বেসরকারি বিনিয়োগে বড় বাধা উচ্চ কর

আহমেদ রশিদ লালী। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সামনের সারির ব্যক্তিত্ব। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। দীর্ঘদিন তিনি দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে কাজ করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। অর্থনীতির সঙ্গে পুঁজিবাজারের সম্পর্ক, দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি, পুঁজিবাজারে সরকারের নীতি-সহায়তা, বাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে আজকের বাজারের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর কথোপকথন অনুলিখন করে আজকের বাজারের পাঠকদের জন্য ছাপা হলো।

 

অর্থনীতির সঙ্গে পুঁজিবাজারের সম্পর্ক
অর্থনীতির একটা মূল স্তম্ভই হলো পুঁজিবাজার। আমরা লক্ষ করলে দেখব যে ফার্স্ট জেনারেশন ব্যাংকগুলো মাত্র ১০ কোটি, ২০ কোটি টাকার পেইডআপ ক্যাপিটাল নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। আর এখন তাদের ১৭০০, ১২০০, ১০০০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। টাকাগুলো কিন্তু পুঁজিবাজারই তাদের জোগান দিয়েছে। দ্বিতীয় বিষয় হলো, এই টাকা দিয়ে ব্যাংকগুলো বড় বড় প্রজেক্ট ল্যান্ডিং করতে পারছে।

পুঁজিবাজারে যেসব কোম্পানি লিস্টেড আছে, ওই কেম্পানিগুলো যদি বিস্তার করতে না পারে, তাহলে এই পুঁজিবাজারে প্রতি বছর যেসব ছেলেমেয়ে বিনিযোগ করছে, তারা কোথায় যাবে? প্রতি বছর চাকরির বাজারে যে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে আসছে, তারা কোথায় চাকরি করবে? এখান থেকে টাকা উত্তোলন করা যায়, কারণ ছোট ছোট সেভিংস দিয়ে ব্যবসা করা যায় না, কিন্তু ছোট ছোট সেভিংস দিয়ে পুঁজিবাজারে এসে বিনিয়োগ করলে ছোট কোম্পানিগুলো উপকৃত হবে।

সে কারণেই বলছি, পুঁজিবাজারের মাধ্যমে অর্থনীতিতে যে সাড়া আসে, সেটা কিন্তু অন্য কোনো সেক্টর থেকে আসে না।  আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা বড় বড় প্রজেক্ট করতে এই পুঁজিবাজারের সহযোগিতা নিয়ে করেন না, কিন্তু বিদেশে পুঁজিবাজার থেকে টাকা নিয়েই তা করা হয়। তাই আমাদের আশা, সরকার এই পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করবে। তাহলে ছোট কোম্পানিগুলো যেমন ভালোভাবে টিকে থাকবে এবং ছেলেমেয়েরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে আর্থিকভাবে লাভবান হবে। ফলে চাকরি নিয়ে হতাশায় ভুগতে হবে না তাদের।
বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না।

চার-পাঁচ বছর ধরে প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ ২২ পার্সেন্টের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা কমে গত বছর ২১ দশমিক ৭ ভাগে নেমে এসেছে। এর অন্যতম একটা কারণ ইনকাম ট্যাক্স। ইনকাম ট্যাক্স নীতির আমূল পরিবর্তন দরকার। একজন বিনিয়োগকারী যখন একটা প্রতিষ্ঠান করে, তখন তাকে টাকা দিয়ে তা করতে হয়। সেখানে ট্যাক্স দিতে হয়। এখানে-সেখানে মোট তিনবার তাকে ট্যাক্স দিতে হয়। কিন্তু হিসাব করে দেখা যায়, একটি লিস্টেড কোম্পানিকে ৭৬ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। তারপর শেয়ারহোল্ডারের কাছে পৌঁছাতে হয়।

গ্যাস, পাওয়ার, ল্যান্ড এত সব ঘাটতির কারণেও প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে হবে। প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়াতে না পারলে চাকরির বাজরে বড় ফারাক তৈরি হবে। এই শতাব্দীর এশিয়ার বিস্ময় আমদের দেশ। আমরা জানি, পিডব্লিউসি প্রেডিকশন করেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। কিন্তু আমরা যদি পুঁজিবাজারের পরিধি না বাড়াই, পুঁজিবাজারকে প্রপারলি কাজে না লাগাই, বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়াই, তাহলে কিন্তু আমাদের ২৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

পুঁজিবাজারের পরিধি বাড়ছে না কেন?
প্রতি বছর অনেক কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হবে এটাই সবার প্রত্যাশা থাকে, কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো মার্কেটিং। মার্কেটিং যদি সঠিকভাবে করতে পারি, তাহলেই বড় বড় কোম্পানি বাজারে যোগ হবে। এবং এখন যারা বড় বড় কোম্পানি আছে, যারা তেল-সাবান বিক্রি করে আমাদের টাকা নিয়ে যাচ্ছে, মালিকানার কোনো অংশ আমার দেশকে দেবে না, তা তো হয় না। সে কারণে সরকারি পক্ষ থেকে বাধ্যবাধকতা তুলে নিতে হবে।

যদিও এখন তা তুলে নেওয়া হচ্ছে, তবু বড় বড় কোম্পানি বাজারে যুক্ত হচ্ছে না। কেন? পাশাপাশি ট্যাক্সের ফারাকটাও দূর করতে হবে। মিনিমাম ১০ ভাগে নামিয়ে আনতে হবে। যদি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়, তাহলে সে যদি কখনো কোনো বিপদে পড়ে, তখন সে তার কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু যদি তালিকাভুক্ত না থাকে, তাহলে কেউ এই কোম্পানির শেয়ার কিনতে আগ্রহী হবে না। এ বিষয়টা মার্কেটিংয়ের বড় একটি উপাদান। আমরা ডিবিএর মাধ্যমে এ বিষয়টি নিয়ে কার্যক্রম চালু করেছি। মার্কেটিং শুরু করেছি। ইতোমধ্যে দুটি টেলিকম কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেছি। আলোচনায় আছি। মার্কেটিংয়ের যেন আর ঘাটতি না থাকে।

আমরা ঢাকা স্টক একচেঞ্জ ও এসইসিকে সঙ্গে নিয়ে ডিবিএর কার্যক্রম শুরু করেছি। এ ছাড়া আরেকটি উদ্যোগ নিয়েছি। এ বছর এরই মধ্যে যারা লিস্টেড কোম্পানি আছে অথচ যাদের এখন পর্যন্ত রিকগনাইজ করা হয়নি, আমরা এ রকম টপ টোয়েন্টি কোম্পানি, ব্রোকার হাউজকে রিকগনাইজ করব বড় একটা ইভেন্ট করে। আমরা জানি পুঁজিবাজারে তাদের অবদান অনেক বেশি।

সরকারি পর্যায়ে নীতিগত পরিবর্তন
আমরা ডিবিএর মাধ্যমে এরই মধ্যে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনিও আমাদের সঙ্গে সমস্ত বিষয় নিয়ে একমত হয়েছেন। আমাদের বলেছেন তাঁকে একটা চিঠির মাধ্যমে জানাতে। আমরা আবার তাঁর সঙ্গে বসব। পলিসিতে আমরা কয়েকটি বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছি। যেমন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে লিস্টেড করার ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছি, ট্যাক্স বিষয়ে আলোচনা থাকবে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন বিষয়গুলো সমাধানের ব্যাপারে কাজ করব।

পুঁজিবাজারে শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়
আমরা জানি যে পুঁজিবাজারে সব সময় ক্ষতিগ্রস্ত হন বিনিয়োগকারীরা। তাই আমরা সব সময় বিনিয়োগকারীদের পক্ষে কাজ করতে চাই, তাঁদের পাশে থাকতে চাই। সারা বাংলাদেশে যত ব্রোকার হাউজ আছে, তাদের সবাইকে আমরা সব সময় পরামর্শ ও সতর্ক করি, কোন কোন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা উচিত, কখন আপনারা বিনিয়োগ করবেন, কখন বিনিয়োগ তুলে নেবেনÑ এই সমস্ত বিষয়ে সচেতন করে থাকি। আমাদের এই কার্যক্রম সারা বছর চলবে।

বিনিয়োগকারীদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে, আপনারা গুজবে কান না দিয়ে ভেবেচিন্তে বিনিয়োগ করবেন। এ ক্ষেত্রে কোম্পানির প্রোফাইল দেখবেন, গত পাঁচ বছরের রেজাল্ট যাচাই করবেন, বড় অঙ্কের বিনিয়োগ একসঙ্গে একই কোম্পানিতে করবেন না। ছোট ছোট অঙ্কে বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগের ব্যাপারে মনোযোগ দেবেন। তাহলে রিস্ক ফ্যাক্টর অনেকাংশে কমে যাবে।

আহমেদ রশীদ লালী
ডিএসই ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশন প্রেসিডেন্ট