বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করেছে আইএসএন?

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তথ্য প্রযুক্তি খাতের কোম্পানি ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক লিমিটেড-আইএসএন। কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ৩০ জুন ২০১৮ সমাপ্ত বছরের আর্থিক প্রতিবেন পর্যালোচনা করে ১শতাংশ ক্যাশ এবং ৪শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেন। গত ২৯ অক্টোবর এই লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়। ৫বছর পর এই ডিভিডেন্ডের ঘোষণা দিল কোম্পানিটি। লভ্যাংশ পাওয়ার জন্য রেকর্ড ডেট নির্ধারণ করা হয় ১৮ নভেম্বর এবং এজিএম-এর তারিখ নির্ধারণ করা হয় ৯ ডিসেম্বর ২০১৮।

কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শেয়ার প্রতি আয় আটচল্লিশ পয়সা। নীট সম্পদ মূল্য বা এনএভি শেয়ার প্রতি ১২ টাকা ৫৬ পয়সা। কোম্পানিটির পরিচালন নগদ প্রবাহ শেয়ার প্রতি ঋণাত্বক ৫২ পয়সা (.৫২)। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে কোম্পানিটির বিগত তিন বছরের শেয়ার প্রতি আয় বা ইপিএস তুলে ধরা হলো। ২০১৭ সালে ইপিএস ছিল ঋণাত্বক ৫২ পয়সা (.৫২)। ২০১৬ সালে ইপিএস ঋণাত্বক ৭৩ পয়সা (.৭৩)। ২০১৫ সালেও ইপিএস ছিল ঋণাত্বক ৭৩ পয়সা (.৭৩)।
এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি এবছর ২০ জুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য একটি সাধারণ নোটিফিকেশন জারি করে। যেটার স্মারক নং – BSEC/CMRR CD/ 2016-158/208/ADMIN/81, Dated june 20, 2018.

এই নোটিফিকেশনে পরিস্কারভাবে বলা আছে, কোনো কোম্পানির সমন্বিত অর্জিত আয় যদি ঋণাত্বক হয়, তাহলে ওই কোম্পানি লভ্যাংশ দিতে পারবে না। এমন নির্দেশনা সম্বলিত নোটিফিকেশন জারির ৪ মাস পর, সমন্বিত অর্জিত আয় ঋণাত্বক থাকা সত্বেও আইএসএন কোম্পানি কেন লভ্যাংশ দেয়ার ঘোষণা দিল? এজিএম-এর দিন বিএসইসি’র নোটিফিকেশনের দোহায় দিয়ে ঘোষিত লভ্যাংশ বাতিল করলো এবং নো ডিভিডেন্ড পাশ করা হলো। তাহলে কি এটা প্রতারণা করা হলো না? এটাকে কি জেনে বুঝে, পরিকল্পণা করে প্রতারণা বলা যাবে না? কারণ, তারা তো নোটিফিকেশন জানেন না এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করেন নাই এবং এর জন্য কোনো ভুল স্বীকার কিংম্বা দুঃখ প্রকাশও করেননি। এখানে বিএসইসি বা ডিএসই কারোর কোনো পদক্ষেপও দেখা গেল না। তাদের উচিৎ ক্ষতির দিক বিবেচনা করে বিনিয়োগকারীদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ানো। এই প্রতারণায় কে কিভাবে, কতটা প্রতারিত হলো তা নিরূপন করা।

বিএসইসি’র নোটিফিকেশনের চার মাস পর ২১ অক্টোবর আইএসএন-এর প্রতিটি শেয়ার বাজারে লেনদেন হয় ২৫.৫০ টাকা দরে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে আইএসএনের প্রতিটি শেয়ারের দাম ওঠে ৪৩ টাকা। ঘোষিত রেকর্ড অনুযায়ী কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের দর দাড়ায় ৩৮.৮০ টাকা। ৯ ডিসেম্বর কোম্পানির এজিএম-এর দিন প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয় ৪৩ টাকায়। আর এজিএম-এ নোডিভিডেন্ড পাশ হওয়ার পরদিন, কোম্পানিটির শেয়ার কেনার জন্য ক্রেতা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। ওইদিন প্রতিটি শেয়ারের দর নেমে আসে ৩৪.৯০ টাকা। সবশেষ গত কার্যদিবস ১৩ ডিসেম্বরও কোম্পানিটির শেয়ারের ক্রেতা ছিল না এবং ১০ শতাংশ দর হারিয়ে প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৮.৪০ টাকা দামে। সামনে আরও কত দিন ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না সে প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গেল। কার কি পরিমান ক্ষতি হলো, তার উত্তর পাঠকদেরই খুঁজবার অনুরোধ রইলো।

এখন একটু শেয়ার হোল্ডিংয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েব সাইটে কোম্পানির দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পরিচালক বা উদ্যোক্তাদের শেয়ারের পরিমান একই রকম থাকলেও কমেছে প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের পরিমান। আর বেড়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের পরিমান। অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো ৬৪ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঠকানো হবে আর কত? এর সমাধান কোথায়? আসলেই কি সমাধান নেই?

মাত্র অল্প কিছু দিন আগে, একটি কোম্পানির যথেষ্ট আয় থাকা সত্বেও শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো ডিভিডেন্ড দেয়নি। এমনকি কোনো ব্যাখ্যাও দেয়নি। যদিও পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালিখি ও হৈ চৈ শেষে ব্যখ্যা দিয়েছে কোম্পানি। আমার ধারণা, এবার আইএসএনও হয়তো এর একটা ব্যাখ্যা দিবে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদে কী হবে?
আমি আমার আগের একটি লেখাতে স্বাধীন পরিচালক সম্পর্কে উল্লেখ করেছিলাম। এবারও বলছি, স্বাধীন পরিচালক, কোম্পানি সেক্রেটারি ও প্রধান হিসাব কর্মকর্ত-সিএফও’কে আরও সজাগ থাকতে হবে। আইন পরিপালন সম্পর্কে প্রয়োজনে বিএসইসি স্বাধীন পরিচালক, কোম্পানি সেক্রেটারি ও সিএফওদেরকে ৬মাস অন্তর অন্তর সকল নোটিফিকশন ও ডাইরেক্টিভ সম্পর্কে সেমিনারের মাধ্যমে আপডেটেড রাখতে পারেন।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বড় বড় কর্তা ব্যক্তিদের কাছ থেকে সবসময় শোনা যায়, পুঁজিবাজার হলো পুঁজি উত্তোলন করে ব্যবসা পরিচালন, সম্প্রসারন ও উন্নতি করণের মূল জায়গা। কিন্তু অনেকের আচরণ দেখে মনে হয়, আমরা পুঁজি উত্তোলনের জন্য যাদের আহবান করছি, তারা পুঁজি উত্তোলন করে শুধু তাদের নিজেদের পকেট ভরছেন। তারা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কথাতো ভাবেনই না, এমনকি রেগুলেটদেরও খুব একটা পাত্তা দেন বলে তো মনে হয় না। আর আইনের সঠিক প্রতিপালনতো বহুদুরের স্বপ্ন।

আমি যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করলাম, এগুলোর উন্নতি না হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা যাবে না এবং স্বপ্নের পুঁজিবাজার গঠন করা সম্ভব হবে না। পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি উত্তোলনের মানে এই নয়, যে কেউ এখান থেকে টাকা নিয়ে তার নিজের পকেট ভরবে। আর যাদের কাছ থেকে টাকা উঠালো সেই শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কিছু দিবে না। এ জন্য আমরা বলি, ভাল উদ্যোক্তা চাই, যারা শুধুই পুঁজি উত্তোলন করবে না বরং উন্নয়নের জন্যও কাজ করবেন এবং একবিংশ শতাব্দির পুঁজিবাজারে পরিনত করতে সহায়তা করবেন। এ জন্য পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারদের এখই সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়।

জোবায়ের হোসেন
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, স্টারলিং স্টকস্ অ্যান্ড সিকিউরিটিজ