মালিকদের কৌশলে মন্ত্রীর নরম সুর: নয়া ফাঁদে যাত্রীরা

রনি রেজা:
ভোগান্তি যেন নগরবাসীর কপালের লেখা। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে এমনটি জেনে ও মেনেই চলছে অধিকাংশ মানুষের  নগর বাস। মাঝে মধ্যে এমপি, মন্ত্রী বা ক্ষমতাসীনদের দু একটা বাণী আশার প্রদীপে তেলের সঞ্চার ঘটালেও তা মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না। বরং তাদের অনেক সিদ্ধান্তের কারণে ভোগান্তির মাত্রা ওপরের দিকে যাচ্ছে। গত দু’তিন দিন এমনই এক সিদ্ধান্তে নাকাল হচ্ছে রাজধানীর সাধারণ যাত্রীরা।

ঢাকা মহানগরীতে গণপরিবহনে সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। গণপরিবহনের নৈরাজ্য ঠেকাতে বিভিন্ন সময়ে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ১৪ এপ্রিল শনিবার বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে পরিবহন মালিক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপরে (বিআরটিএ) মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান সিটিং সার্ভিস বন্ধের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। এরআগে গত ৪ এপ্রিল রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দেয় সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। সরকার নির্ধারিত ভাড়া নেবেন বলেও সিদ্ধান্ত নেন তারা। যা ১৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর করা হয়। সংবাদটি জানার সাথে সাথে স্বস্তির শ্বাস ফেলে নগর যাত্রীরা। কেউ বুঝতেই পারেনি এটি ছিল সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির একটি কৌশল মাত্র। নিজেদের উদ্দেশ্য শুধু উদ্ধারই নয় তা স্থায়ী করার জন্য এমন কৌশল প্রয়োগ করেন তারা। এতে তারা অনেকটা সাফল্যের পথেও এগিয়েছেন বলা যায়। বিশেষ করে কঠিন সিদ্ধান্তে সবসময় অনড় থাকা যোগাযোগমন্ত্রীর নরম সুর সে আভাসই দিচ্ছে।

গত রোববার ১৫ এপ্রিল সিটিং সার্ভিস বাতিল কার্যকর হওয়ার পর থেকেই যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, নারী যাত্রীদের গাড়িতে না তোলা, ধীর গতিতে গাড়ি চালানো, গাড়ি বন্ধ রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরিসহ নানাভাবে নগরবাসীকে শিক্ষা দিচ্ছেন পরিবহণ কর্তৃপক্ষ। বলা হয়েছিল সিটিং বা গেটলক সার্ভিসের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আর আদায় করা যাবে না। কিন্তু দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বাসে ইচ্ছে মতো যাত্রী ভর্তি করে সিটিং সার্ভিসের ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, সিটিং সার্ভিস নামে চলাচলকারী প্রায় সব বাস-মিনিবাসই লোকাল বাসের মতো যাত্রী তুলছে যত্রতত্র। তবে ভাড়া আদায় করেছে আগের মতোই। এ নিয়ে বাসচালক, কন্ডাক্টর, হেলপারের সঙ্গে যাত্রীদের বচসা, হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। পরিবহণ শ্রমিকদের হাতে মারধরেরও শিকার হয়েছেন কেউ কেউ। আর বাসে অতিরিক্ত যাত্রী তোলায় সৃষ্ট ভিড়ের কারণে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন নারী, শিশুসহ অন্যান্য যাত্রী। এমতাবস্থায় দায়িত্বরত পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনির লোকদেরও তেমন ভূমিকা দেখা যায়নি। এমনকি ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনেই শ্রমিকের হাতে যাত্রী পিটুনির খবরও প্রকাশ হয়েছে।

গমাধ্যমের খবরে জানা যায়, রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে আটকে পড়া একটি বাস থেকে নামার সময় ভাড়া ফেরত চাওয়ায় পরিবহন শ্রমিকদের পিটুনির শিকার হন সমকালের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইন্দ্রজিৎ সরকার। ইন্দ্রজিৎ সরকারের অভিযোগ, সোমবার মানিক মিয়া এভিনিউতে তার উপর হামলার ঘটনাটি দেখলেও কোনো পদপে নেননি ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী হাকিম। একই দিন ইন্দ্রজিতের ঘটনার আগে, বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় চালকের সহকারীদের বেধড়ক পিটুনিতে আহত হয়েছেন একাত্তর টেলিভিশনের সিনিয়র প্রোডাকশন এক্সিকিউটিভ ও সংবাদ উপস্থাপক আতিক রহমান।

গণমাধ্যমে এমন সব খবর আসার মধ্যেই সুর নরম করে বসলেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সভাকে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘পরিবহন মালিকরা অনেক প্রভাবশালী। চাইলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।’ একই অনুষ্ঠানে সিটিং সার্ভিস নিয়ে পর্যালোচনার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

এ খবরে হতাশ সাধারণ যাত্রীরা। প্রশ্ন উঠেছে, পরিবহন মালিকরা কতটা প্রভাবশালী? সরকারের চেয়েও কি বেশি? সরকার চাইলে কেনই বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না? আর যদি ব্যবস্থা নেওয়া না যায় তাহলে উটকো সিদ্ধান্তে কেনই বা সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তিতে ফেলেছেন।

সব মিলিয়ে বিষয়টি উদ্বেগের কারণ সিহেবে পরিণত হয়েছে। প্রত্যাশা রাখি যাত্রীস্বার্থ বিবেচনা করে নগরীর বাস সার্ভিস যাতে যাত্রীবান্ধব হয় সে ব্যাপারে সরকার যথাযথ উদ্যোগ নেবে। সিটিং সার্ভিসের নামে যাত্রী হয়রানি বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা নয়, ফিটনেস সনদবিহীন সব ধরনের যান চলাচলে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করতে হবে।

পাশাপাশি যেমন ইচ্ছা ভাড়া আদায় বন্ধ করাই শুধু নয়, যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানো-নামানো বন্ধেও পদপে নিতে হবে। দেখা গেছে রাজধানীতে যানজটের জন্য অনেকাংশে দায়ী ব্যস্ত সড়কে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা ও নামানো। এ ব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশকে আরো তৎপর হতে হবে।  আমরা চাই পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা বন্ধ এবং যাত্রীসাধারণের যাতায়াত নির্বিঘ্ন হোক। মুক্তি পাক নগর যাত্রীরা।

আজকের বাজার রিপোর্ট:আরআর/ডিএইচ/১৮.০৪.২০১৭