উদ্যোক্তা ভাবনা

হোম টেক্সটাইল শিল্পে অগ্রাধিকার চাই

শাহাদাত হোসেন সোহেল:
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে এসেও আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য কতটুকু এগুতে পেরেছে? জাতি হিসেবে ও একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আমাদের যে জায়গায় যাবার কথা, হয়তো এখনো সেখানে পৌঁছতে পারিনি সত্যি কিন্ত এর কাছাকাছি জায়গায় আমরা গিয়েছি। এর জন্য আমি এবং আমরা সবাই খুশি। তবে আরো কয়েক বছর আগেই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারতাম। কিন্ত বিভিন্ন প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক কারণে আমরা সেখানে পৌঁছতে পারিনি। বিশ্বায়নের এই সময়ে আসলে এই সব সমস্যা যে কেবল আমাদেরই হচ্ছে তা কিন্ত নয়। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বর্তমানে এই সব সমস্যার মধ্যে দিয়ে সময় পার করছে। সে অনুপাতে আনেক দেশের তুলনায় এখনও আমরা এগিয়ে আছি। এবং আমাদের অর্জনও অনেক। ২০১৭ সালে এসে আমরা যেখানে আছি, আমাদের অথনৈতিক ও জিডিপি গ্রোথ যেভাবে বাড়ছে, আমাদের অবকাঠামো যেভাবে এগুচ্ছে এটা অভাবনীয় ব্যাপার। আমরা সবসময় বলি সরকার এই করছে না, সেই করছে না। আসলে সরকার তার নিয়মে সুবিধা দিবে, কিন্ত বাস্তব অবস্থায় আমরা যারা বেসরকারিভাবে কাজ করি, তারাই মূলত এগিয়ে নিয়ে যাই। পৃথিবীর সব দেশে এটাই হয়।

আমাদের সামর্থ্য অনুসারে আরো এগোতে পারতাম, তা কেন পারছি না? আসলে চাইলে আমরা সেটাও এচিভ করতে পারতাম। স্থিতিশীল একটা বাণিজ্য নীতিমালা থাকলে আরো অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতাম। গত আট বছর ধরে তো আমি দেখছি আমরা স্থিতির মধ্যে দিয়েই যাচ্ছি। হ্যা, এটা বলা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে এটা ঠিক। বিশ্ব মন্দা, ব্রেক্সিট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তন এসবের মধ্যেও যে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এটা কিন্ত বিশাল ব্যাপার। তবে আমাদের প্রফিট মার্জিন কমে গেছে, এটা সত্যি। অর্থনীতি বাড়ছে, শিল্প প্রতিষ্ঠান বাড়ছে, কর্মপরিধি বাড়ছে। অন্য দিকে জিনিসপত্রের মূল্য বাড়ছে, পাশাপাশি আমাদের আয়ও বাড়ছে সমানতালে। কিন্ত প্রতিযোগিতার বাজারে উদ্যোক্তা হিসেবে আমাদের প্রফিট মার্জিন কমেছে, সেদিক দিয়ে আমাদের বাজার বড় হচ্ছে। এ কারণে আমি মনে করব যে, এটা স্বাভাবিক। আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিভিন্ন সমস্যার কারণে আমরা চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এ কারণে অনেক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা গিয়েছে। এরপরও আমাদের ধারাবাহিক গ্রোথ হার বাড়ছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও কিন্ত আমরা টিকে আছি এবং টিকে থাকব এমন আভাস কিন্ত রয়েছে।

বর্তমানের কম্বোডিয়ার শ্রমিক অসন্তোষ, মায়ানমারের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি এসব কারণে কিন্ত তাদের যেসব অর্ডার রয়েছে সেগুলো আমাদের দিকে ডাইভার্ট হয়ে এসেছে। ব্যবসায়িক দিক দিয়ে আগামী পাঁচ সাত বছর এ ব্যাপারটা আমাদের জন্য ভালো একটা দিক।

আমাদের জন্য চীন একটা বড় বাজার। তারাও ডিউটি ফ্রি এক্সেস দেয়ার কথা বলেছে। সুতরাং আমাদের জন্য সামনের দিনগুলো আরো সম্ভাবনার। এজন্য বলতে পারি সব ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য আসছে দিনগুলো ভালো হবে। আরো খুশির কথা হলো, ২০১৮ সালে গ্যাসের সমস্যাটাও আর থাকবে না। কারণ এলপিজির লাইনে এলএনজি ইনজেক্ট করবে সরকার। তারপর আমাদের ন্যাশনাল সাপ্লাই ব্যবস্থার মাধ্যমে সারা দেশে বিতরণ করবে। ফলে গ্যাসের সমস্যা আর থাকবে না। ইলেকট্রিসিটির সমস্যা নেই, গ্যাসের সমস্যাও থাকছেনা, ইনফ্রাস্ট্রাকচার সমস্যা প্রায় নেই বললেই চলে। হয়তো ইউরোপ আমেরিকার মতো এখনও আমরা হতে পারিনি। কিন্ত ব্যবসার জন্য যা যা দরকার তার প্রায় সবকিছুই আমরা পেতে যাচ্ছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা সারা দেশেই ভালো। পদ্মা সেতু হলে যোগাযোগ আরো সহজ হয়ে যাবে। সবকিছুই আসলে এখন পর্যন্ত অনুকূলেই রয়েছে। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এসে, আগামী তিন বছর পর, ৫০ বছরে গিয়ে আমরা ভালো একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়াবো। এ ব্যাপারে আমি প্রচন্ডরকম আশাবাদী।

বাংলাদেশে প্রতি বছর পরিবেশ দূষণের কারণে ৪২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। যেটা জিডিপির ২ থেকে ৪ শতাংশ। একজন শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আমার কিছু বলার আছে।
সরকার এবং আমরা সবাই একসঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি। এ সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। আমরা সবাই জানি, হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সাভারের যেখানে নতুন শিল্পাঞ্চল করা হয়েছে সেখানে সেন্ট্রাল ইটিপি আছে। তারমানে সব বর্জ্যমিশ্রিত পানি সেখানে শোধন করা হবে। এটা কিন্ত সরকারই উদ্যোগ নিয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তদারকি আর পরিদর্শনের ফলে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোরও এই ফ্রেমওয়ার্কের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখানে প্রতিনিয়ত উন্নয়ন হচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে ফলে সবাইকে ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আসতে হচ্ছে। ৪২ হাজার কোটি টাকা আমার কাছে বেশি মনে হচেছ, যেহেতু এখন পর্যন্ত সেই রিপোর্টটা আমার কাছে আসেনি, তাই এ ব্যাপরে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না।

কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করাটা সময়ের দাবি। আমরা কিন্ত বিশ্ব মন্দার ধাক্কাটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ,মেই অস্থির হয়ে উঠছে। এ কারণে আমরা কিছুটা ভয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। তার পরেও আমাদের সামরে দিকে নিয়ে যেতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা প্রস্তত আছি, কিন্ত এই সব দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের জন্য প্রক্রিয়াগতভাবে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। চায়না ১০০ কোটি মানুষের জনবহুল একটা দেশ। সেই বাজার যদি আমরা ধরতে পারি তাহলে আমাদের উন্নতি হবে। এ কারণে নতুন করে শিল্প প্রতিষ্ঠান হবে, বিনিয়োগ হবে, নতুন কর্মসংস্থান হবে। এটা আমাদের জন্য বড় একটা ব্যাপার।

ব্যক্তি উদ্যোগে তো আমরা যাব, কিন্ত আমাদের অভিভাবক হিসেবে সরকারকে সে দায়িত্ব পালন করতে হবে। দেশের স্বার্থে যখন আরেকটি দেশ এগিয়ে আসে তখন বন্ধুভাবাপন্ন অবস্থায় সরকারকেই আগে সে পদক্ষেপটা নিতে হয়। এখন আমাদের পশ্চিমের দিক থেকে পূর্ব দিকে চোখ ফেরাতে হবে। কারণ পশ্চিমে তো আমাদের বাজার রয়েছেই। এখন সে বাজারটাকে পূর্বের দেশগুলোতে বিস্তৃত করার সময় এসেছে। ভৌগলিক দিক দিয়ে আমরা এখন এমন এক অবস্থানে আছি যে দুই দিকেই আমাদের কানেকটিভিটি সহজ এবং সুন্দর। আর এই সুযোগটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে।

টেরি-টাওয়াল ও হোমটেক্স শিল্পের বর্তমান অবস্থার কথা সম্পর্কে বলতে হয়, তাহলে বলব, বর্তমানে এ শিল্প খাতটির অবস্থা খুব একটা ভালো না। সুতার দাম বেশি, পাকিস্তান জিএসপি ফ্যাসিলিটি পায়। ভারত এই বাজারে নতুন করে প্রবেশ করেছে, আগে তারা ছিল না। আমরা যে ক’জন এই সেক্টরে আছি সবাই চরম প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। খুব কষ্ট করে নাজুক অবস্থার মধ্যে আমরা টিকে আছি। জুট, চামড়া, গার্মেন্টস্ প্রত্যেকেই নিজস্ব একটা আলাদা সেক্টর। এসব বিবেচনায় আমরা ২০১৭ সালে এসে আবেদন জানাচ্ছি, টাওয়েল ও হোমটেক্স শিল্পকেও যেন সরকার আলাদা একটা সেক্টর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এবং নার্সিংয়ের মধ্যে নিয়ে আসে। সারা দেশে মাত্র ১১টি প্রতিষ্ঠান টিকে আছে। বাকি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধ হওয়ার পথে। তাই সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। নার্সিং করতে হবে। না হলে একসময় দেখা যাবে এই ইন্ডাস্ট্রিটা ইতিহাস হয়ে যাবে। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

এম শাহাদাত হোসেন সোহেল
প্রেসিডেন্ট
বাংলদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স
অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন- বিটিটিএলএমএ