শতবর্ষের ঐতিহ্য নিয়ে সুনাম ছড়াচ্ছে কুমিল্লার রসমালাই

এ জেলায় বেড়াতে এসে রসমালাইয়ের স্বাদ নেননি এমন লোক কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। বিয়ে, ঈদ, পূজা, জন্মদিন কিংবা রাষ্ট্রীয় বড় অনুষ্ঠান কুমিল্লার রসমালাই ছাড়া আপ্যায়ন যেন জমেই না। যেমন স্বাদ, গুণ, সুনাম আর ঐতিহ্যের কারণে তেমনি রয়েছে কুমিল্লার রসমালাইয়ের জগৎজোড়া খ্যাতি। এমনকি আন্তর্জাতিক জিআই স্বীকৃতির তালিকায়ও নাম রয়েছে কুমিল্লার রসমালাই এর।

রসমালাইয়ের ইতিহাস : উইকিপিডিয়ার প্রকাশিত তথ্য মতে রসমালাই দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপালের একটি জনপ্রিয় মিষ্টি খাদ্য। ছোট ছোট আকারের রসগোল্লাকে চিনির সিরায় ভিজিয়ে তার ওপর জ্বাল-দেওয়া ঘন মিষ্টি দুধ ঢেলে রসমালাই বানানো হয়। বাংলাই রসমালাইয়ের উৎপত্তি স্থল। বাংলাদেশের কুমিল্লার রসমালাই খুবই বিখ্যাত। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরা রাজ্য তথা কুমিল্লার ঘোষ সম্প্রদায় দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে তাতে ছোট আকারের শুকনো ‘ভোগ’ বা রসগোল্লা ভিজিয়ে যে মিষ্টান্ন তৈরি করে, তা ক্ষীরভোগ নামে পরিচিতি পায়। ক্রমান্বয়ে এ ক্ষীরভোগ রসমালাই নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

১৯৩০ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার খড়িয়ালার খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন নামে দুই ভাই কুমিল্লায় এসে শহরের মনোহরপুর এলাকায় মাতৃভান্ডার নামে একটি দোকান দিয়ে ক্ষীরভোগ বা রসমালাই বিক্রি শুরু করেন। সুস্বাদু হওয়ায় এর বিক্রি বাড়তে থাকে। এক সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। খনিন্দ্র সেনের এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। বড় ছেলে শংকর সেন। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে মারা গেছেন। ছোট মেয়ের নাম স্মৃতি সেন। মনিন্দ্র সেন বিয়ে করেননি।

১৯৪০ সালে খনিন্দ্র সেন মারা গেলে একমাত্র ছেলে শংকর সেন মাতৃভান্ডার পরিচালনা করা শুরু করেন। মাতৃভান্ডারের ব্যবস্থাপক অনুপম দাস বাসসকে জানান, মাতৃভান্ডার নামে এ মিষ্টি দোকান প্রতিষ্ঠার পর তাদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তাদের অভিজ্ঞ ১০ কারিগর এ রসমালাই তৈরি করছেন। তাদের কাছ থেকে নতুন প্রজন্মের কারিগররা রসমালাই তৈরি শিখে নিচ্ছেন। দিনে দিনে এ রসমালাইয়ের খ্যাতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৮ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে জেলা পরিক্রমা অনুষ্ঠানে কুমিল্লার অন্যান্য ঐতিহ্য দেখানোর পাশাপাশি মাতৃভান্ডারের রসমালাইও দেখানো হয়। এরপর সারাদেশে রসমালাইয়ের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। দেশের বড় বড় সভা ও অনুষ্ঠানে এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের আপ্যায়ন করা হয় এ রসমালাই দিয়ে। আর কুমিল্লায় কোনো পর্যটক বা অতিথি এলে রসমালাইয়ের স্বাদ নেননি এমন ঘটনা বিরল।

রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া: রসমালাই বানানোর কৌশল এতটা সহজ নয়। কারিগররা জানান, প্রথমে বিভিন্ন গোয়ালার কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। এরপর ওই দুধ চুলার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় জ্বাল দেওয়া হয়। অন্তত দুই ঘণ্টা জ্বাল দেওয়ার পর দুধ ঘন হয়ে ছানায় রূপ নেয়। এরপর ছানা কেটে ছোট ছোট দানাদার মিষ্টির মতো বানানো হয়। পরে রসের মধ্য দিয়ে সেটি রসমালাইয়ে পরিণত করা হয়। দুধের ঘনত্ব যত বেশি হবে, রসমালাই তত বেশি সুস্বাদু হবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত গীতা পাসি কুমিল্লায় এসে মাতৃভান্ডার থেকে রসমালাই নিতে এসে এর বেশ প্রশংসা করেন। বর্তমানে প্রতি কেজি রসমালাইয়ের দাম ২৮০ টাকা।

কুমিল্লার মাতৃভান্ডারে প্রতিদিন প্রায় ৫ মণ রসমালাই তৈরি করা হয় বলে কারিগর সূত্রে জানা গেছে। মাতৃভান্ডার ছাড়া কুমিল্লার রসমালাই তৈরি হয় নগরীর ভগবতি পেড়া ভান্ডার, শীতল ভান্ডার, পোড়াবাড়ি, জলযোগসহ কয়েকটি মিষ্টির দোকানে। তবে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরের কুমিল্লা মাতৃভান্ডার নামের একটি প্রতিষ্ঠানে অমৃত এ রসমালাই যাত্রা শুরু করেছিল। আসল রসমালাই তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা মাতৃভান্ডারের কোনো শাখাও নেই।

আন্তর্জাতিক জিআই স্বীকৃতি: বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ১৯৯৪ সালের এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় সদস্য দেশগুলো। যার মধ্য দিয়ে প্রতিটি দেশ তার ভূখন্ডে উৎপাদিত পণ্য, বস্তু ও জ্ঞানের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) আইনের মাধ্যমে নিবন্ধনের অধিকারপ্রাপ্ত হয়।

২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন প্রণয়ন করে। ওই আইনের অধীনে ২০১৫ সালে বিধিমালা প্রণয়ন হয়। কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলমের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের সুপরিচিত দুটি পণ্য কুমিল্লার রসমালাই ও খাদিকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাই রসমালাইকে নিয়ে কুমিল্লার মানুষ গর্ববোধ করে।