রোজায় লাগামহীন দ্রব্যমূল্য:ঈদে বেসামাল হবার আশঙ্কা

কাজী লুৎফুল কবীর : প্রতি বছরে মতো এবারও রমজানের শুরুতেই নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন বাড়ছে। কী প্রশসানিক কী ব্যবসায়িক কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই বাজার দরে। নেই বাজার মনিটরিং। যে যার খুশি মতো বাড়িয়ে চলেছে রোজার অনুষঙ্গ বেশ কয়েকটি কাঁচা পণ্যের দরও। আর আমদানিকৃত নিত্যপণ্যে তো হাত লাগানোই দায়।

রাজধানীর বেশ ক’টি বাজার ঘুরে কমবেশি এরকম চিত্রই দেখা যায় । বিশেষ করে অভিজাত এলাকা গুলশান,বনানী,ধানমন্ডি,বারিধারা,উত্তরা,হাতিরপুল ও সেনানিবাসের কচুক্ষেত এলাকার বাজারগুলোর চিত্র প্রায় একই। যেখানে দর-দাম করাই যেন বোকামির দন্ড। আর পাইকারি বাজার খ্যাত কারওয়ান বাজার ও যাত্রাবাড়ির চিত্র কিছুটা ভিন্ন হলেও,তা কোন ভাবেই নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নয়।

গেলো কয়েকদিনের অনুসন্ধানে দেখা যায়, নগরীর এসব বাজারে রোজার বড় অনুষঙ্গ ছোলার দর বেড়েছে বেশ। রোজার শুরুতে ৭৫/৮০ দরে বিক্রি হওয়া ছোলা এখন দর-দামহীনভাবে বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকায়। তবে উন্নত মানের ছোলা ১০০ টাকার নীচে নয়। সারাদিন রোজা রেখে শরবত আর মিষ্টান্ন দ্রব্যের অন্যতম অনুসঙ্গ চিনির দর গেলো এক সপ্তাহে বেড়েছে দু’দফায়। রোজার আগে আগে ৬৫/৬৮ টাকা দরে বিক্রি হওয়া লাল-সাদা খোলা চিনি সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই ৭০ থেকে ৭৫ হয়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।

এদিকে কাঁচা পণ্যে রোজার আরেক গুরুত্বপূর্ণ সবজি বেগুন প্রতি বছরের মতোই বলগাহীন উর্র্ধ্বগতিতে চলছে বেচা-বিক্রি। রোজার আগে ৩৫-৪০ টাকার বেগুন দফায় দফায় বেড়ে ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও গতবারের তুলনায় কিছুটা কম। তবে রোজার শুরুতে ছিলো ১০০-১২০ টাকা। রোজাদারের ইফতারে অন্যতম অনুষঙ্গ খেঁজুর। উচ্চ-নিম্ন-মধ্য সবক্ষেত্রেই খেঁজুর ছাড়া ইফতার যেন একেবারেই সাদামাটা। আমদানি করা সাধারণ মানের খেঁজুর রোজার আগে ১১০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও,এখন তা ১২০ থেকে ১৩০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে নগরীর প্রায় প্রতিটি বাজারে।

সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণহীন কাঁচা পণ্যের দর। ইফতারে রুচি বাড়ায় ধনেপাতা। আর সেই ধনেপাতার লাগামহীন সুবাসে রুচি হারিয়েছেন রোজাদার। রমজান আর সরবরাহ নেই অজুহাতে ১২০ টাকার ধনে পাতা ১৮০ টাকা হয়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা দরে। রোজার আগে যা ছিলো ৪০ টাকা। কাঁচা মরিচের ঝালও বেড়েছে খানিকটা। প্রকারভেদে ৩০ টাকার কাঁচা মরিচ এখন ৪০ টাকা। সালাত আইটেম একেবারে সাধারণ জাতের শসা ২০ টাকা থেকে বেড়ে প্রতি কেজি ৩০-৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে সব বাজারে। তবে দেশী জাতের শসা ৬০/৮০ টাকা আর হাইব্রিড শসা ৪০-৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে নগরীর বিভিন্ন বাজারে। আর লেবু দাম হাক লাফে বেড়েছে দ্বিগুণ। প্রতি হালি ২০ টাকা দরের লেবু এখন ৪০ টাকার কম নয়।

অথচ ঢাকার বাইরে বিশেষ করে বগুড়াসহ দেশের বড় পাইকারী বাজার বা মোকামগুলোতে কৃষকের কাছ থেকে খরিদ করা দাম হাত দু’হাত ঘুরতে না ঘুরতেই লাগামহীন হয়ে পড়ে কাঁচা পণ্যের দর। ভোক্তা আর উৎপাদকের মধ্যে বড়মাত্রার ব্যবধানের মুনাফা তুলে নিচ্ছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। এতে দর-দামে নাজেহাল হন রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর সাধারণ ক্রেতারা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বগুড়ার মহাস্থান পাইকারী হাটে প্রতি মণ শসা ৬০০(কেজি ১৫ টাকা),কাঁচা মরিচ ৮০০ ( ২০ টাকা কেজি),মূলা ২০০ (৫ টাকা কেজি),পটোল ৫০০(কেজি প্রতি ১২ টাকার মতো),করলা ৬০০(কেজি প্রতি ১৫ টাকা),কচুমুখি ১২০০(কেজি প্রতি ৩০ টাকা)কচুরলতি ও বরবটি ৫০০(সাড়ে ১২ টাকা কেজি),ঢ্যাঁরস ৪০০(কেজি প্রতি ১০ টাকা),ঝিঙে ২৪০(৬ টাকা কেজি),পেঁপে ২০ টাকা কেজি দরে ৮০০ টাকা প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে।

মুদি আইটেম রসুন যেন স্বপ্নের মতো। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি বাজারেই রসুনে লেগেছে আগুন। পেয়াঁজের ঝাঁজ তেমনটা না বাড়লেও,রসুনের ঝাজালো দরে অস্থির ক্রেতারা। আমদানীকৃত ২৪০-২৫০ টাকার রসুন রোজা শুরুর পর থেকে এক লাফে ৪০০ টাকায় ঠেকেছে। ঈদকে কেন্দ্র করে রসুনের দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। তবে রোজার শেষ দিকে ছোলার দাম কমবে বলে জানান দোকানিরা। কিন্তু চিনির দর নিয়ে এখনও শঙ্কিত তারা। তাদের ধারণা ঈদে চিনির বর্তমান দাম আরো বাড়তে পারে। পাশাপাশি আরো বাড়বে আদাসহ মশলাজাতীয় দ্রব্যাদির দাম।

রাজধানীতে সিটি করপোরেশন গরুর মাংস ৪৭৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও,নগরীর বিভিন্ন বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫২০ টাকা দরে। ঈদে গরুর মাংস একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ৭০০ টাকা পযর্ন্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। আর ব্রয়লার মুরগি ১০ টাকা বেড়ে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সব বাজারে। তবে গতবারের তুলনায় এবারের রোজায় তা বেশ কম। কিন্তু বিক্রেতারা বলছেন ঈদে মাংসের বাজার আরো বেশ অস্থির হয়ে উঠতে পারে।

এদিকে রোজার আগে চালের বাজারের অস্থিরতা আরো বেড়েছে এখন। সাধারণ মানের মোটা চাল ৪৫-৪৮ টাকায় কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। ৩৮ টাকা দরের ব্রি-২৮ জাতের চাল দর-দাম ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকায়। আর উন্নতমানের চিকন চাল তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মিনিকেট ৫৫-৬০ টাকার নীচে নয়। পোলাওয়ের সাধারণ চাল রোজার আগে পাইকারি বাজারে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন তা ১০০ টাকায় পাওয়া যেন স্বপ্নের মতো। আর তা যদি হয় উন্নতমানের বা প্যাকেটজাত তাহলে তো হিসাবের বাইরে। নগরীর বেশিরভাগ বাজারের দোকানিরা বলছেন,ঈদে এসব পণ্যের দাম আরো বাড়তে পারে। তারা বলছেন, পাইকারি বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকরাই সময়-সুযোগ বুঝে দর-দাম বাড়িয়ে দেন। এতে খুচরা বিক্রেতাদের কিছুই করার থাকে না।

আজকের বাজার:এলকে/এলকে/ডিএস ০৪ জুন ২০১৭