মানসম্পন্ন এগ্রো ক্যামিকেল কৃষির উপকারে আসবে

শেয়েব চৌধুরী চেয়ারম্যান, হিরণ এগ্রো লিমিটেড, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি পদে কাজ করছেন। পেশাগত কারণে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষককে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন এবিটিভি’র সঙ্গে আলাপচারিতায় কৃষিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। আলাপচারিতার চুম্বক অংশ তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

প্রথমেই বলবো কৃষি সেক্টরটা অনেক বড় একটা সেক্টর। এই সেক্টরের অনেকগুলো বিভাগ বা উইং রয়েছে। এর জন্য পুরো কৃষি বিভাগ নিয়ে অল্প সময়ে বলাটা কঠিন হবে। আমরা যে বিষয়টি নিয়ে কাজ করি সেটা নিয়ে বলাটা ভালো হবে বলে আমি মনে করছি। আমরা মূলত কৃষি উপকরণ নিয়ে কাজ করছি। আরো স্পষ্ট করে যদি বলি তাহলে বলতে হয় আমরা বালাইনাশক ও মাইক্রো নিউট্রাল ফার্টিলাইজার নিয়ে কাজ করি। বালাইনাশক আবার তিন রকমের :-
০১.কীটনাশক
০২.আগাছা নাশক
০৩.ছত্রাক নাশক।

কীটনাশক মূলত পোকামাকড় নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। আগাছা আমাদের কৃষির জন্য অনেক বড় সমস্যা। আগাছানাশক দিয়ে এটি দুর করা হয়। আর ফসল কিংবা উদ্ভিদ বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকে আক্রান্ত হলে ছত্রাকনাশক দিতে হয়। এই সব কিছু মিলেই পুরো বালাইনাশক। বালাই নাশক বলতে বোঝায় সবগুলোর মিলিত ব্যবস্থা। এই হলো একটা ।

আরেকটা মাইক্রো নিউট্রাল ফার্টিলাইজার। এটা পেস্টিসাইড নয়, এটা খাদ্য উপাদান। মাইক্রো ফার্টিলাইজার বলতে বড় অর্থে বোঝায় ইউরিয়া, টিএসপির মতো সার। কিন্ত গাছের জন্য, ফসলের জন্য এসব সারের বাইরেও আরো কিছু ফার্টিলাইজার লাগে তবে খুব অল্প পরিমাণে। কিন্ত ফসলের বৃদ্ধি, ফুল, ফল আসার জন্য আরো কিছু স্বল্প পরিসরের সার রয়েছে যার ভুমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ফসলের পরিমাণ অনুসারে দস্তা, জিঙ্ক এগুলো দেখা যায় খুব অল্প পরিমাণে লাগছে। এইটা না হলে গাছে যখন ফসলের ফুল আসার কথা তখন ফুল আসবে না । আর যদি তাই হয় তা হলে ফল আসতেও দেরি হবে। একটার সঙ্গে আরেকটা গভীরভাবে জড়িত।

এখানে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একটা উইং কাজ করছে। কাজ করলে কী হবে, তাদের কাজের মধ্যে কিছুটা ত্রুটি রয়েছে বলে আমি মনে করি। কারণ হচ্ছে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা, গুণাগুণ ঠিক আছে কি না সেটা তারা ঠিকভাবে তদারকি করে না। দুঃখজন হলেও সত্য যে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা এ ব্যাপারে মোটেও গুরুত্ব দেন না, বা মানের ক্ষেত্রে কম্প্রমাইজ করছেন। এতে করে তারা অল্প খরছে বেশি মুনাফা লাভ করলো। এতে দুটো ক্ষতি হচ্ছে, প্রথমত যারা এই পণ্য ব্যবহার করছেন কৃষকেরা তারা সঠিক ফসল পাচ্ছেন না।। আর যারা ব্যবসায়ী তাদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব বা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আমি যদি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ না করি বা কম বেশি করি তা হলে আমি ফাঁকি দিলাম। এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষক তথা কৃষি ফসল উৎপাদনকারীরা।

অন্যদিকে যারা সঠিক পরিমাণ ও মান রেখে তার পণ্য তৈরি করলো, সে কিন্ত তাদের কাছে ক্ষতির শিকার হলো। আমি আসলে এটাই বোঝাতে চাইছি যে এই পুরো ব্যপারটার জন্য একটা অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। এ ব্যাপারগুলো শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, সরকারের দায়িত্ব এটা।

মানসম্পন্ন এগ্রো ক্যামিকেল জরুরি
অনেকেই এগ্রো ক্যামিকেল কোম্পানি করছেন। কিন্ত তাদের সেই কোম্পানি করার জন্য প্রয়োজনীয় ট্যাকনিক্যাল ক্যাপাসিটি, মেশিনারিজ আছে কি না, দক্ষ জনবল আছে কি না, সরকারের মনিটরিং বিভাগের তা সচেতনভাবে মনিটর করা উচিত। এটা দিয়শলাই বা মুড়ি,বিস্কিটের ব্যবসা না। এটা পুরোপুরি সাইন্টিফিক বিষয়। ফসলের বায়োলজিক্যাল সমস্যার সমাধানের জন্যই এ ব্যবসা। এ জন্য যিনি উদ্যোক্তা হবেন তার সঠিক জ্ঞান থাকতে হবে। যদি এ সম্পর্কে না জানা লোক টাকা আছে বলে এই এধরনের কোম্পানির মালিক হয়ে যান, তিনি তো আর পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে জানবেন না। তাকে যোগ্য হতে হবে। বাস্তবে সেরকম আমরা দেখি না। সে ক্ষেত্রে সবাই এটা মেনে চলছে কি না, তার সেই ক্যাপাবিলিটি আছে কি না, তার ব্যাকগ্রাউন্ড ডাটা আছে কি না বা তার কোয়ালিফাইড ব্যাক-আপ আছে কি না এসব দেখা উচিত। যেখানে তিনি তার পণ্যের উৎপাদন করছেন সেই ফ্যাক্টরিটা কেমন , প্যাকেজিং ঠিক আছে কি না এসব মনিটর করতে হবে। যাতে করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা সুস্থ্য প্রতিযোগিতা আসে এবং কৃষকরা যেন প্রতারিত না হয়।

ফ্যাক্টরির দূষণ হয় কিভাবে
আসলে একটা কারখানা দুইভাবে দূষণের কবলে পড়ে। এক নম্বর বয়লারের মাধ্যমে, দ্বিতীয়ত চিলারের মাধ্যমে। এগুলো চালাতে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। ধরেন একটা ১০ টন ওজনের বয়লারে যে পানি দেয়া হয় তা আমরা খালি চোখে দেখলে মনে হবে কেবল পানি। আসলে সেটা পানি না এর সাথে অনেক কিছু মেশানো থাকে। এখানে আসলে তিনটা দ্রব্য দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে, এর মধ্যে লবণ জাতীয় দ্রব্য যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ইত্যাদি। এর পর থাকে মিনারেল জাতীয় কিছু দ্রব্য আর থাকে হেভি মেটাল। তবে সবচেয়ে বেশি থাকে লবণ জাতীয় দ্রব্য। কিন্ত আপনি যদি চান তাইলে পানিতে দ্রবীভূত প্রত্যকটি দ্রব্যের পরিমান নির্ণয় করা সম্ভব। এটা আমরা খালি চোখে দেখছি না। কিন্ত এটাই বয়লারের গায়ে আস্তে আস্তে বসে যায়। আর বয়লারের গায়ে বসে যাওয়া মানেই হলো ওই বয়লারের স্টিম উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়া। কারণ আমরা জানি যে স্টিম উৎপাদেনের জন্য প্রচুর গ্যাস দরকার হয়। বর্তমানে গ্যাসের বিকল্প ডিজেল ও ঝুট বয়লার চালু হয়েছে। তারপরও এখনও আমরা গ্যাস চালিত বয়লারের উপরই নির্ভরশীল আছি। বয়লার যখন কাজ শুরু করে তখন প্রথমে সে নিজেকে হিট করে। তারপর তার নিজস্ব স্কেল আছে সেটাসহ তাকে হিট হতে হবে। তার পর পানি গরম হবে। কিন্ত সমস্যার কারণে তার স্টিম প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি কমে যাচ্ছ্। অন্যদিকে গ্যাস কনজামশন বেড়ে যাচ্ছে। আর গ্যাস কনজামশন বাড়া মানে তার খরচও বেড়ে যাওয়া। এটা একটা বড় সমস্যা।

আরেকটা সমস্যা হচ্ছে মরিচা । বয়লারের বিভিন্ন অংশ লোহার তৈরি। আমরা জানি যে যখনই মেটাল বডির সাথে পানির সংযোগ হয় তখন পানির অক্স্রিজেন বয়লারের মেটালের সাথে গেলেই একধরনের ক্যামিক্যাল রিএক্ট করার প্রবণতা থাকে। ফলে সেখানে আয়রনের সাথে অক্সিজেন মিশে ফোরিক অক্সাইড উৎপন্ন হয়। এটা হওয়া মানেই হলো মরিচা পড়ে যাওয়া। তখন ওই জায়গাটায় হাত দিলে দেখবেন যে পাউডারের মতো মেটাল অংশ ঝুড়ঝুড়িয়ে পড়ে যাবে। এতে বয়লারের স্থায়ীত্বকাল কমে আসে। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে যায়। এগুলোকে নিয়মিত মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হয়। এর জন্য স্কেল্প এবং করোশন এই দুই রকমের সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।

আমারা জানি এর মধ্যে বেশ কিছু শিল্প দুর্ঘটনা হয়েছে। বয়লার বিষ্ফোরণের কারণে কিছুদিন আগেও প্রায় ৪০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। অনেকেই আহত হয়েছেন। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মতো জায়গায় প্রতিনিয়ত এমন ঘটছে। এরকম হচ্ছে কেবল মানহীন বয়লারের কারণে, বয়লারের সঠিক রক্ষনাবেক্ষণ না করার কারণে। এটা অনেক স্পর্শকাতর বিষয়, সবসময় এর মনিটর করতে হয়। সরকারের একটা বিভাগই রয়েছে বয়লার বিভাগ নামে। তাদের কাজ প্রতিনিয়ত কলকারখানার বয়লার পর্যবেক্ষণ করা। প্রতি বছর তাদের মাধ্যমে বয়লার রিনিউ করে নিতে হয় । কিন্ত অনেক মালিকই আছেন যারা এ ব্যাপারে উদাসীন থাকেন, বা ইচ্ছে করেই রক্ষণাবেক্ষণ করান না। যার কারণে এমন সব দুর্ঘটনা হয়।

কিভাবে বয়লার বিস্ফোরিত হয়?
যদি বয়লার সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা না হয় তাহলে স্কেল্প বাড়তে বাড়তে বয়লার একসময় আর ভার নিতে পারে না। তখন স্কেল্প এতো পুরু হবে যে বয়লারের গা থেকে নিচে পড়ে যাবে। সে যখন বয়লারের নিচে পড়ে যাবে তখন সে বয়লারের গায়ের একটা অংশ নিয়ে পড়বে। ফলে বয়লারের ওই জায়গার পুরুত্ব অনেক কমে যায়। আর তখনই যে কোন সময় এই বয়লার বাস্ট করার সম্ভাবনা থাকে।

আসলে আমরা যারা মালিক বা উদ্যোক্তা তাদের সচেতন থাকতে হবে। সবার আগে নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। ১০ মি মি-এর ওপরে গেলেই সফনার পদ্ধতির মাধ্যমে পুনরায় সেটাকে আগের জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। ইটিপির সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা এটাকে বলছি ডব্লুউ টি মানে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট। ওয়াটার ট্রিটমেন্টের কাজ হলো সে হার্ডনেসটাকে কম রাখবে এবং স্কেল্প ও মরিচা যাতে না পড়ে সে ব্যবস্থা নিবে। এটা বয়লারে পানি ঢোকানোর আগে করা হয়।

আর ইটিপির সঙ্গে বয়লারের তেমন সম্পর্ক নেই। স্পিনিং ও ডায়িং কারখানায় প্রচুর ময়লা আবর্জনা মিশ্রিত পানি সৃষ্টি হয় যা বর্জ্য হিসেবে চিহ্নিত। যদি সেই পানি নদী-নালা বা ডোবায় গিয়ে পড়ে তাহলে পরিবেশের ক্ষতি হবে। আর তাই ইটিপি সিস্টেমে ওই পানিকে বিশুদ্ধ করা হয়। এমনকি ওই পানিকে খাওয়ার উপযোগীও করে ফেলা সম্ভব। আমার জানা মতে দেশে বেশ কয়েকটি কারখানায় এমন পরিশোধন ব্যবস্থা চালু আছে। শুধু তাই নয় সেই পানিকে তারা খাবার উপযোগী করেছে।

ব্যবসায়ীদের ওপর বাজেটের প্রভাব
এবারে বাজেটে ব্যবসা বাণিজ্যে বেশ প্রভাব পড়বে। যারা বেশি ট্যাক্স ও ভ্যাট দেন তাদের এনবিআর থেকে নোটিশ দেয়া হচ্ছে। তাদের ব্যাপারটা নাকি সন্দেহজনক। আবার কারো করো বলা হচ্ছে ২০১০ থেকে দেওয়া তার ট্যাক্স ভ্যাট আবার রিভিউ করা হবে। এটা গণভাবে হচ্ছে এবং যারা বড় মাপের ট্যাক্সদাতা তাদের ক্ষেত্রে এটা বেশি দেখা যাচ্ছে।

যদি কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে হয় প্রথমেই সরকারি অনুমোদনের একটা বিষয় চলে আসে। আর সে ক্ষেত্রে লাইসেন্স নিতে হয় এবং প্রতিবছর তা রিনিউ করে নিতে হয়। গত বাজেটে অনেক কিছু আরোপ হয়েছে, আবার বাতিল হয়েছে। লাইসেন্স রিনিউয়ের ব্যাপারে নতুন কিছু নিয়ম হয়েছে। একটা উদাহরণ দিয়ে বলছি, যারা আমদানি-রপ্তানি করেন তাদের দুটো ক্ষেত্রেই সার্টিফিকেট নিতে হয়। কিন্ত বর্তমানে সরকার এ ক্ষেত্রে ১৫ ভাগ ট্যাক্স আরোপ করেছে। তো এটা আমাদের জন্য একটা বোঝা হয়ে গেল না? একজন ব্যাবসায়ী আমদানি বা রপ্তানি করতে তো নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট দিবেনই। কিন্ত লাইসেন্সের জন্য আলাদা করে এই ভ্যাট আরোপ মোটেও ঠিক হয়নি। শুধু তাই না বিগত ১০ সাল থেকে নাকি এই ভ্যাট কাউন্ট করতে হবে। এটা তো ব্যাবসায়ীদের প্রতি একটা হুমকি। যেসব এসএমই ব্যাবসায়ী ভাড়া বাসায় অফিস করেছেন তাদের এখন বাড়তি ভ্যাট দিতে হবে। ইনকামট্যাক্স রিটার্নের জন্য যে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয় সেখানেও ট্যাক্স দিতে হবে। তো আমি মনে করি সরকারের উচিত এইসব জায়গা ভ্যাট-ট্যাক্স মুক্ত রাখা। কারণ ব্যাবসায়ীরা তো এমনিতেই ব্যবসার জন্য পর্যাপ্ত ট্যাক্স দিচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ব্যবসা পরিচালন ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিকভাবে আমরা পিছিয়ে আছি। যা মোটেও সুখবর নয়। এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য এটা সরকারকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।

শেয়েব চৌধুরী
চেয়ারম্যান, হিরন এগ্রো লিমিটেড
সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি