বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আত্মস্বীকৃত খুনি মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
গতকাল বুধবার বিকেলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার এই আবেদন করে খুনি মাজেদ। কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে খুনি মাজেদের প্রাণভিক্ষার আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে বঙ্গভবনে পৌঁছায়।
প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য তা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আজ বাসস’কে বলেন, প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের পর মাজেদের সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনের সাক্ষাৎ হতে পারে। তিনি বলেন, ফাঁসির রায় কার্যকরে কারা কর্তৃপক্ষের আর কোনো বাঁধা নেই। রায় কার্যকর এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
গতকাল আদালত কর্তৃক মৃত্যুর পরোয়ানা কারাগারে পৌছানোর পর তা মাজেদকে পড়ে শুনানো হয়। এর পর পরই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করে খুনি মাজেদ।
অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল আবরার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, সবদোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চায় মাজেদ। ‘আমরা তার আবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেই। গতকাল কারাগারে মৃত্যু পরোয়ানা পৌঁছালে তাকে পড়ে শোনানো হয়। পরে সে প্রাণভিক্ষা চায়।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, আবেদন খারিজের পর এখন মাজেদের সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনের সাক্ষাৎ হতে পারে। দন্ড কার্যকরে আর কোনো বাঁধা নেই। মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
তিনি বলেন, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা আপিল বিভাগের সামনে বিচারাধীন নেই এবং আপিল করার যে সময়সীমা ছিল তাও অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। এ কারণে এ আসামি আপিল করার সুযোগ ও অধিকার হারিয়েছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও বলেন, আবেদন খারিজের ফলে যেকোনো সময় মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর হবে। আর পলাতক থাকায় এই আসামি আপিল করার সব অধিকার হারিয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিল এই মাজেদ। তখন সে ছিল সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে ফাঁসির রায় মাথায় নিয়ে পলাতক অন্যতম আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) মাজেদকে সোমবার দিবাগত রাতে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন তাকে সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। গতকাল এ মামলার বিচারিক আদালতে তাকে আনা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে তার মূত্যু পরোয়ানা জারি করে আদেশ দেন আদালত। কালই এ পরোয়ানা কারাগারসহ সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় পৌঁছে দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার ৪৫ বছর, নৃশংস ওই হত্যাকান্ডের মামলার ২৫ বছর এবং উচ্চ আদালতের রায়ে ৫ আসামির ফাঁসি কার্যকরের ১১ বছর পর গ্রেফতার হয় খুনি মাজেদ। প্রায় ২৩ বছর খুনি মাজেদ ভারতে পালিয়ে ছিল বলে স্বীকার করে।
খুনি মাজেদ গ্রেফতার হওয়ার পর এখন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি পলাতক রয়েছে। তারা হল-খন্দকার আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ও এ এম রাশেদ চৌধুরী। তারা সবাই বরখাস্ততকৃত সাবেক সেনা কর্মকর্তা। এই পাঁচ খুনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পলাতক অবস্থায় আছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অরডিন্যান্স জারি করে। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহনের পর ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়।
একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকান্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর দায়ের করেন। ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনিদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।
বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। অন্যদিকে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় প্রদান করে। বিচারপতি এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ বজায় রাখেন। কিন্তু অপর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। পরে হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে ১২ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল থাকে।
পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে।
দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিমকোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।
২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর- ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তখন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।