বন্যার ঘাড়ে সওয়ার করে ঊর্ধ্বমুখী সবজির দাম

বন্যার কবলে পড়েছে দেশের উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চল। ভারত থেকে আসা পানি এবং দেশের অভ্যন্তরে অতিবৃষ্টি এ বন্যার কারণ। সদ্য বিদায়ী শ্রাবণে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি, সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বন্যার্তদের ঘরবাড়ি, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু।

এর প্রভাব পড়েছে রাজধানীর সবজির বাজারেও। রাজধানীর বাজারে বিভিন্ন ধরনের সবজির দাম গত এক মাসে ৫০ থেকে ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। দেশের এক তৃতীয়াংশে বন্যা হলেও এ দুর্যোগের অজুহাতে সারা দেশের খুচরা বাজারে হু হু করে বেড়ে গেছে সবজির দাম। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্যার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছেÑ তাই দাম বাড়ছে। অথচ তথ্য-উপাত্ত বলছে, দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলো বন্যাকবলিত। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল বন্যাক্রান্ত হয়নি, যেখানে দেশের মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ সবজি উৎপন্ন হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথমতে, দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৮.৫ মিলিয়ন হেক্টর। সবজি চাষে ব্যবহার হচ্ছে শতকরা ৯.৩৮ ভাগ জমি। এতে আমাদের মাথাপিছু সবজি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে ৭০ গ্রাম। যদিও একজন সুস্থ সবল মানুষের জন্য প্রতিদিন ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

কারওয়ানবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি ট্রাকে ৬ টন পণ্য বহনের কথা থাকলেও ৯ টন পর্যন্ত বহন করা হয়ে থাকে। একটি ট্রাকের প্রতিদিনের গড় ভাড়া প্রায় ১০ হাজার টাকা। দক্ষিণাঞ্চল থেকে মাওয়া কিংবা পাটুরিয়া ফেরিঘাট হয়ে ট্রাক আসত। কিন্তু সম্প্রতি ভারী বর্ষণের ফলে এই ফেরিঘাটে মাত্র একটি করে ফেরিঘাট চালু রয়েছে। যার ফলে সব ট্রাক যমুনা সেতু হয়ে আসছে। এ কারণে অতিরিক্ত সময় লাগে প্রায় দুই দিন। আর ট্রাকের অতিরিক্ত দুদিনের বাড়তি ভাড়ার পাশাপাশি এ দুদিনে কাঁচা সবজির অনেকাংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ট্রাকের ভাড়া বাবদ বাড়তি খরচ এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার ক্ষতি যোগ হচ্ছে পণ্যের দামের সঙ্গে।

বাজার পরিস্থিতিতে দেখা যায়, এক মাসের ব্যবধানে পণ্যের দাম প্রায় ২৫০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত শুক্রবার বাজারে কাঁচামরিচ কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১৬০-২০০ টাকা দরে। যা মাসখানেক আগে ছিল মাত্র ৭০-৮০ টাকা। এ ছাড়া বেগুন কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০-১০০ টাকা দরে। একমাস আগে ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি। এ ছাড়া ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া শিম একমাস আগে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। আর হাইব্রিড টমেটো ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও একমাস আগে ছিল ১২০ টাকা। একই সময়ের ব্যবধানে দেশি টমেটো ৮০ টাকা কেজি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ টাকা; দেশি পেঁয়াজ ২০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০-৬৫ টাকা; দেশি আদা ৪০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৮০ টাকা; আমদানিকৃত চীনের আদা ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ১৪০ টাকায় ঠেকেছে।

দেশের এক-তৃতীয়াংশ পানির নিচে। কিন্তু বন্যাকবলিত হয়নি এমন দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের জেলা থেকে আসা সবজির দাম কেন বেশি? কারওয়ানবাজারের একাধিক পাইকারি ব্যবসায়ী জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতি হওয়ায় পরিবহন খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে। তাই ক্ষতি পোষাতে দাম বৃদ্ধি করতে হয়েছে।

শাকসবজি উৎপাদনে নতুন রেকর্ড অর্জন করেছে বাংলাদেশ। গত বছরের চেয়ে বাড়িয়ে এবার রবি মৌসুমে ৫ দশমিক ২৮ লাখ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করা হয়েছিল, অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে এবার দেশে সবচেয়ে বেশি সবজি উৎপাদিত হবে। কিন্তু বন্যার কারণে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।

সূত্র জানায়, খরিপ-১, খরিপ-২ এবং রবি মৌসুমে দেড় লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে শাকসবজির আবাদ হয়েছে। সবজি চাষের ফলে চাষিদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেছে। কিন্তু এবারের দুর্যোগ তাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে। তবে এদের পুনর্বাসনে সরকার সব কিছু করবে।
জানা গেছে, খরিপ-১ মৌসুমে উত্তরের ১৬ জেলার কৃষকরা ঢেঁড়স, পটোল, চিচিঙ্গা, পুঁইশাক, বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, পানি কুমড়া, চালকুমড়া ইত্যাদি; রবি মৌসুমে মুলা, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লালশাক, পালংশাকসহ অন্যান্য সবজি আবাদ করে থাকেন। এই ১৬ জেলায় রবি ও খরিপ মৌসুমে দেড় লাখ হেক্টর জমি থেকে ২৮ লাখ ৫০০ টন করলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লালশাক, পুঁইশাক, মুলা, টমেটো, বুমড়াসহ বিভিন্ন শাকসবজি উৎপন্ন হয়েছে। প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদন হয়েছে ১৯ টন। সূত্র জানায়, দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজও দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশে সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। রবি মৌসুম বিশেষ করে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে চাহিদার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি সবজি উৎপাদিত হয়।

আজকের বাজার: আরআর/ ২৭ আগস্ট ২০১৭