লন্ড্রি শিল্পে অভিজ্ঞতা জরুরি

লন্ড্রি সার্ভিস

এম. সাইদুল ইসলাম খান
টপক্লিন, আমাদের লন্ড্রি সার্ভিস। আমাদের এই সার্ভিস অনেক ভালো একটি অবস্থানে আছে। প্রথম দিকে কারো ধারণাই ছিল এ ব্যাপারে। কিন্ত এখন সবাই বিশেষ করে ঢাকা শহরে অনেকেই জানে অটোমেটিক লন্ড্রি সার্ভিসের কথা। এর মধ্যে সার্বিকভাবে আমাদের কিছু সমস্যা রয়েছে, কারণ এ সেক্টরে প্রতিযোগির সংখ্যা বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, ঢাকা শহরের কোথাও শোরুম দিতে গেলে সেখানে যে পরিমাণ ভাড়া গুণতে হয় সে অনুপাতে আমাদের আয় হয় না। আমাদের মতো বড় লন্ড্রি প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন স্থানে ফ্রাঞ্চাইজি দিয়ে থাকে। কিন্ত তাদের ভাড়া দেয়ার পর আর কমিশন দেয়ার মতো টাকা হাতে থাকে না। যার কারণে যে এলাকায় সম্ভাবনা রয়েছে, লোকজন বেশি থাকে, সেসব এলাকাতেও শোরুমগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

আরেকটা ব্যাপার হলো, আমাদের দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না। তার পর এই শিল্পে শ্রমিক পর্যায়ে শিক্ষিত কেউ আসতে চায় না। ফলে লন্ড্রিতে শিক্ষিতের সংখ্যা অনেক কম, প্রায় নাই বললেই চলে। এজন্য আমাদের কাজে সমস্যা হচ্ছে। এর মধে আবার যারা ভালো কাজ জানে, জীবিকার প্রয়োজনে তারা এক জায়গা থেকে নতুন আরেকটা প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছে। ফলে পুরোনো প্রতিষ্ঠান দক্ষ লোকের অভাবে এগিয়ে যেতে বাধার মধ্যে পড়ছে।

নতুন অবস্থায় আমরা একজন কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিই। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমিক কাজ শেখার পর যথেষ্ট অভিজ্ঞ হলে তাকে আমরা কাজে নিয়োগ দিই। কিন্ত তার পর কিছুদিন কাজ করে সেই দক্ষ কর্মী নতুন আরেকটি প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পেয়ে চলে যায়। ফলে এটাই আসলে তখন একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এরকম যারা বড় পরিসরে লন্ড্রি দিয়েছেন তাদের কিন্ত ম্যানেজম্যন্ট লেভেলেও অভিজ্ঞ লোকের অভাব রয়েছে। এর ফলে একজন সাধারণ কর্মীর সুযোগ হয়ে যাচ্ছে বেশি বেতনে কাজ করার। কিন্ত অনভিজ্ঞতার কারণে সে কাজ করতে পারে না ঠিকভাবে। কারণ এখানে বিভিন্ন ধরনের ক্যামিক্যালের ব্যবহার করা হয়। দেশ বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ক্যামিক্যাল আমরা আমদানি করি। তাছাড়া বড় বড় পাঁচতারকা হোটেলগুলোতেও আমরা এই ক্যামিক্যাল সাপ্লাই দেই। এখন যদি একটা কোম্পানির টপ লেভেলে যিনি থাকেন তার যদি এইসব ক্যামিক্যালের সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকে তাহলে তিনি সার্ভিস দেবেন কী করে? মূলত এজন্য ওইসব প্রতিষ্ঠানকে খেসারত দিতে হয়। কারণ তারা যথেষ্ট সার্ভিস দিতে পারছে না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, একজন গ্রাহক এসে আপনাকে বললো, ১০ কেজি কাপড়ে কতটুকু ক্যামিক্যাল দেব। এখন এ সম্পর্কে আপনি নিজেই জানেন না, তখন তাকে কী বলবেন? হয়তো আন্দাজে একটা বলে দিলেন। তাতে কী হবে? মূলত ক্যামিক্যাল ব্যাবহার করা হয় পাওয়ারের উপর। ০ থেকে ১৪ পর্যন্ত পাওয়ার দেখা যায়। ০ থেকে ৭ পর্যন্ত হলো এসিটিক, ৭.১ থেকে ১৪ পর্যন্ত হলো অ্যালকালিক। অর্থাৎ অম্ল এবং ক্ষার। আসলে পরিমাপটা হলো যে আপনি কাপড় ধোয়ার সময় কী পরিমাণ ক্ষার বা সাবান দিবেন তার উপর। সে পাওয়ার মাপতে হবে। আসলে এইসব ব্যাপার বুঝে কাজ করার মতো লোকের সংখ্যা এ সেক্টরে কম। আর এ জন্যই অনেক সময় দেখা যায় যে কাপড় ডেমেজ হয়, ডিসকালার হয়ে যায়। এর জন্য আপনাকে অবশ্যই অভিজ্ঞ কর্মী দিয়েই কাজ করাতে হবে। একটি বিশ্ব পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, কাস্টমারের যতরকম কমপ্লেইন থাকে তার প্রথম সেক্টর হলো লন্ড্রি আর পরেরটা হলো টেইলারিং। এটা আপনাকে স্বীকার করে নিতেই হবে। বিশ্বের অনেক দেশে আমি গিয়েছি, সেখানে খোঁজে খোঁজে লন্ড্রি সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জেনেছি যে একই কমপ্লেইন সব জায়গায়।

দেখুন একজন ক্লায়েন্ট যতবার আমাদের কাছে কাপড় দিচ্ছেন ততবারই কিন্ত তিনি ভ্যাট দিয়ে যাচ্ছেন। এমন কি একসময় দেখা যায় যে কাপড়ের দামের চেয়েও ভ্যাটের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়। আমরা সেন্ট্রালি ভ্যাট দিচ্ছি। যাতে কোন ফাঁকি না থাকে। অনেক সময় আবার দেখা যায় ভ্যাট অফিসারের সাথে যোগসাজোসে কম ভ্যাট দিচ্ছেন বা দিচ্ছেনই না। এতে করে কোম্পানির সুনাম নষ্ট হয়। আমরা সেটা চাই না। অনেক সময় আমরা ভ্যাট বেশি দিয়ে থাকি। বলবেন কিভাবে? ধরেন ৫০ লাখ টাকার কাপড় এলো আমাদের কাছে। তার অনুপাতে কিন্ত আমাদের ভ্যাট দিয়ে দিতে হয়। এখন সেখানে একলাখ টাকার কাপড় আমরা ফেরত দিয়ে দিলাম। তার মানে কি দাঁড়ালো? ওই যে ফেরত দেয়া কাপড়ে তো ভ্যাটের টাকা আমরা আর ফেরত পাব না। সেন্ট্রালি ভ্যাট দেয়ার উদ্দেশ্যই হলো,ভ্যাট প্রদানে নয়-ছয় না করা, কিংবা দেখা যে ফ্রাঞ্চাইজিগুলো যেন ফাঁকি দিতে না পারে।

আরেকটু কম ভ্যাট দিতে পারলে আমাদের অনেক উপকার হতো। আমি আগেই বলেছি যে আমরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই ভ্যাট দিয়ে থাকি। একই কাপড়ের ওপর কাস্টমার যতবার ওয়াশের জন্য নিয়ে আসবে ততবারই আমাদের ভ্যাট দিতে হচ্ছে। দেখা যায় যিনি কাপড় কিনছেন তার ক্রয়মূল্যের চাইতেও কয়েকগুণ বেশি পরিমাণ ভ্যাট দিতে হয়। আবার সরকার যদি নিয়ম করে দেয় যে নতুন কাপড়ে একবার বা দুবার ভ্যাট নির্ধারিত। তখন তো আরেকটা সমস্যা এসে দাঁড়াবে। কোনটা নতুন আর কোনটা পুরাতন সেটা নির্ধারণ করাই বিপদ হয়ে দাঁড়াবে। সেখানে দুর্নীতির একটা সুযোগ রয়ে যায়।

আমাদের প্রতিষ্ঠানের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। আমি হোটেল শেরাটনে হাউজ কিপিং ম্যনেজার ছিলাম। সেখানে যখন কাজ করতাম তখন থেকেই এরকম একটা প্রতিষ্ঠান গড়ার চিন্তা করি। সেখানকারই অভিজ্ঞ কয়েকজন মিলে আমরা টপক্লিন নামের এই প্রতিষ্ঠান চালু করি। প্রথম দিকে সিঙ্গাপুরের সাথে যৌথভাবে আমরা কাজ করি। সিঙ্গাপুরের পার্টনার মেশিন সাপ্লাই দিতেন। আমরা ক্যামিক্যাল, ট্যাকনিক্যাল সাইডসহ এই লাইনে অভিজ্ঞরা সবাই মিলেই আসলে এটা গড়ে তুলি। সে দিক দিয়ে আমরা যারা ম্যানেজম্যান্ট পরিচালনা করছি, তারা সবাই এক কথায়ই বলতে পারি যে, আমাদের এখানে যত এক্সপার্ট আছেন অন্য কোন লন্ড্রি সার্ভিসে তা নাই। এটা একটা দিক। আরেকটা হলো আমরা সবসময় চেষ্টা করি ভালো ও উন্নত সেবা দিতে। আমরা সবসময় কোয়ালিটির দিকটা মেইনটেইন করি। শুরু থেকে আমরা আজ পর্যন্ত কোন লোকাল ক্যামিক্যাল ব্যবহার করি নি। বাইরে থেকে আমদানি করি। আর আমরা যে সকল মেশিনারি ব্যাবহার করি ওয়াশ, ড্রাই ইত্যাদি ক্ষেত্রে সবই কিন্ত পরিবেশ বান্ধব। আমাদের সবকিছুই স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হয়, চাইলে আমাদের অন লাইনে গিয়ে একজন গ্রাহক যে কোন জায়গা থেকে তার সব তথ্য দেখতে পারেন। বছরে কয়েকবার বাইরে থেকে অভিজ্ঞরা এসে আমাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন । যাতে করে প্রপারলি সেবার মান বাড়াতে সাহায্য করে। এটা কিন্তু অন্যদের মধ্যে দেখা যায় না। সেবা দিতে গেলে সুবিধা-অসুবিধা, কাস্টমারের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি, কমপ্লেইন থাকবেই। আর এর মাধ্যমেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমরা যেটা করেতে পারবো না সেটা আমরা ফেরত দিয়ে দিই। কারণ আমাদের আওতার মধ্যে যেটা নাই তা আমরা করতে যাব কেন? এটা তো কাস্টমারকে ফাঁকি দেয়া। সেটা আমরা কখনই করি না । এর জন্য অনেকেই বলে ছোট লন্ড্রি কাজ করে দিল আর টপক্লিন করতে পারল না। তারা কিন্ত জানেই না কাজটা কিভাবে হলো। আসলে কাজের মান বলে একটা কথা আছে। আমরা তো জুতার কালি আর কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঘষে কোনো সার্ভিস দিই না। সুতরাং এ ব্যাপারে কাস্টমারকেও সচেতন হতে হবে। সে দিক দিয়ে আমরা বলতে পারি, আমরা সর্বোতভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি সর্বোত্তম মানের সেবা প্রদানে।

সরকার যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে তাহলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব। একটি শিল্পের জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার সেটা আমরা পাচ্ছি না। বলতে পারি, আমাদের দেশে একটি শিল্পের উন্নয়নে সরকারি ফ্যাসিলিটি তেমনভাবে গড়ে উঠে নি। যা হয়েছে প্রায় সবই ব্যক্তিগত উদ্যোগে হয়েছে। আমাদের এই লন্ড্রি শিল্পের উন্নয়নে সরকার যদি এগিয়ে আসে তাহলে ভালো হয়।

এম. সাইদুল ইসলাম খান
ডিরেক্টর, টপক্লিন বাংলাদেশ লিঃ