#বৃদ্ধাশ্রম# মোহাম্মদ আমিনুল

আমার বসের বৃদ্ধ বাবা মা কে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পরেছে আমার উপর।
বন্ধের দিনে এই ধরনের কাজ করতে আমার প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। আজকে এমনিতেই বৃষ্টির দিন। সকালবেলা উঠেই গুনগুন করে গান গাইছিলাম; আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম। বউ তখন থেকে আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তারপর বউয়ের দিকে তাকিয়ে আব্দারের সুরে বললাম আজকে খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে তার সঙ্গে গরুর মাংসের ভুনা।
আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজি; কাঁঠালের বীচির ভর্তা; শুটকি ভর্তা। নীলা ফোড়ন কাটে।
কাঁঠালের বীচি কে চুষেছে তার উপর ডিপেন্ড করে কাঁঠালের বীচির ভর্তা খাওয়া যাবে কিনা?
পাশের বাসার ভাবী চুষে দিয়েছে।
কি বলো? কেউ কাউকে কাঁঠালের বীচি পাঠায়, তাও আবার চোষা?
বাহ মনটা খুশীতে নেচে উঠেছিলো মনে হয়। চুষছে কাজের বুয়া। চলবে তোমার? বালাই ষাট এখন কেউ কাঁঠালের বীচি চুষে না। মানুষ তোমার মত জংলি না।
আমি কথা ঘুরানোর চেষ্টা করি; কাঁঠালের বীচি বাদ। তার থেকে টম্যাটো ভর্তা, ডাল ভর্তা, ধনিয়া ভর্তা মন্দ হতো না।
ব্যাপারখানা কি? ঝেড়ে কাশো। গান গাইছো। আবার ভালো মন্দ খেতে ইচ্ছে করছে। পুরাতন প্রেমিকা ফোন দিয়েছে? নাকি পাশের বাড়ির ভাবীর সঙ্গে সিঁড়িতে ধাক্কা খেয়েছো? তারপর প্রেম হয়ে গিয়েছে।
কি যা তা বলছো। আজকে বৃষ্টির দিনে মনটা বড় উদাস হয়েছে। তুমিতো জানো আমি প্রকৃতি প্রেমিক। ইচ্ছে করছে তোমাকে নিয়ে রবী ঠাকুরের গান গাইতে
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে॥
ঠিক সেই সময়ে আমার বস ফোন দেয়।
আমিন আমার বাবা মা-কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে হবে। বেশীক্ষন লাগবে না। ঢাকার কাছেই বৃদ্ধাশ্রম। গাজীপুরে। যাবেন আর আসবেন। আমিই যেতাম। কিন্তু হটাত বন্ধুদের সঙ্গে একটা আড্ডার ডাক পরলো। আর বুঝেনইতো আমি গেলে ব্যাপারটা ইমোশনাল হয়ে যাবে। বৃদ্ধাশ্রমের মানুষগুলোও এমনভাবে তাকায় যেন কোন ক্রিমিনাল দেখছে। অথচ দেখেন ব্যাপারটা বেশ সাইন্টেফিক। এই সমাজে যাদের বয়স হয়েছে তারা সমাজের কাছে বোঝা ছাড়া আর কিছু নয়। তারা নতুন কিছু বলতে পারে না। তাদের থেকে শিখারও কিছু নেই। আপনি একজন বৃদ্ধ মানুষের সঙ্গে কিছুক্ষন গল্প করলে পাগল হয়ে যাবেন। সব পুরাতন ধ্যান ধারনার কথা।
আমি মাথা নাড়ি। মাথা নাড়া ছাড়া আসলে আমার কিছু করার নেই। আমি বলতে পারছি না আমার বাবা মা আমার সঙ্গেই থাকে। আমার বস জানে। হয়তো সে ভুলে গিয়েছে। অথবা ভুলে যাওয়ার ভান করছে।
আপনি চলে আসেন। আমি বের হচ্ছি। ইনফ্যাক্ট আপনার সঙ্গে আমার দেখা নাও হতে পারে। উনারা রেডি হয়ে আছেন। আপনি এসে উনাদের ড্রপ করে আসবেন। সরি আমিন এই বন্ধের দিনে আপনাকে কষ্ট করতে হচ্ছে।
আমি ভাবি মানুষ অন্য মানুষদের সঙ্গে কত ভদ্র আচরন করে। আবার সেই মানুষগুলোর কাছেই তাদের বাবা মা বোঝা ছাড়া আর কিছু না। আমি ভাবতে থাকি তাদের বাবা মায়ের সঙ্গে কি হতে পারে যে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে হচ্ছে। ঝগড়া, বিবাদ। বাবা মা সন্তানদের বুঝতে পারছে না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না।
আমি রেডি হই। বের হওয়ার সময় আমার বাবা আমাকে ডাক দেয়।
বাবা এই বন্ধের দিনে কই যাচ্ছিস? ছেলেকে সময় দে। ছেলেটা পুরা সপ্তাহে তোকে অনেক মিস করে।
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে হাসি। আমি জানি সত্য কথা বললে বাবার মন খারাপ হবে। তাই বলি এই একটু ঘুরে আসি। বৃষ্টির দিনে ঘুরতে ভালো লাগবে। খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবো।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়। আমি জানি বাবা শুধুমাত্র কথা বলার জন্য এই কথাগুলো বলছে। বুড়ো হলে মানুষজন প্রিয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। অনেকসময় কথাগুলো হয় ছেলেমানুষি কথা। কিন্তু তারপরেও তাদের ভালো লাগে। ব্যাপারটা আমি বুঝি। তাই আমি প্রতিদিন এসে বাবা মা-কে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলি। কত যে গল্প।
জানো আজকে কি হয়েছে। আজকে রাস্তা দিয়ে আসছিলাম। হটাত দেখি এক লোক জাদু দেখাচ্ছে। লোকটার হাতে পাঁচশো টাকার নোট। সে একটা কাপড়ের ব্যাগের মধ্যে ভরলো তারপর পাচশো টাকা উধাও। আমাকে বললো টাকা রাখতে ব্যাগের মধ্যে। আমি চালাকি করে একশো টাকা রেখেছি। সেটাও উধাও হয়ে গেলো।
আমার বাবা মা দুইজনই হেসে গড়াগড়ি খায়।
যাহ তোর একশো টাকা হারিয়ে গেলো।
কত অল্পতে মানুষ খুশী হয়।
আমি আমার বসের বাবা মাকে গাড়িতে তুলি। তাদের চোখে অশ্রু। আমি না দেখার ভান করি। তারা চুপ হয়ে বসে আছে। গাড়ির মধ্যে নিস্তব্ধতা। হটাত বসের মা নিস্তব্ধতা ভাঙ্গে।
আমার না আমার ছেলের স্কুলের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে। উনি আমাকে বলে বাবা তুমি কি আমাদের আমার ছেলের স্কুলের সামনে নিয়ে যাবে।
আমি জানি বসের স্কুল কোথায়। আমি ড্রাইভারকে বলি গাড়ি ঘুরিয়ে স্কুলের সামনে নিয়ে যেতে। স্কুলের সামনে গিয়ে তারা দুইজন গাড়ি থেকে নামে। আমিও তাদের সঙ্গে নামি।
বসের মা বিড়বিড় করতে থাকে। স্কুলটা কত চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে। আমরা তিনজন স্কুলের ভেতরে ঢুকি। স্কুলের ভেতর একটা গোল বসার জায়গা। সেখান থেকে ক্লাসরুমগুলো দেখা যায়।
মহিলাটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে। তিনি তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে
তোমার মনে আছে। আমার ছেলে যখন প্রথম স্কুলে ভর্তি হয়। সবসময় খুব ভয় পেতো। ও যতক্ষণ ক্লাস রুমে থাকতো। আমি এই গোল জায়গাটাতে বসে থাকতাম। ও যদি ক্লাসরুম থেকে উকি দিয়ে আমাকে না দেখতো তবে কান্না শুরু করতো।
বসের বাবা মাথা নাড়তে থাকে। সেই আমাদের ছোট ছেলেটা। আমার আঙ্গুল ধরে প্রথম এই স্কুলে এসেছিলো। স্কুলের টিচাররা যখন ওর নাম জিজ্ঞেস করলো ও আমার কোলে উঠে বসে পড়লো। আর নামেই না। যতই সবাই বলছিলো নামো বাবা নামো। সে বলছে বাবার কোল থেকে নামবো না।
মহিলাটা বলছে তোমার মনে আছে; ঈদে ওকে আমরা ফুটবল কিনে দিয়েছিলাম। ফুটবল খেলার জার্সি। বুট। সেগুলো পেয়ে ছেলে আমার কি খুশী।
হুম। খুব মনে আছে। সেবার আমরা ঈদে কেউ কিছুই নেয়নি। কিভাবে নিবো। আমার একলার আয়। আমার বাবা মা-কে দিতে হয়, ভাই বোনকে দিতে হয়। তারপর সংসার চালানো খুব কষ্ট ছিলো।
তোমার ওর কলেজের কথা মনে আছে। চলো না ওর কলেজে যাই।
আমরা আবার কলেজের দিকে রওনা দেই। আমি এই বৃদ্ধা বৃদ্ধকে যত দেখছি, তত মুগ্ধ হচ্ছি। আসলে মানুষের কত স্মৃতি থাকে তার সন্তানকে নিয়ে। কত মধুর স্মৃতি।
এইবার লোকটা বলে। তোমার মনে আছে। যখন ছেলে প্রথম কলেজে ভর্তি হয়। ছেলে বড় হয়ে গিয়েছে। ছেলের একটা নিজস্ব জগত তৈরি হয়েছে। তারপরেও তুমি ছেলেকে একা ছাড়তে না। কেন?
কিভাবে একা ছাড়ি। সবসময় যে ছেলেকে নিয়ে খুব ভয় হতো। শুনেছিলাম কলেজে রাজনীতি হয়। আমার ছেলেটার যদি কিছু হয়। তাই প্রায় এসে কলেজ ক্যাম্পাসে বসে থাকতাম।
তোমার মনে আছে। ছেলেকে আমি কম্পিউটার কিনে দিয়েছিলাম। তাও তোমার পীড়াপীড়িতে। তুমি বললে ওকে কম্পিউটার কিনে দাও। তোমার টিউমার অপারেশন করানো দরকার ছিলো। তুমি বললে আমি কিছুদিন পর অপারেশন করাবো। কিছু হবে না।
হুম। ছেলে কম্পিউটার পেয়ে কি খুশী।
যাবে ছেলের ইউনিভার্সিটিতে? মহিলাটা পুরুষকে জিজ্ঞেস করে।
বৃদ্ধ মাথা নাড়ে। না যাবো না। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। দেখতে দেখতে ছেলেটা কত বড় হয়ে গেলো। ওর পছন্দমতো বিয়ে দিলাম। ভেবেছিলাম নাতি নাতনী নিয়ে বাকি জীবনটা আনন্দে কাটাবো।
হুম। তুমিতো জীবনে কষ্ট কম করোনি। সেই বাবা মা-কে দেখতে। ভাই বোনদের দেখতে। তারপর আমাদের সংসার। কখনো অভাব বুঝতে দাওনি। নিজের জন্যতো কিছুই কিনতে না। সেই পুরাতন শার্ট এবং প্যান্ট।
লোকটা হেসে ফেলে। আসলে কি জানো। কিছু মানুষের জীবন বুঝি এমনি হয়। আজকে সবাই কত বড় হয়ে গিয়েছে। আমরাই বড় হতে পারলাম না।
দুপুর হয়ে গিয়েছে। তাদের সঙ্গে আমি যেন স্মৃতির রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তাদের জন্য আমার মন খারাপ হয়।
আমি তাদের জিজ্ঞেস করি
আপনারা কি দুপুরের খাবার খেয়েছেন?
না বাবা খাইনি। আজকে যে খিদে মরে গিয়েছে। আমাদের গাজিপুর দিয়ে এসো। তোমার পরিবার নিশ্চয় তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
যদি কিছু মনে না করেন। কাছেই আমার বাসা। চলেন না। দুপুরের খাবার আমার বাসায় খাবেন।
তারা রাজি হয় না। কিন্তু আমার পীড়াপীড়িতে অবশেষে হার মানে। আমি তাদের নিয়ে আমার বাসায় যাই।
নীলা প্রথমে একটু অবাক হয়। আমি নীলাকে সব খুলে বলি। নীলা আমার বসের উপর খুব ক্ষিপ্ত হয়। মানুষ এমন কেন?
আমি আমার বাবা মায়ের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেই। আমার বাবা মা তাদের পেয়ে গল্প গুজবে মেতে উঠেন। আমার ছেলেও তাদের কোলে কোলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে এই দাদা দাদীও তার খুব পরিচিত।
আমরা সবাই লাঞ্চে বসি। লাঞ্ছ আজকে বেশ ছিলো। খিচুড়ি, ইলিশ মাছ, গরুর মাংসের ভুনা কয়েক প্রকার ভর্তা। এর মধ্যে কাঁঠালের বীচির ভর্তা ছিলো। নীলা একবার আমার কানে কানে এসে বললো কাঁঠালের বীচির ভর্তা পাশের বাসার ভাবী পাঠিয়েছে। আমার জন্য নাকি। আমি খুব সতর্কতার সঙ্গে খাওয়া শেষ করি। ভুলেও কাঁঠালের বীচির ভর্তা নেই না। তাকিয়েও দেখি না।
কথায় কথায় তারা আমার বাবা মা-কে বলেন। আপনারা বড় ভাগ্যবান। আপনারা আপনাদের শেষ জীবন আপনাদের ছেলে, বউ, নাতির সঙ্গে কাটাতে পারছেন। আমার ছেলে আমাদের পাঠাচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। কেননা আমরা এখন বোঝা ছাড়া আর কিছু না।
আমরা সবাই কিছুক্ষনের জন্য চুপ হয়ে যাই। আমার বাবা মা থতমত খেয়ে যায়। আবার চা খেতে খেতে আমরা গল্পে মেতে উঠি। একসময় তারা উঠতে চায়।
আপনাদের অনেক সময় নিলাম। অনেক গল্প করলাম। আমার ছেলে আবার বৃদ্ধাশ্রমে খোজ নিলে যদি জানতে পারে আমরা এখনো পৌছাই নাই তবে হয়তো রাগ করবে। তাদের চোখ ছলছল করছে। আপনাদের সঙ্গ আমাদের খুব ভালো লেগেছে।
আমার বুকে কষ্ট দলা বেঁধে আসে। আমার খুব ইচ্ছে করছে বলতে আপনারা আমার বাসায় থেকে যান।
আমিও তাদের সঙ্গে উঠি। আমার বাবা মাই প্রথমে বলে; আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকুন। ভালোই লাগবে। গল্প গুজবে আমাদের দিন কেটে যাবে। আমাদের বউ মা খুব ভালো। আমাদের অনেক যত্ন করে। অনেক ভালোবাসে। আর আমার ছেলেটাতো পাগল। প্রতিদিন বানিয়ে বানিয়ে কত যে গল্প করে। আমরা হাসতে হাসতে মরি।
উনারা না না বলতে থাকেন। কি যে বলছেন। আমাদের ছেলের ঘরেই আমাদের জায়গা হয়নি।
কিন্তু সে সময় নীলার উপর কি জানি ভর করে।
নীলা তাদের সামনে দাড়িয়ে বলে;
আপনারা যেতে পারবেন না। আপনাদের আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে। আমার বাবা মা নেই। আজকে যদি আমার বাবা মা থাকতো তবে কি আমাদের সঙ্গে থাকতো না। আপনাদের আমি কিছুতেই বৃদ্ধাশ্রমে যেতে দিবো না। আমার ছেলের আরেক জোড়া দাদা দাদি হলো। হয়তো সবাইকে একটু চাপাচাপি করে থাকতে হবে। কিন্তু এর মধ্যেই যে আনন্দ। আমার ছেলে আপনাদের সবার ভালোবাসা এবং দোয়ায় বেড়ে উঠবো। আপনারা আমাদের জীবনের বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষ ছাড়া আমাদের ছায়া দিবে কে। আপনাদের আমি কোনভাবেই যেতে দিবো না।
নাছোড়বান্দা নীলার কাছে অবশেষে উনারা পরাজিত হন। আমি ভাবছি বসকে কি জবাব দিবো। হটাত মনে হলো এমন একজন মানুষকে কি আমার জবাব দেয়ার কিছু আছে। কি আর হবে। যাই হবে আমি লড়ে যাবো। আমার উপর যে আছে বটবৃক্ষের ছায়া। আমাকে যে হারলে চলবে না। অনেক দায়িত্ব আমার উপর।
আমি বারান্দায় এসে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকি। বৃষ্টির জল এবং আমার চোখের জল এক হয়ে যাচ্ছে। এই চোখের জল আনন্দের জল, ভালোবাসার জল।