বর্তমান জঙ্গিবাদ, ব্রিটিশ বাংলাদেশী প্রজন্মের ভাবনা

মুনজের আহমদ চৌধুরী:
ব্রিটেনে বাংলাদেশী মুসলিম তরুনদের অনেকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন আইএস কে। বিষয়টি সম্প্রতি ব্রিটেনে পরিচালিত একাধিক জরিপেও উঠে এসেছে।
আইএস এর পুরো কর্মতৎপরতা সম্পর্কে তাদের অনেকেরই সম্যক ধারণা নেই। তবু, তারা মনে করছেন আফগানিস্তান,সিরিয়ার মতো দেশে দেশে সন্ত্রাসের নামে, যুদ্ধের নামে নিরপরাধ নিরন্ত্র মানুষকে হত্যা করছে পশ্চিমা শক্তি। এক্ষেত্রে আইএস পাল্টা জবাব বা তাদের ভাষায় অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা অনেকের সাথেই এসব বিষয়ে সুযোগ পেলে কথা বলি। স্পর্শ করতে চাই জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষিতে অনিরাপদ তাদের আপন জন্মভুমি ব্রিটেন নিয়ে, তাদের অনূভুতির জায়গা নিয়ে। তাদের অনেকের বক্তব্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিবিসি বা বিবিসির মতো পশ্চিমা বিশ্বের মূলধারার বেশিরভাগ মিডিয়া জঙ্গিবাদ বা ধর্মের নামে সন্ত্রাসের খন্ডিত খবর প্রচার করছে। প্রজন্মের বড় একটি অংশের ভাবনা, সিরিয়ায় যখন মার্কিন বোমায় হাজার শিশু মারা যায় তখন পুজিঁবাদের সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়া সঠিকভাবে তুলে আনে না। আসলে চোখ দিয়ে আমরা যা দেখি, সে চোখের দেখাতেও দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্যে খন্ডিত দেখবার সুযোগ যে থাকে, তা বোধকরি সত্যি।
আজকে ব্রিটিশ মিডিয়ায় আলোচনায় ব্রিটিশ বিশ্লেষকরা বলেন, ব্রিটেনের আজকের ব্রিটিশ বাংলাদেশী প্রজন্ম আর সব এথনিক মাইনোরিটির মুসলমানদের মতো আবেগ বা মনোজাগতিকভাবে সিরিয়া বা ফিলিস্তিনের মার খাওয়া মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রবণ। ব্রিটেন যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, অনেক ব্রিটিশ তখন নিজ দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছেন। অনেকের প্রকাশ্য অপকাশ্য সমর্থন রয়েছে। আর সে সহানুভুতির সুযোগটি আইএস বা জঙ্গি সন্ত্রাসীরা কাজে লাগাচ্ছে।
এ লেখার উদ্দেশ্য আজকের ব্রিটিশ তরুন মুসলিমদের সে সহানুভুতি সৃষ্টির উৎসের সন্ধান। আশার কথা হল গত নির্বাচনে লেবার লীডার করবিনের মোহন বাশি ব্রিটেনের ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব প্রজন্মকে বাম ধারায় কিছুটা হলেও ফেরাতে পেরেছে। অন্ধ ডানের উল্টো ডানায় বিশ্বময় এখন ভর করেছে সন্ত্রাসবাদ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর পুঁজিবাদী পশ্চিমা বিশ্বের একটি শত্রু শত্রু খেলার প্রতিপক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আর পবিত্র ধর্ম ইসলাম একই সাথে ধর্ম ও রাষ্ট্রচিন্তা দুটিকেই ধারণ করে। এক্ষেত্রে তারা গনতন্ত্রের নামে প্রভাব আর অস্ত্রের খেলায় বেছে নেয় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে। লিবিয়ায় গাদ্দাফীকে উৎখাত করেছে পশ্চিমা বিশ্ব, গনতন্ত্র দেবার নামে। কিন্তু পুরো লিবিয়া জুড়ে আজ সংঘাত।
আফগানিস্তানে নজীব উল্যা সরকারকে উৎখাত করার পর খাল্ক এবং পারচম পার্টির লোকজন মোল্লা ওমরের তালেবান কিংবা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার, গোলাম রব্বানীদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। মোল্লা ওমরইতো আমেরিকার সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানব ! একইভাবে ইরাকে সাদ্দাম হোসেন এর সেনাবাহিনীর সদস্যরাও আমেরিকার সৃষ্ট আইএস এ যোগ দেয়। ইসলাম ধর্ম যেহেতু একই সাথে ধর্ম এবং রাষ্ট্রচিন্তার, সে কারনেই পুঁজিবাদ ইসলাম ধর্মকে তাদের প্রতিপত্তি অব্যাহত রাখার জন্য প্রতিপক্ষ বানাতে সহজ হয়েছে। ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিধি নিষেধ, ইহুদী- খ্রীষ্টানদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি বিষয়কে সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছে। (খাল্ক এবং পারচম পার্টির তথ্যসুত্র নুরুর রহিম নোমানের সাক্ষাতকার ভিত্তিক লেখা)।
কিন্তু গণতন্ত্র আনার নামে লাখো মানুষের প্রান গেল দেশে দেশে, গণতন্ত্র কি এসেছে। তরুন প্রজন্মের ব্রিটিশ বাঙ্গালীদের এমন কথার উত্তরে হয়তো তর্ক করা যায় আরো কিছুক্ষন, কিন্তু সংগত উত্তর দেয়া যায় না।

একবার এক ব্রিটিশ বাংলাদেশী তরুনী যার জন্ম এদেশে সে আমায় চমকে দিয়ে বলেছিল, ব্রিটেন ছেড়ে দেশের বাইরে মাসখানেক থাকলে সে নাকি এ দেশের মাটির ঘ্রানটা খুব মিস করে।
ঠিক, ব্রিটেন তাদের জন্মভুমি। এ মাটিতে বড় হয়ে ওঠা, শৈশব-কৈশোর সব তাদের। জন্মভুমির মায়ার টান পিছু ফেলে তবু কেন ২০১৪ বা ২০১৫ সালে বহু ব্রিটিশ বাঙ্গালী স্কুল ছাত্রী সিরিয়ায় পাড়ি দিল প্রকারান্তরে নিজ মাতৃভুমির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে? মা-বাবা ভাই বোন, ভবিষ্যতের উজ্জল হাতছানি সব পিছু ফেলে? শুধু কি কথিত ব্রেন ওয়াশ? নাকি এর নেপথ্যে বহুকাল থেকে জাল বিস্তার করা ভয়াল ষড়যন্ত্রের জাল। গত আট নভেম্বর কথিত জিহাদে আইএস এ যোগ দেয়া ব্রিটিশ বাংলাদেশী জয়া চৌধুরীর আমেরিকার দ্যা আটলান্টিককে সাক্ষাতকারে ব্রিটেনে বর্নবাদ নিয়ে খোলামেলা মন্তব্য করেছেন।
ঐ সাক্ষাতকারে জয়া বলেন,‘লন্ডনে বেড়ে ওঠার সময় এখানকার বর্ণবাদই তার মধ্যে মৌলবাদ এর বীজ বুনে দিয়েছে। আমার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ পরিবারকে বর্ণবাদীদের হাতে লাঞ্চনার শিকার হতে দেখেই আমি ধীরে ধীরে মৌলবাদের পথে ঝুঁকে পড়ি’।
“লন্ডনে বেড়ে ওঠার সময়টা কঠিন ছিল। আমার পরিবার ছিল হতদরিদ্র, আমরা ছিলাম অভিবাসী দ্বিতীয় প্রজন্ম এবং চূড়ান্ত বর্ণবাদের শিকার। যখন হীনম্মণ্য প্রতিবেশিকে আমাদের বাড়ির জানলা ভেংগে গুড়িয়ে দিতে দেখেছি, তখন থেকে আমার নিজেকে বহিরাগত মনে হতে শুরু করে। আমি হারানো সম্মান ফিরে পাবার একটা পথ খুঁজছিলাম। আল কায়েদার ৯/১১ আক্রমণ এর সময় আমার বয়স ছিল ১৪ বছর, তার কিছুদিনের মাথায় কিশোরী থাকাকালীন একটি মৌলবাদী আলজেরীয় দলের সংগে যুক্ত হয়ে আমার জিহাদি জীবন শুরু হয়।” ৩৩ বছর বয়সী জয়া বর্তমানে আমেরিকার টেক্সাসে বসবাস করছেন।

ব্রিটেনে কীভাবে একজন কিশোর জঙ্গি হয়ে উঠেছে। তার পেছনে কী ধরনের ঘটনা বা প্রবণতা কাজ করেছে। নীতিনির্ধারক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সন্ত্রাসবাদ দমনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা তো অবশ্যই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরাও এ বিষয়ে নিজেদের ব্যাখ্যায় উত্তর খুজঁবার চেষ্টা করেছেন করছেন।

প্রথমত
কোনো ব্যক্তি হঠাৎই ধর্মের নামে সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে না। বরং এটি একটি প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়, অর্থাৎ এই পর্যায়ে যাওয়ার অনেক আগেই এর সূচনা হয় এবং বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে ওই তরুনটিকে সিরিয়ায় পাড়ি দিতে হয়। অথবা বারবার নিগৃহিত হবার কারণে অসহায়ের মতো মতো ম্যানচেষ্টারে হাজার মানুষের খুনি হতে হয়। প্রক্রিয়াটা একরৈখিক নয়। এই প্রক্রিয়াকে আমরা বলতে পারি র্যডিকালাইজেশন।
ইউরোপের সমাজে বিরাজমান কিছু বাস্তবতা ও প্রবণতাকে কাজে লাগায় সন্ত্রাসের হোতারা। ব্রিটেনে আমাদের শিশুরা ঘরের বাইরে গেলে দেখছে অবারিত উন্মুক্ত জগৎ। সেখানে ঘরে ফিরলে থাকছে ধর্মীয়, সামাজিক, পারিবারিক অনূশাসনের অদৃশ্য বা দৃশ্যমান দেয়াল। আমাদের মা বাবারা শৈশবে এখনো সন্তানের সাথে অনেক বিষয়ে আলোচনায় স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না। এক্ষেত্রে অনেক প্রশ্নের প্রকৃত উত্তরের খোজঁ করতে নেমে শিশুটিকে ভ্রান্তিতে পড়তে হয়।

যে আরবী শিক্ষক বা প্রতিষ্টানে গিয়ে শিশুটি শিখছে সেখানে অনেক ক্ষেত্রে থাকছেন ভিন্ন মতবাদের শিক্ষক। মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি লিখেছে, বর্তমান বিশ্ব সৌদি আরবের ছড়িয়ে দেয়া সন্ত্রাসবাদের ফল ভোগ করছে। এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দৈনিকটি লিখেছে, ওয়াহাবি মতবাদের বিস্তার ঘটানোর জন্য সৌদি আরব প্রচুর অর্থ খরচ করছে এবং দায়েশসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মূল চিন্তাদর্শন হচ্ছে ওয়াহাবি মতবাদ।
সেখান থেকেই বাংলাদেশ থেকে বড় হয়ে আসা শিশুটি তার মা বাবার ধর্মচর্চার মতবাদ বা পদ্বতিগত পুরোনো প্রথাকেও কখনো ভুল হিসেবে পরিগনিত করে। আমাদের উপমহাদেশে ইসলামের আগমন সুফীবাদের পথ ধরে। অথচ ব্রিটেনের বহু মসজিদ বা ধর্মীয় প্রতিষ্টান সৌদির দেখানো মতবাদকেই শুধুমাত্র সঠিক মনে করেন। অর্থাৎ এখানে বাংলাদেশ বা ভারতীয় মা বাবার সন্তানটির ধর্ম চর্চায় ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে। ধর্মের চর্চা আর আমাদের চিরায়ত বহমান বাঙ্গালীয়ানার প্রথা কোন কোন ক্ষেত্রে যে সন্তান অভিভাবকের ক্ষেত্রে দুরত্ব তৈরী করছে না, তা কিন্তু নয়।
অবশ্যই ধর্মের অপব্যাখা একটি বড় কারন। তরুন ছেলে মেয়েদের অবদমিত কামনা বাসনাকেও কাজে লাগাচ্ছে এই বলে, ধর্ম রক্ষার জন্য যুদ্ধাবস্থায় এই অবদমিত কামনা বাসনা মেটানো পাপ নয় ! ব্রিটেন এখন সারা বিশ্বের বহু ধর্ম বর্নের মানুষের এক বৈশ্বিক রাষ্ট্র। শিশুটি যখন স্কুলে যাচ্ছে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় তার বন্ধু হচ্ছে বিভিন্ন দেশের অভিবাসী মুসলিম শিক্ষার্থীরাও। স্বভাবতই শিশুটির মধ্যে বন্ধুদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ভাবনা প্রভাব ফেলছে।
ব্রিটেনে সোমালীয়রা যেভাবে সাজসজ্জা, জোব্বা বা হিজাব পরে, সেটিকে ইসলামী ফ্যাশনের পোশাক হিসেবে পরিগনিত করার ট্রেন্ড চলছে এখন। আর এ সুযোগে ধর্মকে পন্য বানিয়ে বার্বিডলে হিজাব পরাচ্ছে পুঁজিবাদ। আর ব্রিটেনে যে বর্ণবাদ এখন বিলীন সেটিও নয়। বরং সাম্প্রতিক ম্যানচেষ্টার ও লন্ডন হামলার পর শ্বেতাঙ্গদের শারীরিক হামলার শিকার আর টার্গেটে পরিনত হয়েছেন মুসলিমরা। এ ধরনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিগ্রহ শিশু মনে প্রভাব ফেলে নিঃসন্দেহে।

দ্বিতীয়ত
ধর্ম,অভিবাসী নিয়ে ক্ষমতাবানদের রাজনীতিও একটি কারণ। লন্ডনে আঞ্জিম চৌধুরীর মত ধর্মীয় উগ্রবাদীরা বরাবরই মাইক লাগিয়ে সন্ত্রাসবাদের উস্কানী দিয়ে গেছে এতকাল। তখন কি ব্রিটিশ সরকার আধো ঘুমে ছিল? আজ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ম্যানচেষ্টার ও লন্ডন ব্রিজ হামলার পর বলছেন, এনাফ ইজ এনাফ। এই বিলম্বিত বোধদয় কেন?
২০০৬ সাল থেকে হোম সেক্রেটারী হিসেবে আজকের প্রধানমন্ত্রীই ছিলেন ব্রিটেনের সেফটি-সিকিউরিটির দায়িত্বে। তার মেয়াদকালে কমপক্ষে ৪০০ ব্রিটিশ জিহাদী সিরিয়া থেকে ব্রিটেনে ফিরলেও সরকার আটকেছে মাত্র একজনকে। এখন দুর্বল এক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেবল মুসলিম নয় ব্রিটিশ জনগনের এমন প্রশ্নের উত্তর দেবার পথ খুজঁতে হবে থেরেসাকে। ব্রিটেনে গত কয়েক বছর ধরে সেবা খাতে অব্যাহত বাজেট কাটে ভুক্তভোগী হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষরা।
ডিজেবিলিটি এলাউন্সের মত সংবেদনশীল খাতে সরকার বাজেট কমিয়ে সে অর্থ ব্যায় করছে সিরিয়ার মতো দেশে! সেখানে বিদেশে মোড়ল সাজতে গিয়ে অস্ত্রবাজিতে অর্থব্যায় অন্যায় হিসেবেই দেখছেন বহু ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গরা। পুলিশ পর্যাপ্ত সেবা দিতে পারছে না অর্থের সংকটে। এমন বাস্তবতায় বিদেশে শান্তি বা অশান্তি কোন যুদ্ধেই শক্তি বা সামর্থ্যের ব্যায়কে অপচয় মনে করছেন সাধারন মানুষ। যেখানে ছেলে বা মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি যোগাতে পারছে না তবু সরকার ফি বাড়াচ্ছে। আর সে অর্থে ছুড়ছে বোমা। অস্বীকার করবার উপায় নেই, ব্রিটেন এখনো বিশ্বের অন্যতম অস্ত্রবিক্রেতা রাষ্ট্র। মারনাস্ত্র কি শান্তি আনতে পারে? রাজনৈতিক সাম্যহীনতা, সামাজিক বঞ্চনা, অদৃশ্য বর্নবাদকে যদি আমরা জঙ্গিবাদ থেকে একেবারে আলাদা করতে চাই ব্রিটেনের প্রেক্ষিতে, তবে সে বিশ্লেষন পুর্নাঙ্গতা পাবে না।
ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত রিলেটিভ ডিপ্রাইভেশন বা আপেক্ষিক বঞ্চনার অভিজ্ঞতা বা বোধ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ বা তরুনদের হতাশার নেতিবাচক উপাদান। আপেক্ষিক বঞ্চনার বোধকে শিশুমন মারাত্বক প্রভাবিত করে। তরুণ বা শিশুটি যখন অন্যদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে এবং দেখতে পান যে অন্যরা তুলনামূলকভাবে ভালো আছেন, তখন তাঁর ভেতরে একধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই ভালো থাকাটা হতে পারে বৈষয়িক, হতে পারে সাংস্কৃতিক, হতে পারে সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে। এই পার্থক্যকে যখন অন্যায় ও অন্যায্য বলে মনে হয়, তখনই এই পার্থক্যের বিষয়টি মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এই আপেক্ষিক বঞ্চনার বোধ তৈরি হয় যখন একজন ব্যক্তি দেখেন যে অতীতে যেসব অধিকার তিনি ভোগ করে এসেছেন তা সীমিত হচ্ছে বা অন্যরা এখন তাঁর চেয়ে বেশি অধিকার ভোগ করছেন। ইউরোপের মুসলিম সমাজের মধ্যে, এমনকি দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের ভেতরেও, এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা গেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সমাজে একীভূত হওয়ার বা ইন্টিগ্রেশনের অভাব। ভারতীয়রা যেখানে দ্রুতলয়ে মিলছে ব্রিটেনের মূলধারায়, সেখানে বাংলাদেশী পুর্ববর্তী প্রজন্ম এখনো নিজেদের কমিউনিটি সংগঠন নিয়ে ব্যস্ত। ভুলের বেহালা আসলে একহাতে বাজে না।
ব্রিটেনের সমাজব্যবস্থায় এখনো অনেকে মনে করেন, সমাজকাঠামো ও বিরাজমান ব্যবস্থা তাঁকে ও তাঁর সম্প্রদায়কে আলাদা করে রাখছে এবং বঞ্চিত করছে। বাস্তবে বিরাজমান কিছু পরিস্থিতিই তাঁদের এই ধারণার জন্ম দেয়।
বিশ্বময় আধুনিক জঙ্গিবাদের জন্য অনেকে রিলিজিয়াস ফ্যানাটিজম বা ধর্মীয় উন্মাদনার উগ্র উত্থানকে দায়ী করেন। কিন্তু আমি এটিকে একমাত্র কারণ হিসেবে দেখি না অন্তত ব্রিটেনের বাস্তবতায়। জঙ্গি মানসিকতার সৃষ্টিস্থল এবং কেন এ প্রনোদনায় কিছু মানুষ প্রলুব্ধ হচ্ছে, সেখান থেকে শুরু করতে হবে আমাদের। ইসলাম সব সময় সন্ত্রাসকে না বলেছে। ধর্মের নামে চরমপন্থার কথা পবিত্র কোরআনে কখনো বলা হয়নি।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় জীবন বিধানে চিত্ত বিনোদনের সুযোগের অপর্যাপ্ততার অনুযোগ, জিহাদের নামে সিরিয়া যাবার ভ্রষ্ট রোমান্টিসিজম, ধর্মের অপব্যাখ্যা আসলে সংকটের উপসর্গ, অসুখ নয়। কিছু মানুষের মনোবিকার, বিশ্ব রাজনীতির ঘোরপ্যাচে দেশে দেশে জঙ্গিবাদের প্রতি ক্ষমতার নেপথ্য আনুকূল্য আর বিভাজনের বৈষম্য পরিবেশে এবং পরিস্থিতি ভেদে ভিন্ন আঙ্গিক পায়। আর এসব উপাদানগুলোকে একত্র করে পুজিঁবহুল পেশি, মারনাস্ত্র বানিজ্য, দেশীয়-আন্তর্জাতিক মহলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় আধিপত্যবাদের হোলিখেলা শুরু হয়।
বিজ্ঞানও জঙ্গিবাদের সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ নির্ণয়ে অনেকখানি অক্ষম। পুজিঁ আর পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদ, সালাফী হানাফির পশ্চিমাসৃষ্ট সৌদি বিবাদ অবশ্যই ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের দায় এড়াতে পারে না। আবার এ বাস্তবতার উল্টোপিঠে আমরা দেখি ইসলামের নাম ভাঙ্গানো সন্ত্রাসের প্রকৃত স্বরূপ।
আইএস যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ বিশ্বজুড়ে হামলা চালালেও তারা কেন ইসরায়েল নিয়ে টু শব্দটিও করে না? কেন তারা জিহাদের নামে পাশের ইসরাইলে হামলা চালাবার সাহস করে না! জঙ্গি সন্ত্রাসের মূল শক্তি সাম্যহীন ভংগুর সমাজ। আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো দেশে জঙ্গিবাদ পরিপুষ্ট হচ্ছে বিদেশী এবং তাদের দেশীয় দালালদের অর্থনৈতিক অভিপ্রায় থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের তাগিদে।

জাতি হিসেবে সমান্তরালে অসম অদ্ভুত সব বৈপরীত্যকে আড়ালে আবডালে কখনো বা প্রকাশ্যে সমর্থন যোগাই আমরা। পাকিস্তান গড়তে এগিয়ে ছিলাম আমরা। ব্রিটেনে ধর্মের নামে জঙ্গিবাদের শুরুটা ছিল পাকিস্তানীদের দিয়ে। আজ তারা সুকৌশলে পেছনে সামনে আমরা। আমরা এদেশে রোজগার করি, ওয়েলফেয়ার বেনিফিট পাই, এদেশের চার্চ কিনে মসজিদ বানাই। আবার ধর্মের নামে সন্ত্রাসীদের হাতে ব্রিটিশ জনগণ মারা গেলে অনেকে বলেন ‘প্রতিবাদ’। ফেসবুকে ইসলামীক পেইজ আর ১৮ প্লাস পেইজ দুটোতেই কিন্তু সমানে লাইক দিই আমরা। কাভার পিক আর প্রোফাইলে কাবা ঘর থাকলেও, ওয়ালময় নগ্নতা। হিজাব আর সেক্সী নারী দুটো আমাদের কামনা বলেই হিজাবকেও হতে হয়েছে আকর্ষনীয় অনুসঙ্গ। আমরা হালাল খুজিঁ পন্যের মোড়কে, কিন্তু ‘হালাল’ সীসাবারে রাতভর চলে নেশা আর ফুর্তি। ছেলে মেয়েরা সেখানে একসাথেই থাকেন। ব্রিটেনে এখন আমরা নেশার মধ্যেও হালাল-হারামের ডেফিনেশন করে দিয়েছি। ‘‘বলিহারী যাই এমত ধর্মচর্চার’’।

ক্ষমা করবেন প্রিয় পাঠক, সবার কথা বলছি না। ব্যাতিক্রম তো অবশ্যই আছেন। কিন্তু ব্যাতিক্রমের কী আর সাধ্য থাকে যাপিত বাস্তবতাকে অতিক্রম করবার।

মুনজের আহমদ চৌধুরী
সাংবাদিক ও সদস্য, রাইটার্স গীল্ড অফ গ্রেট বৃটেন
(এ মতামত কেবলই লেখকের নিজস্ব)
আজকের বাজার: ২০ নভেম্বর ২০১৭