বীমা প্রসঙ্গ: লাইফ ইন্স্যুরেন্স

লাইফ ইন্স্যুরেন্স (জীবনবিমা)এমনকি ‘ইন্স্যুরেন্স (বীমা)শব্দটি শুনলেও অনেক সময় আমাদের মনে এক ধরণের নেতিবাচক ধারণার উদ্ভব হয়। লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাবে কিংবা অনুমান নির্ভর কিছু ধারণার কারণে আমরা বেশিরভাগ মানুষই লাইফ ইন্স্যুরেন্স সম্পর্কে জানতে চাই না। এমনকি আমরা একজন বীমা এজেন্টের সাথেও লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পলিসি সম্পর্কে আলোচনা করতেও আগ্রহ প্রকাশ করি না। এছাড়াও, বিভিন্ন বীমা কোম্পানীর ওয়েবসাইট ভিজিট করেও যে আমরা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পলিসি সম্পর্কে জানতে পারি এবং ধারণা নিতেও পারি সে সম্পর্কেও আমরা অনেকেই অবগত নই। অথচ আমাদের আপদকালীন সময়ে এই লাইফ ইন্স্যুরেন্সই আমাদের জীবনকে সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে আমাদের জীবনযাত্রার মান অক্ষুন্ন রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের অহসায়কালীন সময়ে কিংবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে আমাদের কাছে বা অসহায় পরিবারের কাছে লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি থেকে অর্জিত/প্রাপ্ত সুবিধা হয়ে উঠতে পারে বেঁচে থাকার একটি অন্যতম অবলম্বন।

লাইফ ইন্স্যুরেন্স সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা ছিল, আছে এবং থাকবে। এসব ভুল ধারণা যেমন একদিনে গড়ে ওঠেনি ঠিক তেমনি এসব ভুল ধারণা একদিনেও দূরীভূত হবে এমনটাও আশা করা যায় না। জীবনটা আপনার, পরিবারও আপনার। তাই আপনার অবর্তমানে পরিবারের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্বও আপনার। আসুন আমরা লাইফ ইন্স্যুরেন্স সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণাগুলো বদলে ফেলার চেষ্টা করি এবং নিজেদের জীবনকে সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি আর্থিকভাবে সুরক্ষিত রাখি নিজেকে ও আমাদের পরিবারকে। লাইফ ইন্স্যুরেন্স সম্পর্কে আমাদের মাঝে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা রয়েছে এবং এই ধারণাগুলো কতটুকু যুক্তিযুক্ত সে বিষয়ে আলোচনা করা যাকঃ

১। মৃত্যু ব্যতীত লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির অধীনে বীমা দাবীর টাকা পাওয়া যায় নাযখন আমরা লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির কথা ভাবি, বেশিরভাগ সময় এটাই মনে করি যে, বীমা গ্রাহকের (বা বীমাকৃত ব্যক্তি) মৃত্যুতেই কেবল লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির অধীনে প্রদেয় বীমা দাবীর টাকা পাওয়া যাবে। অন্য কোন ভাবেই পলিসির অধীনে বীমা দাবীর টাকা পাওয়া সম্ভবপর নয়। ব্যাপারটা কিন্তু সবসময় এরকম নয়। বীমা কোম্পানী কর্তৃক নির্ধারিত (বা স্বল্প পরিমাণ) অতিরিক্ত প্রিমিয়াম প্রদানের মাধ্যমে আপনি মূল পলিসির সাথে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী আরো কিছু সম্পূরক বীমা চুক্তি (রাইডার) নিতে পারেন, যা আপনার মূল পলিসির মেয়াদকালে মূল পলিসির পাশাপাশি আপনাকে আরো নানা রকম বাড়তি সুবিধা প্রদান করবে। এটা হতে পারে মারাত্মক অসুস্থতা সংক্রান্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা, জটিল রোগের চিকিৎসা, আংশিক অক্ষমতা, সম্পূর্ণ ও স্থায়ী অক্ষমতা, হাসপাতালে ভর্তিকালীন দৈনিক আয়, প্রিমিয়াম মওকুফ ইত্যাদি সহ আরো অন্যান্য সম্পূরক বীমা চুক্তি (রাইডার)। পাশাপাশি, আপনার জন্য বিভিন্ন রকম সুবিধা সম্বলিত পলিসি রয়েছে যেগুলো পলিসি চলাকালীন সময়ে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর বীমা গ্রাহককে পলিসি চুক্তিতে বর্ণিত পরিমাণ বীমাকৃত অর্থ পরিশোধ করে থাকে, যা বীমা গ্রাহককে অর্ন্তবর্তীকালীন বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারে। সুতরাং, লাইফ ইন্স্যুরেন্স যে শুধুমাত্র বীমা গ্রাহকের (বা বীমাকৃত ব্যক্তি) মৃত্যুতেই বীমাকৃত অর্থ বা বীমা দাবীর অর্থ প্রদান করে ব্যাপারটা মোটেই এমন নয়; বরং পলিসি চলাকালীন সময়ে বীমা গ্রাহক বিভিন্ন রকম আকর্ষণীয় সুবিধা পেতে পারেন, যা বীমা গ্রাহকের আপদকালীন সময়ে আর্থিক প্রয়োজনীয়তা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করে।

২। আমার অবর্তমানে নমিনি বীমা দাবীর টাকা নাও পেতে পারে বীমার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো– ‘বীমাযোগ্য স্বার্থ’। যেখানে বীমাযোগ্য স্বার্থ নেই, সেখানে বীমা পলিসি করা সম্ভব নয়। যেমনমানুষের নিজের জীবনের ওপর তার বীমাযোগ্য স্বার্থ থাকে। স্বামীস্ত্রী উভয়ের জীবনের ওপর বীমাযোগ্য স্বার্থ থাকে। বীমাযোগ্য স্বার্থসহ অন্য সব তথ্য সঠিক থাকলে বীমা গ্রাহকের অবর্তমানে বীমা দাবীর অর্থ নমিনির পেতে কোনো সমস্যা হয় না। বীমা গ্রাহক (বা বীমাকৃত ব্যক্তি) মৃত্যুতে, বীমা গ্রাহকের জীবদ্দশায় পলিসির মূল আবেদনপত্রে উল্লিখিত (বা মূল পলিসির সাথে পৃষ্ঠাঙ্কৃত) নমিনিকে বীমা দাবীর স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজাদি/প্রমাণাদি প্রদান সাপেক্ষে ও উহার সঠিকতা নির্ণয় করার পরে বীমা কোম্পানী কর্তৃক বীমা দাবী পরিশোধ করা হয়। পলিসিতে ভিন্নরূপ বিশেষ কিছু উল্লিখিত না থাকলে, দাবীদার কর্তৃক প্রয়োজনীয় কাগজাদি/দলিলপত্রাদি প্রাপ্তির ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যেই বীমা দাবী নিষ্পত্তি করা হয়।

বীমা আইন ২০১০ এর ৭২ ধারার বিধানে বলা আছে যে, দাবী প্রদানের জন্য সমস্ত কাগজপত্র দাবীদার কর্তৃক দাখিল করা হয়েছে এরূপ ক্ষেত্রে বীমাকারী অর্থাৎ বীমা কোম্পানী যদি দাবী পরিশোধের প্রাপ্য হওয়া বা দাবীদার কর্তৃক সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা পূরণের, যা পরে সংঘটিত হয়, ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে দাবী পরিশোধে ব্যর্থ হয় তাহলে উক্ত আইনের ৭২ () ধারার বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সুদ অর্থাৎ প্রচলিত ব্যাংক রেটের অতিরিক্ত শতকরা ৫ (পাঁচ) ভাগ হারে মাসিক ভিত্তিতে হিসাব করে বীমা দাবীর অতিরিক্ত হিসেবে দাবীদারকে পরিশোধ করতে হবে। স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স লিঃ বনাম মাক এন্টারপ্রাইজ লিঃ (২১ বিএলসি ২০১৬) রায়ের পর্যবেক্ষণে মহামান্য আদালত বলেন যে, সুদের মঞ্জুরি দেওয়া বাধ্যতামূলক এবং এটা আদালতের বিবেচনামূলক নয়। সুতরাং, সংবিধিবদ্ধ এই বিষয়ে আদালতের কোনও বিবেচনামূলক সিদ্ধান্ত নেই। অতএব, এটি বলা যায় যে, আপনার অবর্তমানে নমিনী বীমা দাবীর টাকাতো পাবেনই, এবং বীমা কোম্পানী যদি বীমা দাবীর টাকা নির্দেশিত সময়ের মধ্যে পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে বীমা দাবীর সাথে অতিরিক্ত হিসেবে নির্ধারিত সুদ অর্থাৎ প্রচলিত ব্যাংক রেটের অতিরিক্ত শতকরা ৫ (পাঁচ) ভাগ হারে মাসিক ভিত্তিতে হিসাব করে দাবীদারকে বীমা দাবীর টাকা পরিশোধ করতে আইনত বাধ্য।

৩। লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী মানেই প্রতারক – লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী মানেই যে প্রতারক এমন ধারণা সঠিক নয়। আমাদের মাঝে এই ধারণা প্রচলনের জন্য প্রধানত দায়ী বিভিন্ন লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা। এছাড়াও রয়েছে বীমা এজেন্টদের কিছু কার্যকলাপ যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেপলিসি সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান না করা, বীমা গ্রাহকের নিকট হতে পলিসির প্রিমিয়ামের টাকা গ্রহণ করে বীমা কোম্পানীতে তা জমা প্রদান না করা ইত্যাদি সহ আরো অন্যান্য কিছু ঘটনা। যার নেতিবাচক ফল সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানী সহ দেশের সমগ্র বীমা শিল্পকে বহন করতে হচ্ছে। কিন্তু দেশের বীমা শিল্পে অনেক বীমা কোম্পানী আছে যারা বীমা গ্রাহকের জীবনমানের উন্নতি, লাইফ ইন্স্যুরেন্স শিল্পের উন্নতি ও লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে ডিজিটালাইজেশনের যুগে ইন্টারনেট সুবিধা মানুষের হাতের নাগালে হওয়ার কারণে আপনি খুব সহজেই বিভিন্ন বীমা কোম্পানীর ওয়েবসাইট ও অ্যাপ, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট, বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর, কোম্পানীর আর্থিক বিবরণী ও বীমা শিল্পে কোম্পানীর সুনাম সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে তা যাচাইবাছাই করে লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারেন এবং আপনার পছন্দ অনুযায়ী পলিসি ক্রয় করতে পারেন।

৪। লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসিতে বীমা কোম্পানী ব্যাংকের চেয়ে কম লাভ প্রদান করে ব্যাংকের সঞ্চয়ী পরিকল্পের সাথে সবসময় লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির তুলনা করা সঠিক নয়, কেননা দুটির কার্যক্রম ও উদ্দেশ্য আলাদা। সঞ্চয়ী পরিকল্প, এফডিআর বা অন্য কোনো নামে ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে মেয়াদান্তে বা মেয়াদপূর্তির পূর্বে হিসাবধারী তার সঞ্চয়ী পরিকল্প সমর্পণ করলে ব্যাংক জমাকৃত টাকা ও নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ সহ (অগ্রিম আয়কর কর্তন করে) হিসাবধারীকে অথবা হিসাবধারীর মৃত্যুতে তার নমিনিকে অর্থ প্রদান করে। ব্যাংক শুধু জমাকৃত টাকার হেফাজত করে কিন্তু জীবনের কোনো ঝুঁকি গ্রহণ করে না। অন্যদিকে, লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী বীমা গ্রাহকের জীবনের ঝুঁকি গ্রহণের পাশাপাশি আর্থিক ঝুঁকি সম্পর্কিত বিষয় নিয়েও কাজ করে। লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী পলিসির মেয়াদকালীন সময়ে বীমা গ্রাহকের জীবনের ঝুঁকি গ্রহণের সাথে সাথে মেয়াদান্তে মুনাফা সহ বীমাকৃত অংক বীমা গ্রাহককে অথবা বীমা গ্রাহকের মৃত্যুতে তার নমিনিকে অর্থ প্রদান করে।

বীমা আইন ২০১০ এর ৮৮ ধারার বিধানে বলা আছে যে, কোন পলিসি অন্যূন ২ (দুই) বৎসর পর্যন্ত বলবৎ থাকলে উহার প্রত্যর্পণ মূল্য প্রাপ্য হবে এবং বীমাকারী অর্থাৎ বীমা কোম্পানী কর্তৃক নিযুক্ত একচ্যুয়ারি প্রবিধান (বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জারিকৃত) দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রত্যর্পণ মূল্য নিরূপণ করবে। সুতরাং, এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, যদি কোন বীমা গ্রাহক মেয়াদপূর্তির পূর্বে তার পলিসি প্রত্যর্পণ করে প্রত্যর্পণ মূল্য পেতে চান তাহলে তাকে অন্যূন ২ (দুই) বছর পর্যন্ত নিয়মিত প্রিমিয়াম প্রদান করে পলিসি চালু রাখতে হবে অর্থাৎ ২ (দুই) বছরের পূর্বে যদি কোন বীমা গ্রাহক তার পলিসি প্রত্যর্পণ করেন তাহলে তিনি পলিসির অধীনে কোন প্রত্যর্পণ মূল্য প্রাপ্য হবেন না।

আমরা অনেকেই লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসিকে ব্যাংকের পরিকল্পের মত মনে করি, আমাদের ধারণা হলো যে নিয়মিত প্রিমিয়াম প্রদান করি আর না করি কিংবা কয়েকটি প্রিমিয়াম প্রদান করার আর কোন প্রিমিয়াম প্রদান না করলেও জমাকৃত প্রিমিয়ামের টাকাতো ফেরত পাবোই। এমন ধারণার কারণে আমরা কিছুদিন প্রিমিয়াম প্রদান করে আর কোন প্রিমিয়াম প্রদান করি না। বীমা আইনের ৯২ () () ধারার বিধানে বলা আছে যে, কোন পলিসি শুধুমাত্র বকেয়া প্রিমিয়াম (ওভারডিউ প্রিমিয়াম) প্রদান না করার কারণে বাজেয়াপ্ত হবে না, যদিপলিসি কমপক্ষে ২ (দুই) বছর যাবত বলবৎ থাকে। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায় যে, বীমা গ্রাহক নিয়মিত প্রিমিয়াম প্রদান সাপেক্ষে পলিসি ২ (দুই) বছর পর্যন্ত বলবৎ রাখেন না আবার বকেয়া প্রিমিয়ামও প্রদান করেন না, ফলে বীমা আইনের ৯২ ধারার বিধান পরিপালন সাপেক্ষে বীমা কোম্পানী পলিসি বাজেয়াপ্তকরণ (Forfeiture) করে। লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির অধীনে আপনি লাভবান হতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই পলিসির মেয়াদকালীন সময় পর্যন্ত নিয়মিতভাবে প্রিমিয়াম প্রদান করতে হবে। লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির অধীনে প্রদেয় সুবিধা প্রাপ্তির জন্য আপনাকে অবশ্যই নিয়মিতভাবে প্রিমিয়াম প্রদান করতেই হবে। তাই আপনি যদি নিয়মিত প্রিমিয়াম প্রদান করে পলিসি চালু রাখেন, তাহলে পলিসির মেয়াদপূর্তিতে ব্যাংকের পরিকল্পের তুলনায় বেশি লাভবান হবেন।

৫। আমার প্রতিষ্ঠানে গ্রুপ বীমা করা আছে, আমার আর কোন লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির প্রয়োজন নেই শ্রম আইন ২০০৬এর ৯৯ () ধারার বিধানে বলা আছে যে, যে সকল প্রতিষ্ঠানে অন্যূন ১০০ জন স্থায়ী শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন, সেখানে মালিক প্রচলিত বীমা আইন অনুযায়ী গ্রুপ বীমা চালু করবেন। শ্রম আইনের ৯৯ ধারা ও শ্রম বিধি ২০১৫ এর ৯৮ বিধি পরিপালনের জন্য মালিক/চাকুরিদাতা তার প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য গ্রুপ বীমার ব্যবস্থা করেন। গ্রুপ বীমার অধীনে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিজের জীবন (মৃত্যু এবং স্থায়ী অক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) ও তার উপর নির্ভরশীলদের (যেমনস্ত্রী, সন্তানাদি, কোন কোন ক্ষেত্রে পিতামাতাও অন্তর্ভুক্ত থাকেন) চিকিৎসা ব্যয় (নির্ধারিত) বহন করা হয়। গ্রুপ বীমার ক্ষেত্রে চাকুরিদাতা তার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষে প্রিমিয়াম প্রদান করেন ফলশ্রুতিতে গ্রুপ বীমার অধীনে কোন মেয়াদপূর্তি সুবিধা প্রদান করা হয় না। তাই গ্রুপ বীমা থাকার পাশাপাশি লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি ক্রয় করলে তা যেমন মেয়াদপূর্তিতে বীমাকৃত অংক (বীমা কোম্পানী কর্তৃক ঘোষিত বোনাস সহ) প্রদান করবে, তেমনি আপনার অনাকাঙ্খিত মৃত্যুতে গ্রুপ বীমার অধীনে প্রদেয় মৃত্যু সুবিধার (ডেথ বেনেফিট) অতিরিক্ত হিসাবে আপনার লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির অধীনে প্রদেয় মৃত্যু সুবিধা পাবেন। যা আপনার অনুপস্থিতে আপনার পরিবারের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মান রজায় রাখা, সন্তানদের পড়াশুনা ইত্যাদি অব্যাহত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। অপরদিকে, গ্রুপ বীমার অধীনে আপনি কোন ট্যাক্স রিবেট (রেয়াত) সুবিধা পাবেন না, কিন্তু লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির অধীনে প্রদানকৃত প্রিমিয়ামের (সংশ্লিষ্ট আর্থিক বছরের জন্য) বিপরীতে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হারে ট্যাক্স রিবেট (রেয়াত) সুবিধা পাবেন।

৭। প্রদেয় কাভারেজের তুলনায় লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসিতে খরচ অনেক বেশি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী কোন বীমা গ্রাহকের নিকট হতে প্রিমিয়াম গ্রহণ সাপেক্ষে পলিসি চুক্তিতে উল্লিখিত কোন ঘটনা, যে ঘটনায় বীমা গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা সংঘটিত হওয়া সাপেক্ষে কভারেজ (বা আর্থিক বীমা সুবিধা) প্রদান করে। আমাদের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই একটি প্রচলিত ধারণা আছে যে, আমার সাথে পলিসিতে উল্লিখিত ঘটনা অর্থাৎ কাভারেজের আওতাধীন ঘটনা আদৌ আমার সাথে ঘটবে কিনা কিংবা কখন ঘটবে তার যেহেতু কোন নিশ্চয়তা নাই, তাই ভবিষ্যতে ঘটলেও ঘটতে পারে এমন অনিশ্চিত ঘটনার জন্য কভারেজ (বা আর্থিক বীমা সুবিধা) পাবার আশায় প্রিমিয়াম প্রদান করে লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি চালু রাখলে তা পলিসির অধীনে প্রদেয় কাভারেজের তুলনায় প্রিমিয়াম খরচ অনেক বেশি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে লাইফ ইন্স্যুরেন্স খুবই পরিমিত একটা সেবা, যার খরচ নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ আপনার হাতেই থাকে। আপনি চাইলেই যেমন অনেক বেশি প্রিমিয়ামের বীমা নিতে পারেন তেমনি অনেক স্বল্প প্রিমিয়াম প্রদান করেও পলিসি ক্রয় করতে পারেন।

৮। লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসিতে বিনিয়োগ মানেই টাকার অপচয় লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসিতে বিনিয়োগ একটি ঝুঁকিবিহীন ও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ, যা কোনোক্রমেই অর্থ অপচয় নয়। পলিসির অধীনে বীমা কোম্পানী কাছ থেকে প্রাপ্ত বীমা দাবীর টাকা দিয়ে আপনি যেমন সাময়িক আর্থিক সমস্যা মেটাতে পারেন তেমনি উন্নয়নমূলক কোনো কাজ এবং অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা থেকে নিজেকে ও পরিবারকে মুক্ত রাখতে পারেন।

৯। আমি অনেক সম্পদের মালিক, তাই আমার লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির প্রয়োজন নেই আমাদের অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা আছে যে, আমার অনেক সম্পদ রয়েছে সুতরাং আমার লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির প্রয়োজন নাই। লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ থেকে অর্জিত লাভের একটি অংশ টাকার অংকে পরিমাপ করা যায়, এবং লাভের অন্য অংশটি টাকার অংকে পরিমাপযোগ্য নয়। আপদকালীন সময়ে লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি বীমা গ্রাহকের চাহিদা সম্পূর্ণরূপে পূরণ করতে না পারলেও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে সমস্যা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।

১০। আমারতো বয়স কম, তাই আমার লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির প্রয়োজন নেই লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি নেয়ার জন্য বীমা কোম্পানী পলিসির ধরণ অনুযায়ী বীমা গ্রাহকের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বয়স সীমা নির্ধারণ করে থাকে, যার কম বা বেশি বয়স হলে বীমা গ্রাহক পলিসি কিনতে পারেন না। বীমা কোম্পানী মূলত বীমা গ্রাহকের জীবনের উপর ঝুঁকি গ্রহণ করে, তাই বীমা গ্রাহকের (বা বীমাকৃত ব্যক্তি) বয়সের উপর ভিত্তি করে প্রিমিয়ামের হার নির্ধারণ করা হয়। কম বয়সে পলিসি গ্রহণ করলে ক্রয়কৃত পলিসির বিপরীতে প্রিমিয়ামের হার কম নির্ধারিত হয়, কিন্তু পলিসির অধীনে প্রদেয় কাভারেজের পরিমাণ একই থাকে। সুতরাং, যত কম বয়সে পলিসি করা যায় প্রকৃত অর্থে ততোই ভালো; কারণ বয়স কম থাকলে একই পরিমাণ বীমা অংকের জন্য বেশি বয়সী একজন ব্যক্তির তুলনায় কম বয়সী একজন ব্যক্তির তুলনামূলক প্রিমিয়াম প্রদানের হার অনেক কম।

১১। আমি তো বিয়েই করিনি, আমি লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি দিয়ে কি করব আমাদের জীবনে সমস্যা কিংবা বিপদ কখনো আগেভাগে সতর্ক সংকেত দিয়ে অথবা সাইরেন বাজিয়ে কিংবা পূর্ব সতার্কতা জারি করে আসে না। বীমা গ্রাহকের (বা বীমাকৃত ব্যক্তি) জীবনের আকস্মিক বিপদের কারণে (যেমনরোগগ্রস্ত হওয়া কিংবা অনাকাঙ্খিত মৃত্যু) আপনার ও আপনার পরিবারের আর্থিক সঙ্কট মোকাবেলায় লাইফ ইন্স্যুরেন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি আর্থিক নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে এবং আর্থিক সঙ্কট মোকাবেলায় অন্যতম হাতিয়ার হিসাবেও কাজ করে এবং আপনার ও আপনার পরিবারের নিরাপদ জীবনযাপন ও আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

১২। আমি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ, আমার লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির প্রয়োজন নেই – এই ব্যাপারে অনেকেই একমত হবেন যে, রোগগ্রস্ত হওয়া কিংবা মারাত্মক অসুস্থতার ক্ষেত্রে অসুস্থ অবস্থায় আমরা হয়তো মৃত্যু চিন্তা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি করে থাকি। পাশাপাশি, চিকিৎসা ব্যয় ও আমার অবর্তমানে পরিবারের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ ইত্যাদি নিয়েও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। প্রকৃতপক্ষে সুস্থ অবস্থায়ই পলিসি ক্রয় করা উচিত যাতে অসুস্থ অবস্থায় তার সুবিধা ভোগ করা যায়। কারণ কোন বীমা কোম্পানীই রোগাক্রান্ত কিংবা শারীরিকভাবে অসুস্থ বা মারাত্মক অসুস্থ কোন ব্যক্তিকেই বীমা পলিসি প্রদান করবে না। তাই শারীরিক অসুস্থতার কোন তথ্য গোপন না করে বীমা গ্রাহক সুস্থ অবস্থায় পলিসি ক্রয় করা উচিত। মনে রাখবেন, শারীরিক অসুস্থতার তথ্য গোপন করে পলিসি ক্রয় করা হলে, পলিসির শর্তাবলী সাপেক্ষে এবং বীমা আইন ২০১০ এর ৬৮ ধারার বিধান সাপেক্ষে বীমা কোম্পানী যদি প্রমাণ করতে পারে যে, শারীরিক অসুস্থতার বিবরণী অতীব প্রয়োজনীয় বিষয় সংক্রান্ত ছিল এবং প্রকাশ করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এরূপ তথ্য গোপন করা হয়েছিল কিংবা পলিসি গ্রাহক জালিয়াতির আশ্রয়ে তা সম্পাদন করেছেন এবং বিবরণ প্রদানকালে পলিসি গ্রাহক জ্ঞাত ছিলেন যে, তা অসত্য অথবা প্রকাশ করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এরূপ তথ্য গোপন করা হয়েছে তাহলে আপনার ক্রয়কৃত পলিসিটি ভয়েড অ্যাব ইনিশিও (void ab initio) অর্থাৎ পলিসিটি শুরু থেকেই বাতিল বলে গণ্য করা হবে। এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানী আপনাকে পলিসির অধীনে কোন কভারেজ (বা আর্থিক বীমা সুবিধা) প্রদান করবে না। আর এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানীর দায় হবে, প্রযোজ্য সার্ভিস চার্জ কর্তন করে, আপনার পলিসিতে জমাকৃত প্রিমিয়ামের টাকা ফেরত প্রদান করা।

উপরের বর্ণিত উদাহরণগুলো ব্যতীত মানুষের আরো অনেক ভুল ধারণা থাকতে পারে। মানুষের জীবনের ঝুঁকি, আর্থিক ঝুঁকি হ্রাস করার ক্ষেত্রে বীমা ব্যবস্থা বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সুতরাং, বীমা সম্পর্কে সঠিকভাবে না জেনে ধারণার বশবর্তী হয়ে ভুল ধারণা পোষণ না করে কিংবা বীমাকে অবজ্ঞা না করে আপনার সামর্থ্য ও প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের ও পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে নির্দ্বিধায় লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি ক্রয় করতে পারেন। লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির মাধ্যমে যেমন আর্থিক ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব, তেমনি দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকিহীন ও লাভজনক খাতে অর্থাৎ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে বিনিয়োগ করে নিজে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ গ্রহণ করুন।

মোঃ মাসুম বিল্লাহ্
এলএল.বি (অনার্স), এলএল.এম
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।