ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুনর্গঠনে ব্যাংক কমিশন গঠন জরুরি

ব্যাংকিং খাতকে তার যথাযথ গতিপথে রাখার জন্য একটা কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সরকারি ব্যাংকগুলো যে মূলধন সংকটে ভুগছে ওই সমস্যারও সমাধান করতে হবে- মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআয়ের পরিচালক একেএম সাহিদ রেজার এমন বক্তব্য এই সময়ের ব্যাংকিং খাতের চিত্রকেই প্রতিফলিত করে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে আরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলেছেন তিনি। আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন এবি টিভির সঙ্গে তাঁর কথপোকথনের চুম্বক অংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ
যে কোনো ব্যবসায় সেক্টরেই কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর কাজ করে। ব্যাংকিং সেক্টরের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণকেই রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে ধরা হয়। খেলপি ঋণ যে ব্যাংকিং খাতের ক্ষতি করছে সেটি বোঝার জন্য আলাদা করে কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। আমি বিনিয়োগ করছি অথচ সে টাকার পুরো অংশ ফেরত পাচ্ছি না। অথচ জনগণের কাছ থেকে যে আমানত সংগ্রহ করেছি তার পুরোটাই ফেরত দিতে হচ্ছে। এর পেছনে আমার দায়বদ্ধতাও রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সকল নীতিমালা মেনে চলার দায়বদ্ধতা আমার আছে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ছে যখন আমার বিনিয়োগের পুরো টাকাটা আসছে না। এটা নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা বাদ দিয়ে এখন দেখতে হবে কেন ঋণ খেলাপ হচ্ছে? এর জন্য উদ্যোক্তাদের ঢালাওভাবে দোষারোপ করার যে সংস্কৃতি দেশে তৈরি হয়েছে; এটাকে আমি সঠিক বলে মনে করি না। এর পেছনের কারণ আগে চিহ্নিত করতে হবে। এটি কি রাজনৈতিক কারণে হচ্ছে, না অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানোর জন্য হচ্ছে, না দেশের স্বভাবজাত কারণে হচ্ছে? সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। দেশে আইন রয়েছে। যদি স্বভাবজাত কারণে ঋণ খেলাপি হয়ে থাকে বা কোনো দুষ্ট চক্রের প্রভাবে হয়ে থাকে তাহলে প্রচলিত আইনের আওতায় ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যদি কাঠামোগত সংকট বা যে পরিকল্পনা নিয়ে বা প্ল্যান নিয়ে ব্যবসায় এসেছিল সেটি পূরণ না হওয়ার কারণে ঋণ খেলাপি হচ্ছেন তাহলে তাকে কিছুটা সুযোগ দিতে হবে। আর উদ্যোক্তাকে নার্সিং করাও ব্যাংকের দায়িত্ব। তবে মনে রাখতে হবে ব্যাংকের যেমন দায়িত্ব রয়েছে একইভাবে সরকারেরও দায়িত্ব রয়েছে। খেলাপি ঋণের কথা বলে কাউকে ব্যবসা থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক হবে না। তাকে ব্যবসার মধ্যেই রেখে তার ঋণ খেলাপির প্রকৃত কারণ উদঘাটন করতে হবে। কী করলে সে খেলাপি ঋণগুলো সুদসহ শোধ করতে পারবে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

ঋণ খেলাপের কারণ
বর্তমানে ঋণ খেলাপির পেছনে অন্যতম কারণ ধরা হয় সরকার বিরোধী আন্দোলন। মিছিল, মিটিং, ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও- এসব কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বর্তমানে ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হলেও অবকাঠামোগত অগ্রগতি হয়নি। ফলে উদ্যোক্তারা সঠিক সময়ে সঠিক অ্যাকশনে যেতে পারছেন না। একারণে তাদের ব্যবসা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে অবকাঠামোগত অসুবিধা। রাস্তাঘাটের সমস্যা প্রকট। এখনো ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে ১০/১২ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এরপর বিদ্যুৎ সমস্যা, গ্যাস সমস্যা তো আছেই। বিদ্যুতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে বলা হলেও আসলে আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী বিদ্যুৎ এখনো পাচ্ছি না। আজ আমাদের ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরির সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার মেগাওয়াটেরও কম। এই যে লোডশেডিং হচ্ছে এর কারণে শিল্প কারখানার গতি কমে গেছে। আর টাকা পাচারের যে সংস্কৃতি রয়েছে এটা তো আছেই। এটাকে ঋণ খেলাপি বলে না। এটা অপরাধ। এই চক্রকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আর যারা প্রকৃত অর্থে ব্যবসা করছে । দেশে আছেন। ব্যবসা নিয়ে ভাবছেন। তাদের জন্য নতুন পরিকল্পনা করে ব্যবসার গতি বাড়িয়ে দিতে হবে। এদের সুযোগ দিতে হবে। আর সরকারি ব্যাংকগুলোতে অনেক বড় একটি সমস্যা হচ্ছে মূলধন সংকট। এই মূলধন সংকট কাটাতে একটা স্থায়ী সমাধান করতে হবে। আজ ভাবার সময় এসেছে, এদেশে সরকারি ব্যাংক থাকার দরকার আছে কি না? এদের মূলধন জোগাড়ের জন্য প্রতিবছর জাতীয় বাজেট থেকে বরাদ্দ দিতে হচ্ছে। এবছরও আড়াই হাজার কোটি টাকা যোগান দেওয়া হয়েছে। এভাবে চলতে পারে না। এটা যদি বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে হতো কোনোভাবেই সরকার ট্যাক্সের টাকা থেকে এই ভর্তুকি দিত না। সরকারি ব্যাংক হওয়াতেই জনগণের ট্যাক্স থেকে এই টাকা দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতকে তার যথাযথ গতিপথে রাখার জন্য একটা কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। খেলাপি ঋণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সরকারি ব্যাংকগুলো যে মূলধন সংকটে ভুগছে এর সমাধান করতে হবে।

ব্যাংকিং কমিশনের কাজ কী হবে
ব্যাংকিং কমিশন একটা সংসদ গঠন করে অবশ্যই নীতিমালা অনুযায়ী চলবে। এদের সুনির্দিষ্ট টিমওয়ার্ক থাকবে। ব্যাংক বিষয়ে যে সমস্ত অভিজ্ঞ লোকজন আছেন, ব্যবসায়ী সমাজ এবং যারা এ সমস্ত বিষয় নিয়ে কাজ করছেন তাদের নিয়ে গঠন করতে হবে কমিশন। সুনির্দিষ্ট টাইম সেটআপ করে কমিশনকে কার্যকর করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যতটুকু দায়িত্ব তারা সেটুকু পালন করবে। সরকারের যতটুকু দায়িত্ব সরকার ততটুকু পালন করবে আর কমিশনের যতটুকু দায়িত্ব নির্ধারণ করা থাকবে কমিশন ততটুকু বাস্তবায়ন করবে। এবং ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতিটি কাজ পর্যালোচনা করতে হবে। আর প্রত্যকটি খেলাপি ঋণের তালিকা ধরে কেইস টু কেইস পর্যালোচনা করতে হবে। এরপর তারা তাদের মতামত পেশ করবেন। এর আগে আমরা দেখেছি বেসিক ব্যাংক বা হলমার্কের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারিশ সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয় মানেনি। এসকল ক্ষেত্রে সরকারকে দায়বদ্ধ করা যেতে পারে। তাই বলে অন্য বিষয়ে তো কাজ বন্ধ করে রাখা যাবে না। তাই আমার মনে হয় ব্যাংকিং অব্যবস্থাপনা বা খেলাপি ঋণের সমস্যা সমাধান করতে হলে একটি কমিশন গঠন করা জরুরি।

খেলাপি ঋণের পেছনে আরেকটি কারণ বলা যেতে পারে কিছু প্রশিক্ষিত লোকও রয়েছে এবং কিছু খারাপ উদ্যোক্তাও রয়েছে। তারা মিলে একটা সুযোগ নিয়েছে। এছাড়া কিছু ব্যাংক পরিচালকদের মধ্যেও সংকট তৈরি হয়েছে। সরকার যাদের রাজনৈতিকভাবে পরিচালনা পরিষদে বসিয়েছে তাদেরও কিছু ত্রুটি আছে। সব মিলিয়ে একটা গোঁজামিল অবস্থার মধ্য দিয়ে ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিটা চলছিল। এ জায়গাগুলো সংস্কার করার জন্যই ব্যাংক কমিশন গঠন জরুরি। সিদ্ধান্ত আগের থেকেই নিতে হবে সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে কারা থাকবেন। ব্যাবসায়ীরা থাকবেন না রাজনৈতিক লোকজন থাকবে? এই সিদ্ধান্তগুলো ব্যাংক কমিশন থেকে আসতে পারে। বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণ কি অবস্থায় হওয়া উচিত। এ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও ব্যাংক কমিশন সিদ্ধান্ত দিতে পারে।

পরিচালনা পরিষদের অংশীদারিত্ব বিষয়ক আলোচনা
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধসের পর সরকার নিয়ম করেছিল ব্যাংক পরিচালনা পরিষদে যারা থাকবেন তাদের ন্যূনতম ২% অংশীদার হতে হবে। এ নিয়মটি এখন অনেকটা শিথিল। আমি মনে করি এটি জরুরি নয়। আমার মতে ওই ২% নিয়ে ব্যাংক মালিকানা স্পষ্ট করা উচিত নয়। ব্যক্তি যিনি আছেন তাকে বিবেচনা করা দরকার। আইন শক্ত করা দরকার। এই কম পার্সেন্ট থাকার চেয়ে উপযোগী ব্যক্তির অংশীদারিত্ব অনেক বেশি কাজে দেবে। ওই যে নিয়ম করা হয়েছিল ওটাতে তেমন উপকার হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। ব্যাংকেরও কোনো উপকার হয়নি। আবার যেটার জন্য করা শেয়ার বাজার; সেটারও কোনো উপকার হয়নি। আজ দেখেন অনেকেই অনেক পরিমাণ শেয়ারের মালিক হয়েছে। একটি ব্যাংকে নিজেদের ৩/৪/৫ জন করে মানুষ রয়েছে। এতে পরিচালনা কাঠামো দুর্বল হয়ে যায়। সংকট দুর করতে হলে অংশীদারিত্বের চেয়ে যোগ্য লোককে পরিচালকের আসনে বসানো জরুরি। টাকার মূল্যে মূল্যায়ণ না করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পর্যালোচনা করতে হবে।

বর্তমানে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার সর্বনিম্ন
বর্তমানে ব্যাংকের আমানতের সুদের হার নিয়ে হতাশার কোনো কারণ আমি দেখি না। আমি যেমন কম নিচ্ছি ঠিক তেমনি কমই দিচ্ছি। রেসিও আমার আগের জায়গায়ই আছে। ৩% প্লাস মাইনাস। এখনও ব্যাপক ব্যবসার সুযোগ আছে। যদি ঋণ খেলাপি না হয় বা কম হয় তাহলেও ভালোভাবে ব্যবসা করা যাবে। ব্যাংকের মূল চ্যালেঞ্জই হলো খেলাপি ঋণ।

একেএম সাহিদ রেজা
চেয়ারম্যান, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড
পরিচালক, এফবিসিসিআই