লোন টেকওভার ও ব্যাংকের সাথে প্রতিযোগিতাই বড় চ্যালেঞ্জ

মোঃ জাকির হোসেন এফসিএ
বাংলাদেশের অন্যতম লিজিং কোম্পানি এনবিএফআই। বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স অনুযায়ী নন ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট নামে এ প্রতিষ্ঠান পরিচিত। এ ধরণের প্রায় ৩০ টি কোম্পানি আছে যারা ব্যাংকের সাথে প্রতিযোগিতা করে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে হচেছ। এখানে ব্যাংকই হচ্ছে তাদের প্রতিযোগী। এভাবে তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করে কাজ করাটাই এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকের অনেক লো-কস্ট ফান্ড আছে, অনেক ফান্ডের সোর্স রয়েছে তাদের। ব্যাংকগুলোর এভারেজ ফান্ড কস্টের তুলনায় নন ব্যাংকিং বা লিজিং প্রতিষ্ঠানগুলোর ফান্ড কস্ট তুলনামূলকভাবে বেশি । আবার অনেক ক্ষেত্রে লিজিং প্রতিষ্ঠানগুলোর ফান্ডের বড় সোর্স হিসেবে থাকে ব্যাংক। ব্যাংকের অর্থ দিয়েই তারা ব্যাবসা করে। যার কারণে তাদের ফান্ডের মূল্য বেশিমাত্রায় পড়ে যায়। আর এটাই মূলত এইসব প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লিজিং প্রতিষ্ঠানের মার্কেট পরিধি অনেক ছোট। মার্কেট পরিধির চেয়ে প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি। যেখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্র কমে আসছে, বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এই কারণে ভালো বিনিয়োগের অপশন না পাওয়া, বড় হলে ল্যান্ডিং কস্ট বেড়ে যায়। এনবিএফআই এর জন্য সেটা একটা বড় সমস্যা। এ সব সমস্যার সমাধানই বড় চ্যালেঞ্জ। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের আন্তরিক সেবার মাধ্যমেই গ্রাহকের মন জয় করে। ভালো সোবর কারণে এক বা দুই শতাংশ বেশি লভ্যাংশ দিতে হলেও গ্রাহকরা এনবিএফআইর সাথেই থাকে। এই গ্রাহকগুলো যদি কোন কারণে এই সব প্রতিষ্টানের প্রতি আস্থা হারিয়ে ব্যাংকের কাছে চলে যায় তাহলে তাদের টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে যায়। এবং এটা মূলত একটা কঠিন কাজ। এই কাজটাই করে যাচ্ছে দেশের এতো এতো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। অন্যদের হয়তো সুনাম কম, ফান্ড পর্যাপ্ত নেই, কিংবা তাদের সেবার মান সন্তষজনক না। আর সার্ভিসের জন্য বেশি পরিমাণ ফান্ডের জন্য কস্ট অফ ফান্ড বেশি হয়ে যাওয়ায় তারা ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের চ্যালেঞ্জটা বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। আর এভাবেই তারা দেশের মধ্যে কোনভাবে টিকে আছে। এটা তাদের মূল পার্ট।

অন্যদিকে তাদের ব্যাবসার অন্যতম একটা বিনিয়োগ হলো পুঁজিবাজার। সেখানের তাদের ফান্ডের পরিমাণ কম। তারা যে সাবসিডারি করে ক্যাপিটাল মার্কেটে ব্যাবসা করছে, সাবসিডারি পরিমাণ বেশি না করতে পারলে পুঁজিবাজারেও তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। নিজের ক্যাপিট্যাল কম রেখে সাবসিডারী ক্যাপিট্যাল বেশি ব্যাবসা করা সম্ভব নয়। সুতরাং ব্যাবসার যে দুটো মূল কোর্ড পার্ট রয়েছে তা মেইনটেইন করে নিয়ে নন ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলো চালেঞ্জ মোকাবিলা করে তাদের ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে সংগ্রামের মাধ্যমেই তারা বেঁচে আছে বা টিকে আছে। তার মানে হলো তারা তাদের নিজস্ব কোয়ালিটি ও সেরা সার্ভিসের মাধ্যমে ব্যাবসা করে টিকে আছে। লিজিং প্রতিষ্ঠানগুলো কখনও গ্রাহক ছেড়ে দেয় না। গ্রাহকদের ধরে রাখতে কিছুটা রিস্ক নিয়েই লোন দেয়। এবং সঠিক নার্সিয়ের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে পরে লোনেরটাকা আদায় করে। মার্কেটে যে সমস্ত কো-অপারেটিভ প্রতিষ্টানগুলো রয়েছে তারাও ব্যাবসা করছে। তারাও লোন দেয় এবং তাদের সুদের হারও অনেক বেশি। কিন্ত তাদের কাছ থেকেও কিন্ত অনেকে লোন নেয়। কারণ একটাই, সহজে লোনটা পাওয়া যায়। আবার তাদের কালেকশনগুলো কিন্ত অনেক ভালো । কারণ তারা সঠিকভাবে কালেকশন মনিটরিং করে। লিজিং প্রতিষ্ঠানগুলোরও একইভাবে মনিটরিং করতে হয় ফলে মনিটরিং কস্টটা একটু বেশি পড়ে যায়। এর ফলে ব্যাংকের চাইতে এ ধরণের প্রতিষ্ঠানের প্রফিট পার্সেনটেইজটা অনেক কম। এর কারণটা হলো সার্বিকদিক দিয়ে খরচটা তাদের চাইতে বেশি পড়ে যায়।

একজন উদ্যোক্তা তৈরির করার প্রকৃয়াকে বলে গ্রীনফিল্ড। একজন নতুন উদ্যোক্তা যখন আসবেন তখন তাকে গ্রীণ ফিল্ডে বিনিয়োগ করতে হবে। কোনো ব্যক্তি যখন বিনিয়োগ করতে আসে তখন শঙ্কা থাকে তিনি কতটুকু সফল হবেন। কোনো কারণে যদি তিনি সফল না হন তবে তারও যেমন ক্ষতি তেমনি প্রতিষ্ঠানেরও সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। সুতরাং এর ফলেও ব্যাংকের তুলনায় এই সব প্রতিষ্টানের বিনিয়োগ গ্রীন ফিল্ডে বেশি। কারণ এসব গ্রীণ ফিল্ড সুবিধাভোগকারীরা ব্যাংকে গিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ পান না। ফলে তারা লিজিং কোম্পানির কাছে আসে। যেহেতু তাদের ব্যবসা করতে হয় তাই এসব গ্রীন ফিল্ডের বিনিয়োগ কারিদের সঙ্গেই তারা টাকা দেন। পরে সঠিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের সফল হয়ে উঠতে এবং তাদের সহায়তার মাধ্যমে নিজেদের অর্থ তুলে নিয়ে আসেন। বর্তমানে মার্কেটে একটা পদ্ধতি চালু হয়েছে যে, অন্যের লোনগুলোকে টেক ওভার করা। এর ফলেও লিজিং কোম্পানিগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। নতুন কোনো উদোক্তা তৈরি হলে বা ভাল ব্যবসা করলেই ব্যাংকগুলো এসে তাদের ধরে নিয়ে যায়। এরপর কিছুটা কম লভ্যাংশে তাকে লোন দেয়। ফলে সে লিজিং প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্ত হয়ে ব্যাংকের কাছে চলে যায়। এটাও লিজিং কোম্পানিগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলা যায়।

বর্তমানে মার্কেটে পণ্য আছে যা এনবিএফআই কোম্পানিগুলো সেটা নিয়ে কাজ করে না। কারণ তাদের অনেকেই এভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি। অনেকে ফেক্টরিং করে আবার অনেকে করে না। এছাড়া ট্রাম ফাইন্যান্সের বাইরেও অনেক পণ্য রয়েছে যেগুলো নিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে লিজিং কোম্পানিগুলো কাজ করতে পারে না। এগুলো স্বাভাবিক করে দিলে ল লিজিং কোম্পানিগুলো সেদিকে যেতে পারে। সুতরাং এগিয়ে যাওয়ার জন্য নীতিমালা ও আইনের সাথে এদের মন মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্কেটে কিছু রুলস্ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের যেমন চেষ্টা তদবিরের জন্য নিজস্ব নিয়োম থাকবে ঠিক একইভাবে আইনটাও যদি স্ট্রং থাকে তাহলে যারা লোন নেবে তারা লোন পরিশোধের ক্ষেত্রে তৎপর হবে। আইনের সাথে লোন পরিশোধে আগ্রহী হলে প্রতিষ্ঠানগুলোও নতুন নতুন প্রডাক্টের দিকে যেতে পারবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে এনবিএফআই কারেন্ট একাউন্ট বা সেভিং একাউন্ট খুলতে পারে না। প্রতিদিন চেকের মাধ্যমে টাকা ওঠাবে বা জমা দিবে এমন লেনদেন করতে পারে না। ওডি টাইপের সিস্টেমটা এইরকম, যার যখন টাকাটা লাগবে তার ক্রেডিট সেংশন করা থাকলে সে চেকের মাধ্যমে টাকা তুলবে। আবার তার সারপ্লাস হলে সে জমা দেবে। এরকম টার্মের জন্য এনবিএফআই এর ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। টার্ম বেসিসে এনবিএফআই একটা নিদিষ্ট প্রিয়ডের লোন সেংশন করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করে দিতে পারে। যেহেতু তার সেংশন পিরিয়োডটা আরো বেশি রয়েছে তখন সে আবার ডিজবার্সমেন্ট নিল। তাছাড়া আইনগত কারণেই এনবিএফআই অনেকগুলো পণ্য উপভোগ করতে পারে না। যার কারণে এদের কিছু সীমাবদ্ধতা থেকে যায়।

বর্তমানে যতগুলো লিজিং কোম্পানি রয়েছে এরমধ্যে উত্তরা ফাইন্যান্স অন্যতম। তবে উত্তরা ফাইন্যান্সের এই অবস্থান একদিনে তৈরি হয়নি। ধীরে ধীরে কাজের মাধ্যমেই এতদূর এগিয়ে আসা। ১৯৯৬ সালে উত্তরা ফাইন্যান্স যাত্রা শুরু করে। এই প্রতিষ্ঠানের টপ ম্যানেজম্যন্ট খুবই মজবুত। এটা সফলতার অন্যতম কারণ বলা যেতে পারে। কোম্পানিটির এমডি ২০০৩ থেকে এখনও বহাল আছেন। তার কাজের দক্ষতা দিয়ে সঠিক পথ প্রদর্শণ করছেন প্রতিনিয়ত। তার ছায়াতেই সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সবাই কাজ করছে। আর এটাই কোম্পানিটির মূল শক্তি। কোম্পানিটির আরেকটি লক্ষ্যনীয় দিক হচ্ছে বোর্ড ওব ডিরেক্টর্স। তারা কোম্পানির উন্নয়নে অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কখনই হস্তক্ষেপ করেন না। প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য তারা তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেন। প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মীকে যে কোন ধরণের সহযোগিতার জন্য তারা সব সময় প্রস্তত থাকেন। যদি কোন গ্রাহক এসে বলে তাৎক্ষণিক ঋণ চান তবে তকে ডিরেক্টরদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা যাচাই বাছাই করে অনুমোদন করে দেন। সে অনুযায়ী আমরা গ্রাহককে ডিজবার্সমেন্ট করা হয়। এই যে দ্রুত সেবা, একমাত্র ডিরেক্টরদেও সহযোগীতার কারণেই সম্ভব হয়। সুতরাং বলা বাহুল্য, কোম্পানিটির সফলতা ডিরেক্টরদের সঠিক দিক নির্দেশনা আর সহযোগিতার ফসল। কোম্পানির প্রতি তাদের সু-নজর আর ম্যানেজম্যান্টের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, এ দুয়ের সমন্বয়েই আমাদের এ পর্যন্ত এগিয়ে আসা।

মোঃ জাকির হোসেন এফসিএ
ডিএমডি ও কোম্পানি সেক্রেটারি, উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিঃ