শিল্পবান্ধব স্থিতিশীল নীতিমালা দরকার

শিল্প ভাবনা

তোফায়েল কবির খান:
আজ থেকে ৪৬ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ব্যবসা করতে এসে আমরা যতটুকু শুনি, তখন সাত বা এগারো পরিবার দেশের সকল ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। এখন হয়তো ৭ হাজার কিংবা ৭ লাখ পরিবার এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে এই ব্যবসা হতো না। এত শিল্প-কারখানা হতো না। আমরা যারা আছি, সবাই হয়তো শিল্পপতি হতে পারতাম না। শিল্পের উদ্যোক্তাও আমরা হতে পারতাম না।

স্বাধীনতার ফলেই আমরা যারা তরুণ, সেকেন্ড জেনারেশন, থার্ড জেনারেশন ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরেছি। এক্ষেত্রে একটা বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে।গত কয়েক বছর ধরে আমাদের জিডিপি ৭ শতাংশ অব্যাহত রয়েছে। অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করলে সত্যিই এটা রিমার্কেবল। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো। আমাদের অনেকগুলো সেক্টর এখন উন্নত ও পরিণত হয়েছে।

তবে আমাদের অনেক সমস্যাও রয়েছে। বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে বিদ্যুতের সমস্যা। রয়েছে অবকাঠামো সমস্যা। তারপর আমাদের অর্থ সংস্থান ও খরচ একটা সমস্যা। কিন্তু এতসব সমস্যার পরেও আমাদের অনেক সম্ভাবনা। কারণ আমাদের মানুষের ভালো কর্মসংস্থান হয়েছে। এখন লাখ লাখ মানুষ আমাদের প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করছে। ব্যবসার পরিধি বাড়ার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে।

আমরা আশা করছি, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। নতুন নতুন অনেক ব্যবসা গড়ে উঠবে। সরকার আমাদের কাজগুলোতে যে সাপোর্ট দিচ্ছে, সেগুলোর যদি ধারাবাহিকতা থাকে, তাহলে আমাদের দেশের ব্যবসার পরিধি বাড়বে। ২০২১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ আগামী চার বছর যদি আমাদের জিডিপি ৭ থেকে ৭.৫ থাকে তাহলে সত্যিই আমরা মধ্যম আয়েরদেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করতে পারব।

আমরা এখন এমন একটা পর্যায়ে আছি যে, সারাবিশ্ব এখন দৃষ্টি রাখছে, বাংলাদেশে কী কী ব্যবসা আরও বাড়ানো যায়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিমধ্যে জাপানের হোন্ডা কোম্পানি আমাদের এখানে এসেম্বলিং ইন্ডাস্ট্রি করেছে। আরো অনেক কোম্পানি, যেমন স্যামসাং এখানে ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। নরসিংদীতে এসেম্বলিংয়ের জন্য স্যামসাংয়ের একটা ফ্যাক্টরি হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য বড় যে কোম্পানিগুলো রয়েছে; যেমন লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ, তারাও হয়তো এদেশে আসবে।

বাংলাদেশ সরকার ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার একটা ম্যাগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আমরা যদি এই ১০০ স্পেশাল ইকোনমিক জোন বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে বিশ্বের নামকরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো এখানে এসে কারখানা করবে। আমাদের এখানে যেহেতু ১৬ কোটি লোকের একটা অভ্যন্তরীণ বাজার আছে। তাই বড় কিছুর সম্ভাবনাও আছে।

স্বাধীনতার সময় আমাদের বাৎসরিক মাথা পিছু আয় ছিল ৭২ (বাহাত্তর ডলার)। এখন আমাদের মাথাপিছু আয় ১৬০৫ ডলার। ১৬ কোটি লোকের মাথাপিছু আয় যদি ১৬০৫ ডলার; তারমানে আমাদের ইকোনমি কিন্তু ছোট না। অন্যান্য ছোট দেশের তুলনায় আমাদের ইকোনমি অনেক বড়।

সরকার যদি একটা সুষ্ঠু-সুন্দর নীতিমালার মাধ্যমে আমাদের ব্যবসার সুযোগ করে দেয়, আমরা অবশ্যই আমাদের ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাব। বাইরের বিশ্বে যখন যাব, সবাই বলবে বাংলাদেশেও বড় বড় শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আমরা আস্তে আস্তে হেভি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছি। বাংলাদেশে শিপ বিল্ডিং হচ্ছে। বাংলাদেশে আরএমজি সেক্টর হচ্ছে। লেদার ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে। জুট সেক্টরেও আমাদের বিশাল অবস্থান রয়েছে।

সবকিছু মিলিয়ে আমরা আশা করছি যে, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর আমরা যারা ব্যবসা করছি, আমাদের সঙ্গে কর্মী হিসেবে যারা সম্পৃক্ত এবং আমাদের যারা কাজে সহযোগিতা করছেন- সবাই মিলে একটা ভালো অবস্থানের দিকে যাচ্ছি।

আমাদের একটা প্লাস পয়েন্ট হলো- পৃথিবীতে যত বড় বড় দেশ আছে, আফ্রিকা ছাড়া শ্রমিক অর্থাৎ শ্রম শক্তি আমাদের এগিয়ে থাকার একটা বড় জায়গা। যেহেতু আমাদের ১৬ কোটি লোক। এরমধ্যে আমরা যদি ২০% লোককে সরাসরি শিল্প খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারি, তাও এখানে ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তারা যদি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, এই দেশ অবশ্যই আরো কয়েকগুণ এগিয়ে যাবে।

আরেকটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, স্বাধীনতার ৪৬ বছরে আমাদের শিল্প খাতের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, বেশিরভাগ কারখানা ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাশাপাশি এখানে সরকারেরও সহযোগিতা রয়েছে। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় সরকারি যে সহযোগিতাগুলো থাকা দরকার, আমাদের দেশে কাজগুলো সেভাবে হচ্ছে না।

ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য আমাদের সুনির্দিষ্ট একটা নীতিমালা প্রয়োাজন। ধরুন, ব্যবসার জন্য আমি একটা কারখানা করলাম। দেখা গেল এখানে গ্যাস দরকার। অথচ সময়মত গ্যাস পেলাম না। ছয় মাস-এক বছর ৫০ কোটি বা ১০০ কোটি টাকা দামের মেশিনারিজ পড়ে আছে। তারপরে কী হচ্ছে? ওই শিল্প প্রতিষ্ঠান বা ওই সেক্টরটি ‘রুগ্ন শিল্প’ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে এবং পত্র-পত্রিকায় আসছে ওই প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়েছে। আসলে কোনো ব্যবসায়ীই ব্যাংকের টাকা মারতে চান না।

স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে আমরা সরকারের কাছে শিল্প খাতের স্থিতিশীল অবস্থান চাই। একটা শিল্প সহায়ক নীতিমালা চাই। যেমন এখন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চলছে, সপ্তবার্ষিক পরিকল্পনা আসছে। সেই পরিকল্পনাটা যদি আমাদের এই দেশে সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সত্যিই আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

আমাদের এখন যে পরিমাণ তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে এবং মানুষের মধ্যে যে কর্মস্পৃহা জেগেছে, তা আমাদের শিল্প খাত বা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল সেক্টর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

২০২১ সালে আমাদের দেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে। আমরা যদি নীতিমালা এবং সরকারের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট সহযোগিতা পাই- সেটা ভালভাবেই সম্ভব। একটা পয়েন্টেই (ওয়ান পয়েন্ট সার্ভিস) যদি আমাদের কাজগুলো হয়; তাহলে ভালো হয়। এখন আমাদের একটা কারখানা স্থাপন করতে গেলে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১৭ থেকে ২০টা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করতে হয়। এটা যদি আমরা একটা পয়েন্ট থেকেই করতে পারতাম; অন্যান্য দেশে যেভাবে সেবা পাওয়া যায়, সেভাবে ওয়ান পয়েন্ট সার্ভিসে কাজগুলো করতে পারলে, ব্যবসায়ীদের জন্য কাজ করা সহজ হবে। বর্তমানে একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান শুরু করতে হলে শুধমাত্রু কাগজ-পত্র গুছাতে ছয় মাস চলে যায়। এটি যদি ছয় মাসের জায়গায় পনের দিন কিংবা এক মাসে করতে পারি, তাহলে তো উৎপাদনের দিক দিয়ে পাঁচ মাস এগিয়ে থাকা যেত। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। আশা করি আমাদের অন্যান্য ব্যবসায়ী ভাইয়েরাও বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করবেন।

সত্যিই আমি আবেগ আপ্লুত। স্বাধীনতার সময়; ১৯৭১ সালে আমার জন্ম। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর আমি আজকের বাজার পত্রিকায় আমার বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারছি। একে আমার সৌভাগ্য বলে মনে করছি।

তোফায়েল কবির খান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
খান ব্রাদার্স গ্রুপ