আধুনিক পদ্ধতিতে সেবা দেয় আয়েশা হসপিটাল : আরিফুল ইসলাম

ঢাকার পাশের কেরানীগঞ্জের আঁটি বাজার এলাকার তরুণ ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা আরিফুল ইসলাম। তিনি আয়েশা হাসপাতালের অন্যতম পরিচালক। হসপিটালটি ইতিমধ্যে এলাকার মানুষের কাছে আশীর্ব্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। মান ও সুযোগ-সুবিধা রাজধানী ঢাকার হাসপাতালগুলোর মতোই কিন্তু খরচ তুলনায় অনেক কম। উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা, হাসপাতাল ব্যবসার চ্যালেঞ্জ, তরুণদের জন্য করণীয় ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে আজকের বাজার ও এবি টিভির সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর কথপোকথনের চুম্বক অংশ তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে হাসপাতাল ব্যবসায় সম্পৃক্ত হওয়ার কারণ হিসেবে বলতে চাই,ছোটবেলা থেকেই আমার পরিবার আমাকে চাকরি নয় বরং ব্যবসা করার জন্য উৎসাহিত করতেন। তারা চাইতেন শুধু ব্যবসা নয় বরং জনসেবামূলক কিছু যেন করি। সেই চিন্তা থেকে হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নিই। আমি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করে সাউথ কোরিয়া থেকে মাস্টার্স করেছি। দেশে ফিরে আসার পর আমি চাকরি করার চিন্তা করলেও আমার পরিবার আমাকে ব্যবসা ও জনসেবা করার জন্য উৎসাহিত করেন। তো সে হিসেবে চিন্তা করে দেখলাম হাসপাতালের বিকল্প কিছু নেই। এতে একইসঙ্গে মানুষের সেবা ও ব্যবসা দুটোই হবে। এই হাসপাতাল আমার আম্মার নামে করা হয়েছে।

হাসপাতাল করার অন্য একটি কারণ হলো,আমাদের এই জায়গাটি ঢাকা থেকে একটু দূরে। ফলে গরিব মানুষের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যাওয়া-আসা খুবই ব্যয়বহুল। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা ব্যবসা ও মুনাফার বিষয়টি প্রাধান্য না দিয়ে তাদের সামর্থ্যরে মধ্যে আধুনিক চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমদের হাসপাতাল থেকে টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় কেউ ফিরে যায় না। প্রতিষ্ঠান গড়ার দেড় বছর বয়সের মধ্যে এলাকার অন্য হাসপাতালগুলোকে আমরা ওভারকাম করতে পেরেছি। এর কারণ হলো, আমাদের সেবার মান ভালো, হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিছন্ন, স্টাফদের ব্যবহার নমনীয় ও মানসম্পন্ন ডাক্তার।

ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ
হাসপাতালের মান বজায় করতে গিয়ে প্রতি মাসে ৪-৫ লাখ টাকা লোকসান হচ্ছে আমাদের। এই লোকসানের টাকা বড় ভাইয়েরা বহন করছে। এখানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আমরা ঢাকা থেকে যে ডাক্তারই নিয়ে আসি তারা এখানে চেম্বার খুলতে চান না। তারা ৩-৪ মাস কাজ করার পর চলে যান যদিও আমরা যথেষ্ট বেতন ও অন্যান্ন সুযোগ সুবিধা দিই। ডাক্তার সাহেবরা কেবল শহরের বড় বড় হাসপাতালে কাজ করতে চান।

পাশাপাশি আমাদের এখানে ইলেক্ট্রিসিটির সমস্যার কারণে আমাদের জেনারেটরের খরচ বেশি। এলাকায় ছোট বড় বেশ কয়েকটি হাসপাতাল আছে ফলে প্রতিযোগিতা করে টিকতে হচ্ছে আমাদের।

ভ্যাট নিয়ে ভাবনা
যখন ভ্যাটের পরিমাণ বেড়ে যায় তখন আমাদের টিকে থাকা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এতে যন্ত্রপাতির দাম বেড়ে যায় এটিও আমাদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা। আমি এ েেত্র সরকারের শুভ দৃষ্টি কামনা করে বলবো, যেন চিকিৎসা খাতকে ভ্যাট-ট্যাক্সের আওতার বাইরে রাখা হয় বা যতটুকু না হলেই নয় শুধু ততটুকুই নেওয়া হয়। তাহলে আমরা কম খরচে মানসম্পন্ন সেবা দিতে পারবো।

সরকারে কাছে আহ্বান
যদি সরকার আমদের দিকে তাকায় ও মনিটরিং করে তাহলে কোনো হাসপাতালের সেবার মানে কোয়ালিটির কম্প্রোমাইজ হবে না কারণ সবাই সচেতন থাকবে। আমরা চাইবো, প্রতি মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালত কিংবা অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে দেখবেন মান বজায় রাখা হচ্ছে কি না, ডাক্তাররা সঠিকভাবে সার্টিফাইড কি না ইত্যাদি।

অনন্যা সমস্যা
সমস্যার মধ্যে আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক সময়ই আমরা যন্ত্রপাতি কিনতে পারিনা। গ্রামে দ ডাক্তার আসতে চায় না কারণ তাদের ব্যবসা শহরমুখী। আর যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তারা চিকিৎসার জন্য শহরে যায়।

হাসপাতাল নিয়ে পরিকল্পনা
আমাদের হাসপাতাল গ্রামে কিন্তু আমরা শহরের যেকোনো হাসপাতালের মতো কোয়ালিটি মেইনটেইন করি। আমাদের হসপিটালের ডেকোরেশন, ডাক্তার প্যানেল, স্টাফ প্যানেল অনেক ভালো। সব কিছু মিলে আমাদের হাসপাতাল প্রথম শ্রেণীর হাসপাতাল। তো আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা সফল হয়েছে। এখন আমার এলাকার মানুষকে ঢাকা যেতে হয় না কারণ আমার এখানেই সব ধরনের অপারেশন হচ্ছে ২ থেকে ৩ গুণ কম খরচে। আমরাই আমাদের এলাকায় প্রথম এক্সরে মেশিন নিয়ে এসেছি।

আমাদের সেবার মান
ইবনেসিনা, আরমান, ইউনাইটেড হাসপাতালের মতোই আমাদের অপারেশন থিয়েটার মানসম্পন্ন। আমাদের এখানে আধুনিক পদ্ধতিতে আলট্রাসনোগ্রাম হচ্ছে। অত্যাধুনিক ফিজিওথেরাপি দিচ্ছি। অত্যাধুনিক ল্যাব আছে ফলে সবধরনের টেস্ট এখানেই করা যায়। টেস্টের ফলাফলও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহ করা হয়।

তরুণদের জন্য পরামর্শ
আমদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক বেশি লম্বা। দেশের বাইরে অনেকেই পড়াশুনার পাশাপাশি চাকরি বা ব্যবসা করে। আমদের দেশে সেই সুযোগ অনেক কম। আমি মনে করি সরকারের দিকে চেয়ে না থেকে ছাত্রজীবন থেকেই কিছু করা ভালো। কেউ যদি ব্যবসা শুরু করে তাহলে সে আরও কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। যেমন, আমার হাসপাতালে ৪০ জনের মতো কাজ করে। এছাড়াও আমার অন্য একটি প্রতিষ্ঠান আম্মার প্রোপার্টিসে ৫০ জনের বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। এটা সম্ভব হতো না যদি আমি চাকরিতে যেতাম।

তাই আমার তরুণ ভাই-বোনদের প্রতি পরামর্শ থাকবে যে পড়াশুনা শেষ হওয়ার অপোয় না থেকে পড়াশুনার পাশাপাশি কিছু একটা শুরু করে দিন। ১৮ বছর বয়সের পর পরিবারের বোঝা না হয়ে কিছু করার চেষ্টা করুন। কোনো কাজকে ছোট মনে না করে সমাজ সেবামূলক কিছু করা যায় কি না চেষ্টা করে দেখুন। আমি ২০০৫ থেকে বন্ধুদের নিয়ে সমাজ সেবার কাজ শুরু করেছিলাম। আমরা বিনামূল্যে রক্ত সরবরাহ, বিনামূল্যে গরিব ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলাম।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভবিষ্যতে আমার গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। তার কারণ আমি যদি আমার এলাকায় একটি গার্মেন্টস করতে পারি তাহলে আমি অন্তত ১-২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবো।

আমাদের মার্কেটিং ব্যবস্থা
আমরা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং সিস্টেম এনালাইসিস করে আমাদের মার্কেটিং সিস্টেমকে দাঁড় করিয়েছি। আমরা গরিব মানুষকে বিনামূল্যে সেবা দেওয়ার প্রচারণা করি। আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আমাদের কর্মচারিরা বাইরে কাজ করতে গেলে নানা কারণে ডিমোটিভেটেড হয়।

আমাদের বিশেষত্ব
আমাদের টেস্টগুলো হয় ১০০ভাগ ডিজিটাল পদ্ধতিতে। টেস্টের রিপোর্ট ইনস্ট্যান্ট পাওয়া যায়। ঢাকা শহরের বড় বড় হসপিটালের সুযোগ সুবিধা আমাদের হসপিটালেই পাওয়া যায়। অথচ করচ হয় অনেক কম। হাসপাতালের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিছন্ন। ডাক্তার-কর্মচারিরা সবাই আন্তরিক। এখানে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ আছে।

আমাদের সমাজ সেবা
চিকিৎসা ক্যাম্পের মাধ্যমে আমরা বিনামূল্যে ওষুধ,চশমা, ৫০ জনের বেশি মানুষের চোখের ছানি অপারেশন করিয়েছি। আমরা আমাদের ঈদগাঁ ও মসজিদ পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করি, গরিব মানুষের জন্য খাবার সরবরাহ করি। আমার মনে হয়, দেশের প্রত্যেকটি গ্রামের একটি করে ছেলে যদি সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করে তবে বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের ৬৮০০০ ছেলের কাজ সমাজ উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে। তরুণদের প্রতি আমার এই আহ্বান থাকবে।

আরিফুল ইসলাম
পরিচালক
আয়শা হসপিটাল