভার পাওয়া যেত। আবার এদেরকে দেশের বাইরেও পাঠানো যেত। বাইরেও ড্রাইভারদের চাহিদা আছে বেশ।

আমার খুব খারাপ লাগে, যখন দেখি এমবিএ পাশ করে কেউ পনেরো হাজার টাকায় চাকরি করছে। অথচ একটা ড্রাইভারের আয় তার চেয়েও বেশি। লাভ কি হচ্ছে? এই শিক্ষা দিয়ে কী হচ্ছে আমার? এটা শিক্ষাকে অসম্মান করা হচ্ছে। আমাদের অনেকগুলো টিভি চ্যানেল আছে, আমাদের এসব টেকনিক্যাল ও টেকনিশিয়ানদের জন্য একটা কারিগরি ইনস্টিটিউট খোলা যায় না? আপনাকেই টেকনিক্যালদের বানাতে হচ্ছে, প্রাকটিক্যালি হাতে কলমে শেখাতে হচ্ছে। অথচ কোনো টেকনিক্যাল স্কুল যদি এদেরকে তৈরি করে দিত, তাহলে টিভি চ্যানেলগুলো অনায়াসে তাদেরকে নিয়ে নিতে পারতো। নিজেদের তা বানাতে হতো না। তাহলে দক্ষ জনশক্তি আমরা কাজে লাগাতে পারতাম।

কারা উদ্যোগ নিবে

উদ্যোগগুলো আসলে সরকারকেই নিতে হবে। এটা প্রাইভেট থেকে আসে না বা হয় না। আর সরকার বলতে আমি কেবল নির্বাচিত এমপিদেরকেই বোঝাচ্ছি না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যেসব সেক্রেটারি, জয়েন্ট ও ডেপুটি সেক্রেটারিরা সংশ্লিষ্ট রয়েছেন তাদেরকে বোঝাতে চেয়েছি। দেখুন তাদের কিন্তু দেশপ্রেম থাকতে হবে। তাদেরকে দেশের সমস্যার কথা বিবেচনা করতে হবে, অনুধাবন করতে হবে। আজকে দেশের শিক্ষার অবস্থা এত খারাপ অথচ আমাদের সেক্রেটারিদের অনেকের সন্তান দেশের বাইরে পড়াশোনা করছে। ফলে তাদের তো দেশের শিক্ষা নিয়ে মাথা ব্যাথা থাকবার কথা না।

আগে কী হতো, জেলা স্কুলে কিন্তু ডিসি সাহেবের সন্তান পড়তো। আর এখন আপনি জেলাগুলোতে গিয়ে বেশিরভাগই ডিসি সাহেবের ফ্যামিলি পাবেন না। আমি কিন্তু আপসোসের সাথে বলছি কথাগুলো, কিন্তু খুবই সত্যি। আমি যখন ফিলিপস্-এ ছিলাম, রাজশাহী ভিজিটে গিয়ে ডিসি সাহেবের বাড়িতে উঠেছি। ডিসি সাহেবের স্ত্রী-সন্তানসহ একসাথে খাওয়া দাওয়া বেড়ানো হয়েছে। দেখুন সব জেলাগুলোর নামকরা কলেজ যেমন বরিশালের বিএম কলেজ, খুলনার বিএল কলেজ, যশোরের এমএম কলেজ, ঝিনাইদহের কেসি কলেজ, রংপুরের কারমাইকেল কলেজ, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের মতো নামকরা সব কলেজ থেকে কিন্তু অনেক নামকরা মানুষেরা পাশ করে বের হয়েছেন। তার মানে সেসব কলেজে নামিদামি লোকদের ছেলেমেয়েরা পড়তো।

এখন কিন্তু আর পড়ে না। কারণ তারা এখন সেখানে থাকেন না। জজ সাহেব থাকেন একলা, এসপি সাহেব থাকেন একলা, ডিসি সাহেব থাকেন একলা। আর তাদের ফ্যামিলি থাকে সব ঢাকাতে। এটা কিন্তু খুব অ্যলার্মিং সিচুয়েশন। আপনাকে দুটো জিনিস দিতে হবে। একটা শিক্ষা আরেকটা স্বাস্থ্য। এই সেবা দুটোকে যদি আপনি ডিসেন্ট্রালাইজ্্ড না করতে পারেন, জেলাগুলোতে না ছড়িয়ে দিতে পারেন তাহলে জেলাগুলোকে ডেভেলপ করতে পারবেন না। এই ঢাকার ওপর চাপ তৈরি হবে।

উদ্যোগগুলোর মধ্যে হতে পারতো বিশ^বিদ্যালয়কে আমরা যদি জেলাতে নিতাম, মেডিকেল কলেজকে জেলাতে নিতাম, ঢাকতেই সব না রেখে ছড়িয়ে দিতাম তাহলে অনেক ভাল হতো। সরকারের কিছু মন্ত্রণালয়কে যদি ডিসেন্ট্রালাইজড করে দেই, যেমন শিপিং মিনিস্ট্রি’র অফিস ঢাকায় থাকার দরকার নেই। চিটাগাং বা খুলনায় নিয়ে যেতে পারি। একই রকম করে, আর্মি, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহীনির হেড কোয়ার্টারকে আমরা সরিয়ে নিতে পারি। এভাবে কিন্তু আমরা ডিসেন্ট্রালাইজড করতে পারি। আর তাহলেই অনেক দক্ষতা বাড়বে আমাদের।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিতে আমাদের দেশ:

আমি কিন্তু আবারো বলবো, আমাদের দেশে অনেক সুযোগ সুবিধা আছে। এক নম্বর সুবিধা হলো খুব কম দামে লেবার পাওয়া যায় এবং আমাদের লোকজনের আচরণ কিন্তু ভালো। এদের দৃষ্টিভঙ্গি ভালো, মানুষের সাথে ভালো ব্যাবহার করে। আমাদের লেবাররা কিন্তু রুড না। আমি অনেক দেশে দেখেছি, যারা কাজ করে তারা কিন্তু খুব রুড হয়। আপনি ইউরোপ বলেন চায়না বলেন, এদের লেবার কিন্তু রুড; আমাদের দেশের লেবারদের মতো সফ্্ট না। আমাদের লেবাররা কিন্তু ভালো। তারা সফট  ও খুব ক¤িপটিটিভ। এটা কিন্তু বিরাট অ্যাডভান্টেজ আমাদের দেশের জন্য।

আমি অ্যাডভান্টেজ দিয়ে শুরু করি, আমাদের দ্বিতীয় অ্যাডভান্টেজ হচ্ছে আমাদের পরিবেশ, আমাদের দেশের জিওগ্রাফিক্যাল লোকেশন, আমাদের ওয়েদার। এই জিনিসগুলো কিন্তু আমাদের জন্য অ্যাডভান্টেজ ছিল, কিন্তু আমরা এগুলোকে কাজে লাগাতে পারছি না, বিদেশিরা কিন্তু এই কারণে আসে না। আসার পরে কিন্তু তারা এই জিনিসগুলো ফেস করে। যারা এখানে একবার বিনিয়োগ করে তারা বিনিয়োগ করার পরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পরে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এজেন্সি থেকে হ্যারেজমেন্ট হয়। তো এই কারণে তারা ফ্রাসটেডেট হয়ে যায়। ফলে তারাও কিন্তু রং সিগন্যাল দেয়। অন্যান্য যারা আসতে চায় তারা কিন্তু দেখে, জিজ্ঞাসা করে- তারা কতটা ভালো আছে, তারা আলোচনা করে সেখান থেকে কিন্তু একটা রং সিগন্যাল নিয়ে চলে যায়। এবং আর কিছু জায়গা আছে সেখানে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।

যেমন, এয়ারপোর্ট। আমাদের এয়ারপোর্টে যখন একটা বিদেশি যাত্রী নামে সে তাড়াতাড়ি ইমিগ্রেশন করে তার মালটা নিয়ে বের হতে পারে না। এটার কিন্তু একটা লিড টাইম সেট করা দরকার সরকারের। এটাই ফাস্ট ইম্প্রেশন,এই জায়গাটা কিন্তু খুব অবহেলিত। এটা কিন্তু একটা বড় ব্যাপার,  বিদেশিরা একটা দেশ স¤পর্কে শুনে আসছেন। এসে যদি অ্যারাইভাল ভিসা নিতেই এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তা দুঃখজনক। তারপর এয়ারপোর্টের লোকগুলোর যে ব্যাবহার, তারা বিদেশিদের সাথে ভালো ব্যাবহার করে না। দেশের লোকের সাথে তো করেই না, বিদেশিদের সাথেও করে না।

অথচ এরা কিন্তু সার্ভিস এজেন্সি- যারা ইমিগ্রেশনে থাকে কাস্টমসে থাকে। তারা কাস্টমসের লোক রেভিনিউ’র জন্য আছে ঠিক আছে, কিন্তু তাদেরকে মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহার তো করতে হবে। এই জিনিসটার অভাব আছে। আমি যতটুকু জানি সাধারণত এগুলো বিভিন্ন এজেন্সিকে দিয়ে দেয়া হয় সার্ভিস করার জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে দিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং তারা থার্ড পার্টি হয় বা সেকেন্ড পার্টি হয়। তো কেন আমরা তাদের কাছ থেকে, এনসিওর করে নিতে পারি না সার্ভিসটা। থার্ড পার্টি নাই তো, আমাদের কাস্টমস’র লোক থাকে, এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন’র লোকজন থাকে তারাই মালপত্র নিয়ে আসে। আপনি যখন বিমান থেকে নামলেন ওখান থেকে মালটা যারা বেল্টে দেয় তারা সব বিমানের কর্মচারী। এটা থার্ড পার্টিকে দেওয়া হয়নি। সার্ভিসটা থার্ড পার্টিকে দেয়া হলে ভালো হতো।

আপনি ইমিগ্রেশনটা থার্ড পার্টিকে দিতে পারবেন না। তাহলে ইমিগ্রেশনে যারা থাকে তাদেরকে ট্রেনিং দিয়ে দিন, এখন দেখবেন কম্পিউটার ধরে টিপতে পারছে না ঠিক মতো। বাইরের ইমিগ্রেশন কিন্তু অনেক নতুন সিস্টেম চালু করেছে মতামত দেবার জন্য। যে ভালো সার্ভিস দেয়, ভালো নম্বর পায়, তাকে হয়তো একটা বেনিফিট দেওয়া হয়। এই সুযোগগুলো কিন্তু এখানে  নেই। তারা গল্প করে যাচ্ছে, কথা বলছে। তার সামনে যে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে সে দিকে কিন্তু তার খেয়াল নেই। তো এই দৃষ্টিভঙ্গিটা কিন্তু পাল্টাতে হবে তাদের ট্রেনিং সিস্টেম চালু করে। এখানে মাইন্ডসেটের ব্যাপার আছে। মাইন্ড সেট করতে গেলে কিন্তু ট্রেনিং দিতে হবে। আপনি যখন ইমিগ্রেশনে অফিসারদের পোস্টিং দিবেন তখন তাদের কে অন্তত একমাস বোঝাতে হবে, দেখো তোমরা যারা ওখানে যাচ্ছ, ওখানে বিদেশি যাত্রীরা আসবে, দেশি যাত্রীরা আসবে, তোমাদের কিন্তু তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। এই জিনিসগুলো কিন্তু আমাদের দেশে নাই।

অবশ্যই এই উদ্যোগ ইমিগ্রেশন অথরিটির নেয়া দরকার। তবে এভিয়েশন মন্ত্রণালয়ের একটা মতামত থাকা দরকার। তাদের সরকারকে বলা দরকার আবার সিমিলারলি কমার্স মন্ত্রণালয়কে জানাতে পারে।

আমরা ব্যবসায়ীরা বিষয়গুলো নিয়ে বলেছি এবং বলে যাচ্ছি। এক সময় ছিল যখন সেক্রেটারি সাহেবরা মনে করত ওনারা স্যার। আমরা শুধু ওনাদের স্যার বলবো এবং ওনারা আমাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করবেন, কিন্তু এখন কিছুটা ভালো আগের থেকে। কিন্তু এটার আরও উন্নয়ন দরকার। তাদেরকে পুরোপুরি বুঝতে হবে তারা পাবলিক সার্ভেন্ট, তারা কিন্তু জনগণের টাকায় বেতন পান এবং জনগণকে সেবা দিতে হবে। তো এই জিনিসটা তাদের মাথায় ঢুকতে হবে।

আজকে মানুষ ট্যাক্স দেয় না। কেন মাত্র ২৭ লক্ষ মানুষ ট্যাক্স দেয়। বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ২৭ লক্ষ মানুষ ট্যাক্স দেয়। আমরা কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারি কোথায় শুভঙ্করের ফাঁকিটা আছে। মিনিমাম এখানে দেড় দুই কোটি লোকের ট্যাক্স দেওয়া দরকার। তাহলে যারা ট্যাক্স দেয় তাদের ওপর অত্যাচারটা হতো না। এখন যারা ট্যাক্স দেয় সরকার কিন্তু তাদের উপর অত্যাচার করে, তাদের অডিট ফাইল এই করে, সেই করে। ফলে নতুন কর দাতা বাড়ছে না। আমরা ২৭ লক্ষ মানুষ ট্যাক্স দিই। মন্ত্রণালয়, এনবিআর আমাদের নিয়ে গর্ব করে যে আমরা ২৭ লক্ষ মানুষের ট্যাক্স আদায় করেছি। কিন্তু এর বেইজটা লো এই জিনিসটা তারা চিন্তা করে না।

ইদানিং বেশ কিছু বিজনেসম্যান এবং তাদের সংগঠন থেকে ওয়ান স্টপ সার্ভিস-এর কথা শুনি। এটা খুব কনফিউজিং একটা জিনিস, আমি মনে করি এটা পাওয়া সম্ভব না । তারা একটা জিনিস পেতে পারেন, সেটা হচ্ছে যখন নতুন ম্যানুফ্যাকচারিং কো¤পানি বা নতুন সার্ভিস নিয়ে কোনো কো¤পানি আসবে তারা এখন বিডা (বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তপক্ষ)’র সহায়তা নিতে পারে। বিডা’র থেকে হয়তো তারা কো¤পানি শুরুর সেটআপটা দিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু এরপর সে আর সেই সুযোগটা চাইলেও নিতে পারবে না। তাকে এনবিআর এ যেতে হবে, অন্যান্য এজেন্সিতেও যেতে হবে। হয়তো ইনিশিয়াল লাইসেন্সটা তারা পেতে পারে, কিন্তু ফলোআপ কাজগুলো ওয়ান স্টপ সার্ভিস দিয়ে কখনো হবে না। আপনার যদি কাস্টমসের সাথে কাজ থাকে তাহলে কিভাবে আপনি ওয়ান স্টপ সার্ভিস দিবেন। বাট শুরুতে এটা হতে পারে, সেটআপটা হতে পারে। লোকজন আসছে আশা নিয়ে, ঘুরে চলেও গেছে এমন আমি জানি।

এখানে যখন বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট ছিল, তখন চেয়ারম্যানেরা সাথে দেখাই করা যেত না। উনি

এমন ক্ষমতা নিয়ে চলতেন যে, উনি দেখাই করতেন না। উনি নিচের লোকদেরই নমিনেট করে দিতেন। এ জন্য অনেক বড় বড় কো¤পানি ফিরে গেছে। কিন্তু এখন আমরা হয়তো কিছুটা ভালো সিচুয়েশনে আছি ।

আর একটা জিনিস আমদের এখানে হয়- আমাদের যারা বিজনেস প্রমোটিং বডি তাদেরকে আমরা রেগুলেটর বানিয়ে ফেলি। আমি একটা উদাহরণ দিই- যেমন এক্সপোর্ট প্রোমোশন ব্যুরো। এদের কাজ কিন্তু এক্সপোর্ট বাড়ানো তাই না, তাদেরকে আমরা গার্মেন্টস এর কোটা নিয়ন্ত্রণ করতে দিলাম, কোটার নিয়ন্ত্রক বানালাম। বানিয়ে আমরা কী করলাম, তাদের পয়সার লোভ দেখিয়ে দিলাম। তারা ঘুস-টুস খেয়ে বড়লোক হল। কিন্তু আসল কাজটা থেকে কিন্তু তারা দূরে চলে গেলো। এক্সপেক্টেশন বাড়ায় সে কিন্তু ভালোভাবে পারফর্ম  করতে পারেনি, এখনও করছে বলে আমি মনে করি না। এক্সপোর্ট-এর বহুমুখিতা কিন্তু আমাদের দরকার আছে, আমাদেরকে শুধু গার্মেন্টস এর উপর ভরসা করলে হবে না, আমাদের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। নতুন নতুন বাজার তৈরি করতে হবে। সেখানে আমাদের ইপিবি কতটুকু ভূমিকা রাখছে। আজ যারা আমরা এক্সপোর্টে বাজার পেয়েছি, সেটা কিন্তু আমাদের উদ্যোক্তারা নিজেদের উদ্যোগে নিয়ে এসেছে। সিমিলারলি আমাদের বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট কী করতো, ওই যে বিদেশি যারা কাজ করতে আসে

এদের পারমিট ইস্যু করত। আমি মনে করি এদেরকে সরানো দরকার। এদের জন্য আলাদা বডি থাকা দরকার, কারণ এখানে কিন্তু ফিসি ফিসি ব্যাপার আছে। যারা ইমিগ্রেশন দেখে কেবল তাদের থাকা উচিত, অন্য কোনো বডির থাকা সমীচীন নয়। কারণ তারা হলো প্রমোটিং বডি, আর প্রমোটিং বডি কখনো রেগুলেটিং বডিতে থাকতে পারে না।

যেমন ধরুন ’বিডা’। আমাদের দেশে যত ফরেন ওয়ার্কার আসে, তাদের অ্যাপ্রোভাল পার্মিশন ইস্যু করে তারা, এটা ওখান থেকে সরানো উচিত। ইপিবির যেটা ছিল ওটা এখন নেই অথচ এখনো তারা সার্টিফিকেট অব অরিজিন ইস্যু করে। এগুলো না করেও ইপিবি’র মেইন যে কাজ- নতুন বাজার খোঁজা; এটার দিকে ফোকাস করা উচিত।

জঙ্গি ইস্যুতে দেশের ভাবমূর্তি:

সম্প্রতি ফ্রান্সে বড় ঘটনা ঘটে গেছে, ইউকে’তে থ্রেট আছে, আমেরিকাতে থ্রেট আছে। তারপরেও কিন্তু তারা ব্যবসা করে যাচ্ছে। ইন্ডিয়াতেও ইন্সিডেন্ট ঘটেছে তারপরও ওখানে ব্যবসা বাণিজ্য হচ্ছে, লোকজন যাচ্ছে আসছে।

কিন্তু বাংলাদেশে যেটা হয়েছে, এতে আমরা আমাদের ইমেজটা নষ্ট করেছি, ভাবমূর্তিটা নষ্ট করেছি। আমি মনে করি এখানেও আমাদের ম্যানেজমেন্টের প্রবলেম। যেভাবে এটাকে ম্যানেজ করা উচিত ছিল সেভাবে ম্যানেজ করতে পারিনি। এটা নিয়ে অনেক বেশি হৈ চৈ পড়ে গেছে, এটা উচিত হয়নি। এতে বিশ্বের কাছে নেগেটিভ ম্যাসেজ চলে গেছে। আমি মনে করি, হলি আর্টিসানের ঘটনা আইসেলেটেড ইন্সিডেন্ট। বাংলাদেশে যে আইএসের বড় ধরনের অ্যাক্টিভিটিস আছে এটা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ বাংলাদেশ উদার মুসলিম কান্ট্রি। আমাদের দেশের লোকজন যথেষ্ট অতিথিপরায়ণ। ২/১ পার্সেন্ট হয়তো খারাপ লোক থাকতে পারে। কিন্তু ৯৮ পার্সেন্ট লোক ভালো। আমাদের থেকে অন্যান্য দেশে খারাপ মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি আছে।

ইন্ডিয়াতে এমন এমন জায়গা আছে যেখানে পুলিশ নিয়ে ঢোকা যায় না। অথচ বাংলাদেশে এরকম কোন জায়গা নেই। তাই আমি মনে করি, বাংলাদেশের  সিকিউরিটি অবস্থা আসলে খারাপ না। কিন্তু আমাদের ইমেজটা খারাপ হয়েছে। এটার জন্য কিন্তু আমরা অনেক কিছু করতে পারতাম।

আমাদের এই যে ইমেজ খারাপ বলা হচ্ছে, আমি মনে করি এজন্য সবাই দায়ী। জনগণও দায়ী, সরকারও দায়ী। যারা স্যোসাল মিডিয়াতে লেখালেখি করেছে তারাও বেশি বেশি লিখেছে। যেটা উচিত হয়নি। আপনারা যারা মিডিয়াতে আছেন তাদেরও একটু লাইট জ্বালানো উচিত ছিল। আবার সরকারে যারা আছে তারাও এভাবে ওপেনলি না করে অন্যভাবে ম্যানেজ করতে পারতো। প্রত্যকটা দেশই বাইরের দেশে পজেটিভ ইমেজ তৈরির চেষ্টা করে। আমাদের নিকটবর্তী দেশ ভারতেও দেখবেন তাদের বড় বড় মিডিয়ায় তাদের পাবলিসিটি হয়।

আমি একসময় আমাদের পর্যটন মন্ত্রীকে বলেছিলাম, ওয়ার্ল্ড ফেমাস যে ম্যাগাজিনগুলো আছে সেখানে কেন আমরা লবিং করি না? সেখানে আমাদের দেশের ভালো দিকটা কেন যায় না? আমাদের সিলেট কিন্তু একটা ভালো পর্যটনের জায়গা। এখানে দুসাই হয়েছে, এরপর গ্র্যান্ড সুলতান প্যালেস হয়েছে, আছে হেরিটেজ। এগুলো নিয়ে যদি ভালোভাবে লেখালেখি করতাম তাহলে আমাদের ইমেজটা আরো ভালো হতো।

আপনি যদি একটা জায়গায় প্রটেকশন তৈরি করতে যান, সেখানে দু একটা জঙ্গি বা খারাপ লোক থাকতে পারে। এটা দমন করতে হবে। কিন্তু এটা নিয়ে এমন পাবলিসিটি হওয়াতে বাইরে কিন্তু এটি নেগেটিভলি চলে যায়। এটা তো পার্ট। রুটিন জব। আজ মোহাম্মদপুরে তিনজন জঙ্গি ধরলো। এটা পুরো হেডলাইন হয়ে গেল, এই জিনিসগুলো থেকে কিন্তু আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমার মনে হয় মিডিয়া আরো পজিটিভ রোল নিতে পারে।

এবার আমি চলে যাব  একেবারে বেইজে। আমাদের শিক্ষিত লোক তৈরি করতে হবে। তাহলে তারা নিজের কাজটি ঠিকমতো বুঝবে।

দেশের উন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহার:

আমরা প্রযুক্তিতে সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছি। তবে প্রযুক্তিতে আরো এগোতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। একেবারে প্রাইমারি লেভেল থেকে  শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। বাংলাদেশে প্রথম বারকোডিং ১৯৯৭ সালে আমরা নিয়ে আসি এবং ২০০৪ এ রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন-আরএফআইডি নিয়ে আসি। যেটি বারকোডিং থেকেও অ্যাডভান্স। এই নতুন নতুন প্রযুক্তি কিন্তু আমরা বাংলাদেশে নিয়ে এসেছি।

প্রযুক্তি আমাদের অনেক ধরনের সহায়তা দেয়। আজ যে ব্যাংকে এটিএম বুথের সেবা পাচ্ছেন, এতে যেমন গ্রাহকের সুবিধা হচ্ছে তেমনি ব্যাংকেরও সুবিধা হয়েছে। গ্রাহক যেভাবে বাড়ছে; এটি না থাকলে ব্যাংকের ভিড় বেড়ে যেত। ব্যাংকের ব্রাঞ্চের সাইজ  বড় করতে হতো। অনেক কর্মী নিয়োগ দিতে হতো। এটির কারণে অনেক বড় একটা ভিড় এভয়েড করা সম্ভব হচ্ছে। এগুলো প্রযুক্তির কারণেই হচ্ছে। এটি তো মাত্র একটি উদাহরণ।

প্রযুক্তির সবেচেয়ে বেশি সুবিধা ব্যাংক সেক্টর ব্যবহার করছে। এটি কিন্তু আমাদের এনবিআর নিতে পারতো। এনবিআর ভ্যাট অনলাইন এত বছর পরে করেছে। অথচ এটির জন্য আমি ১০ বছর আগে প্রোপোজাল দিয়েছিলাম। বাংলাদেশে অটোমেটিক ক্যাশ মেশিনও ২০০৭/৮ সালের দিকে অ্যামচেমের রিকোয়েস্টে এনবিআর প্রথম আনে। অ্যামচেম এনবিআরকে রিকমেন্ড করে যে, এ মেশিনটি আনতে দিন। এটির ভ্যাট নিয়েন না। আপনাদেরই সুবিধে হবে। সরকার এতদিন পরে যে ট্যাক্সের ব্যবস্থা করেছে এটি আগে করা উচিত ছিল। কাস্টমসকে এখনো অটোমেটিক করতে পারেনি। যেখানে বিদেশে ১০০ পার্সেন্ট কাস্টমস অটোমেটিক। বিদেশে মাল পৌঁছানের আগেই কাস্টমস হয়ে যায়। সবই টেকনোলজির মাধ্যমে।

এক্ষেত্রে যদি আপনি অডিটের বিষয়টি বলতে চান তবে, ১০ পার্সেন্ট অডিট রাখেন। যেটি সন্দেহ হবে শুধুমাত্র সেটি অডিট করা হবে।  তাহলে এয়ারপোর্টে এত জ্যাম হতো না।

এ সকল সিস্টেমে প্রযুক্তি নির্ভরতা অবশ্যই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সহায়ক। আমি সরকারকে একটা বিষয়ে ধন্যবাদ দিই যে, তারা টেন্ডারটাকে ধীরে ধীরে অটোমেশনে নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে টেন্ডারবাজি বা টেন্ডারকে কেন্দ্র করে আগে যে মারামারি হতো এটা কমেছে। অটোমেশনের সাথে সাথে ট্রান্সপারেন্সি বাড়বে এবং করাপশন কমবে। এই যে ট্রেনে বিনা টিকিটে যাত্রী যাওয়ার  অভিযোগ; এটাকেও তো অটোমেশন করা যায়।

বাসের টিকেট যেভাবে ঘরে বসে অনলাইনের মাধ্যমে কাটছেন। একইভাবে ট্রেনের টিকিটও অনলাইনে ছেড়ে দিন। তাহলে আর রেল স্টেশনে যেতে হবে না। বাসায় বসে নিজের কম্পিউটার থেকেই টিকেট কাটতে পারবেন। এটি করলে ট্রেনের অব্যবস্থাপনা কমে যাবে। ওটাকে আবার সেভাবে প্রটেক্টও করতে হবে। এজন্য শিক্ষার মানও বাড়াতে হবে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত শিক্ষাকে মেনডোটরি করা হয়েছে অথচ শিক্ষার মান বাড়ানো হবে না সেটা কি হয়? ফাইভ পর্যন্ত যে শিক্ষক পড়ায় তাদের ওইরকম কোয়ালিটি সম্পন্ন শিক্ষাই দিতে হবে। অথচ আমাদের শিক্ষকের কোয়ালিটি কিন্তু বর্তমানে খারাপ।

যে কারণে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভালো মানবসম্পদ তৈরি করতে হলে গোড়া থেকেই স্টেপ নিতে হবে। ফাইভ পর্যন্ত ভালো ব্যবস্থা করা হলে পরে আর কোচিং করতে হবে না। অথচ সেটিই অবহেলিত। প্রাইমারির শিক্ষকরা কেউ গভর্নমেন্ট এমপিও পায় তো কেউ পায় না। কেউ দোকান চালায়, পান বিড়ি বিক্রি করে আবার টিচিং করে, কেউ হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। কারণ তাদের খুবই কম বেতন দেয়া হয়। এখানে আমি মনে করি খুব ভালো টিচার দেয়া উচিত। এডুকেশনে যারা ডিগ্রি নেয়া তাদের নিয়োগ দিতে হবে। এজন্য তাদের স্যালারি স্ট্রাকচারও সেভাবে দিতে হবে। তখন দেখবেন শিক্ষার মানও উন্নয়ন হবে একই সাথে অটোমেটিকলি সব কিছু চেঞ্জ হয়ে হয়ে যাবে।

অটোমেশন করতে হলেও তো সেরকম লোক দরকার। যে টিকিটটা অটোমেটিক ওয়েতে কাটতে পারে। অটোমেশন দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়। এই যে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ অটোমেশন বুঝে না, যখন তখন হাত চালায় এর কারণ হচ্ছে তাদের শিক্ষা নেই। তারা বোঝে না। আপনি সিগন্যাল বসিয়েছেন অথচ অটোমেটিকলি কন্ট্রোল করতে পারছেন না।

আমাদের ফুটপাত কে বানিয়েছে জানি না। এখানে মানসম্পন্ন আর্কিটেকচার ব্যবহার হয়েছে কি না। আমি যতটুকু দেখেছি মিস্ত্রিরাই করেছে। দেখবেন, ফুটপাত রাস্ত থেকে অনেক উঁচু হওয়াতে মানুষ ওটা ব্যবহার করে না; রাস্তাই ব্যবহার করছে। এই বিষয়গুলোও গ্লোবাল প্রসেসে যেতে হবে। এখন সবকিছুই গ্লোবালাইজেশন হয়ে গেছে। এখন যদি আমরা গ্লোবাল ফেইসের সাথে যেতে না পারি তবে সব সেক্টরেই পিছিয়ে পড়তে হবে।

আমাদের খুব ভালো ভালো ক্রিকেটার আছে। তারা বাইরে গিয়ে স্ট্রাগল করছে। কারণ, একেক দেশের মাঠ একেক রকম। যত এসব মাঠে খেলবে তত নিজেকে ভালোভাবে তৈরি করতে পারবে। তত ভালো খেলতে পারবে।

সৈয়দ এরশাদ আহমেদ

সাবেক প্রেসিডেন্ট, ফরেন ইনভেস্টরস্ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-এফআইসিসিআই

সাবেক প্রেসিডেন্ট, আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ-এ্যামচেম