বুদ্ধির খেলায় যেভাবে ট্রাম্পকে হারালো এরদোগান

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইপ এরদোগান হঠাৎ করে কেন উত্তর–‌পূর্ব সিরিয়ার সীমান্ত পেরিয়ে কুর্দদের ভিটেছাড়া করতে উঠে পড়ে লাগলেন? কেনই বা মুরুব্বিদের কথা না শুনে সেনা অভিযান শুরু করে দিলেন তিনি? এপ্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল। শুরু করতে হবে সিরিয়া থেকে। ইরাকের সাদ্দাম হুসেন ও লিবিয়ার গদ্দাফির মতো প্রেসিডেন্ট আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে, সিরিয়াকে কয়েক টুকরো করে আমেরিকা একসময় চেয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে একচেটিয়া মার্কিনি নিয়ন্ত্রণ।

সিরিয়া আমেরিকার কুক্ষিগত হলে চরম অসুবিধা হত রাশিয়ার। কারণ সিরিয়ার টরাস বন্দর বহুদিন ধরে রুশ নৌবহরের ঘাঁটি। একমাত্র ওই বন্দর থেকেই ভূমধ্যসাগরে পৌঁছতে পারে রুশ নৌবহর। আবার লাটাকিয়া রুশ বিমানবাহিনীর ঘাঁটি। তাই টরাস ও লাটাকিয়ার ঘাঁটি রক্ষায় সিরিয়া সঙ্ঘাতের শুরু থেকেই আসাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন পুতিন।

মার্কিন মদতে যখন আসাদ–‌বিরোধী বাহিনী, আইসিসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দামাস্কাস থেকে আসাদকে উচ্ছেদ করতে চাইল, তখন দেখা দিল মার্কিন–‌বিরোধী এক নতুন জোট। আসাদের বাহিনীর সঙ্গে পরিচয় গোপন করে যোগ দিল ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ডদের একাংশ। সঙ্গে শামিল হল ইরানের মদতপুষ্ট হেজবুল্লা জঙ্গিদের রেগুলার সেনারা। এই তিন বাহিনী মিলে মার্কিন মদতপুষ্ট আসাদ–বিরোধী বাহিনী ও আইসিসের বিরুদ্ধে শুরু করে সামরিক অভিযান। আফগানিস্তানের স্থলযুদ্ধে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সোভিয়ত বাহিনীর। তা থেকে শিক্ষা নিয়ে পুতিনের জেনারেলরা আসাদ–ইরান–হেজবুল্লা বাহিনীকে দিলেন এয়ার কভার। মানে আকাশপথে মিসাইল হানায় বিরোধীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিল রুশ যুদ্ধবিমান। তার পিছু পিছু এগিয়ে গিয়ে শত্রু নিকেশ করল তিন বাহিনীর জোট। এভাবে বিদ্রোহীদের হাত থেকে দেশের ৬০ শতাংশ জমি এখন নিজের দখলে আনতে পেরেছে আসাদের বাহিনী। সাদ্দাম বা গদ্দাফির মতো আসাদের পতন তো হলই না, উল্টে মধ্যপ্রাচ্যে সগৌরবে ফিরল রাশিয়া, সোভিয়েতের পতনের প্রায় দু’‌দশক পরে। সঙ্গে আরও পরিসর পেয়ে গেল ইরান, যারা আবার ইজরায়েলের চক্ষুশূল।

দক্ষিণ সিরিয়ার মতো সিরিয়ার উত্তর অংশেও ঘাঁটি গেড়ে হামলা চালাচ্ছিল আইসিস। সেখানে আমেরিকার নেতৃত্বে যুদ্ধে নামে আন্তর্জাতিক বাহিনী। কিন্তু উত্তর সিরিয়ার জমি কেউই ভাল চেনে না কুর্দদের মতো। কুর্দরা এই অঞ্চলের বহুদিনের সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। বহুদিন ধরে এরা তুরস্কের মধ্যেই আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে আন্দোলন চালাচ্ছে। এরদোগান এদের কোনওদিন মেনে নেননি। এখানকার কুর্দিশ মিলিশিয়ার নাম পিপলস প্রোটেকশন ইউনিট বা ওয়াইপিজি।

তুরস্কের নেতারা মনে করেন, ওয়াইপিজি সন্ত্রাসবাদী। কারণ এরা নিষিদ্ধ বামপন্থী সংগঠন কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির শাখা।
কুর্দদের একটানা চাপের মুখে রেখেছিলেন এরদোগান। কিন্তু উত্তর সিরিয়ায় আইসিসকে কোণঠাসা করতে কুর্দিশ মিলিশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে মার্কিন বাহিনী। এর জেরে বিশাল সংখ্যক আইসিস জঙ্গি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের যুদ্ধে হারিয়ে বন্দি করে শিবিরে রাখা হয়। এই সব শিবিরের পাহারদার ছিল কুর্দ মিলিশিয়া। এভাবে কুর্দ মিলিশিয়া মার্কিন মদতে আইসিসদের হারাতে হারাতে পৌঁছে যায় একেবারে তুরস্ক সীমান্তে। ফলে রীতিমতো অস্থির হয়ে উঠতে থাকেন এরদোগান। তুরস্কের ভিতরে কুর্দরা চাইছে স্বশাসন। আবার সিরিয়ার একাংশ দখল করে তারা মৌরসি পাট্টা গেড়েছে। এতে দেশের মধ্যে রীতিমতো বিরোধিতার মুখে পড়তে হচ্ছে এরদোগানকে। এর ওপর তুরস্কে রয়েছে উত্তর সিরিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত কয়েক লক্ষ সিরীয় শরণার্থীর চাপ।

ফলে কুর্দদের হঠাতে সুযোগ খুঁজছিলেন এরদোগান। তাঁকে সেই বলটা বাড়িয়ে দিলেন ট্রাম্প। ২০২০–‌র নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেকথা মাথায় রেখে জনপ্রিয় ভোটের স্বার্থে সিরিয়া থেকে হঠাৎই মার্কিন সেনা সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রাম্প। সাধারণ রিপাবলিকান ভোটারদের কাছে তাঁর বার্তা, ৭০০০ মাইল দূরের কোনও দেশের জন্য মার্কিন করদাতাদের অর্থ খরচ করবেন না তিনি। এতে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান সেনেটরেরা খেপে গেলেও জনমত সমীক্ষা কিন্তু ট্রাম্পের অনুকূলে। অতএব যে মুহূর্তে উত্তর সিরিয়া থেকে সরেছে মার্কিন বাহিনী, তখনই ট্রাম্পের ইঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এরদোগান। তাঁর পরিকল্পনা ছিল, সিরিয়া সীমান্তের ৩২ কিমি পর্যন্ত ভেতরে ঢুকে পড়ে সেখান থেকে কুর্দদের উৎখাত করা। সেই জমিতে নগর ও জনপদ তৈরি করে তুরস্কে থাকা ২ লক্ষ সিরীয় শরণার্থীর স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করা। এক কথায়, শরণার্থী সমস্যা সমাধানের নামে উত্তর সিরিয়ার এক বিশাল অংশ দখল করা।

তবে সমস্যা রয়েছে অনেক। এতদিন গ্রেপ্তার হওয়া কট্টর আইসিস জঙ্গিদের শিবির পাহারা দিয়ে রেখেছিল কুর্দরা। তাদের মদত দিত আমেরিকা। এখন কুর্দরাই আক্রান্ত। এই সুযোগে দলে দলে আইসিস জঙ্গিরা পালিয়েছে শিবির থেকে। এরা ফের শক্তি সঞ্চয় করে নতুন করে কট্টর মৌলবাদী হিংসা ছড়িয়ে দিতে পারে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে। ঘুরপথে পৌঁছে যেতে পারে ইয়োরোপ ও আমেরিকায়। তাতে আরও সন্ত্রাসদীর্ণ হবে ওই সব এলাকা। ফলে মার্কিন রাজনীতিকদের একাংশ মনে করেন, নতুন করে আইসিসের এই শক্তিবৃদ্ধি আগামী ভোটে ট্রাম্পের পতন ডেকে আনতে পারে।

সিরিয়ায় এখন আমেরিকা প্রায় নেই। এরদোগান ভয় দেখাচ্ছেন, সঙ্ঘাতের সব দায় তাঁর ওপর চাপানো হলে সিরীয় শরণার্থীদের জন্য ইয়োরোপের দরজা খুলে দেবেন তিনি। ফলে ফের শরণার্থী স্রোতের আতঙ্কে রয়েছে পশ্চিম ইয়োরোপও। আমেরিকার অন্য নেতাদের জোরাজুরিতে কয়েকদিনের হামলা বিরতি ঘোষণা করেছিলেন এরদোগান। তবে আমেরিকা তাদের মাঝপথে ছেড়ে পালানোয় ট্রাম্পের মুণ্ডপাত করছে কুর্দরা। তুর্কি আক্রমণ ঠেকাতে তারা দ্বারস্থ হয়েছে আসাদের। ফলে এবার সিরিয়ার উত্তরেও ঢুকে পড়েছে আসাদের বাহিনী, যা এতদিন তারা পারেনি আমেরিকার জন্য। আসাদের বাহিনীর সঙ্গে রয়েছে কুর্দরা। নতুন এই জোটের পিছনে রয়েছে পুতিনের রাশিয়া। আর আসাদকে মদত দিয়ে চলছে ইরান। মার্কিন শূন্যস্থানে বাড়ছে আসাদ, কুর্দ, রাশিয়া ও ইরানের প্রভাব। এতে আতঙ্কিত প্রহর গুনছে ইজরায়েল।

এই পরিস্থিতিতে ন্যাটো ঘনিষ্ঠ হয়েও এরদোগান মুরুব্বি ধরেছেন পুতিনকে। সোচিতে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। তাঁকে মাথা ঠান্ডা রাখতে বলেছেন পুতিন। ওদিকে উত্তর সিরিয়ায় যাতে আসাদ বাহিনীর সঙ্গে তুর্কি সেনাদের যুদ্ধ বেধে না যায়, সেদিকেও নজরদারি রাখছে রুশ। সব মিলিয়ে ট্রাম্পের পপুলিজমের ঠেলায় অস্থির বিশাল এক এলাকা। প্রবল চাপে কুর্দরা। এর জেরে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে আইসিস।

ওদিকে সিরিয়া, কুর্দ, ইরান ছাড়াও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে তুরস্ক। ফলে, ওই অঞ্চলে এখন অ্যাডভান্টেজ রাশিয়া। পুতিনের সঙ্গে কথার পর আপাতত অভিযান বন্ধ রেখেছেন এরদোগান। ইতিমধ্যে সিরিয়া থেকে মার্কিন বাহিনী তুলে নেওয়ার ক্ষত সারাতে এবং স্বদেশে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে আইসিস প্রধান বাগদাদিকে খতম করার পরিকল্পনা করেছিলেন ট্রাম্প। সেই পরিকল্পনা সফল। লাদেনের মতোই বাগদাদির সব পার্থিব চিহ্ন মুছে দিতে তার দেহাংশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে গভীর সমুদ্রে। তবে লাদেনের মৃত্যুতে বাগদাদির উত্থান ঠেকানো যায়নি। ফলে বাগদাদির মৃত্যু আরেক আইসিস নেতার আবির্ভাব পর্বকে সূচিত করল কিনা, তা নিয়ে গোপনে ট্রাম্পের মাথাব্যথা কিন্তু থেকেই যাবে।‌

আজকের বাজার/লুৎফর রহমান