অবহেলিত জনপদ উন্নয়নে আলোর দিশারি ‘সোলার মিনি গ্রিড’

শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী রয়েছেন উইনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ পরিচালকের দায়িত্বে। কাজ করেন সোলার বেইজড এনার্জি ও নানা ধরনের প্রজেক্ট ডেভেলপ নিয়ে। তার এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে সোলার এনার্জির নানা দিক নিয়ে আলোচনা করছেন দৈনিক আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন-এবি টিভির সাথে। আলোচনার অনুলিখন তাঁরই জবানিকায় প্রকাশ করা হলো।

আজকের বাজার এবি টিভিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আলোচনার শুরুতেই বলতে চাই, আমাদের সৌরশক্তির ল্যাবে আমরা অনেক ধরনের সৌরশক্তি নির্ভর উদ্ভাবনী প্রকল্প নিয়ে কাজ করি। এর মধ্যে আছে সোলার ফেরি বোট,  যেটাকে আমরা বলি খেয়ানৌকা। স্বয়ংক্রিয় সৌর সেচ  প্রকল্প এবং আমরা ইতিমধ্যে সোলার পাওয়ারড রিকশা বানিয়েছি, যা ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রাম এলাকা বিদ্যুতায়নের জন্য সোলার ডিসি ন্যানো গ্রীড। আমরা এরই মধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি রিমোট এলাকায় প্রায় ১০টি সোলার মিনি গ্রীড স্থাপনে কারিগরী সহায়তা প্রদান করেছি, যার প্রতিটি থেকে প্রায় ১০০০ বাড়িঘর, দোকানপাট, ক্ষুদ্র শিল্পে শহরের মতো বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, আমরা অন্ধকারচ্ছন্ন এলাকাকে আলোকিত করার জন্য কারিগরী সহায়তা প্রদান করছি ।

যে সমস্ত প্রত্যন্ত এলাকায় অদূর ভবিষ্যতে গ্রীড বিদ্যুতায়নের আওতায় আসার সম্ভাবনা নেই, সে সকল এলাকায় এ রকম প্রায় ১০টি সোলার মিনি গ্রীড স্থাপন করেছি। এসব সোলার মিনি গ্রীডের বিদ্যুৎ আমাদের গ্রীড বিদ্যুতের চেয়েও নির্ভরযোগ্য। কারণ আমাদের মিনিগ্রীড সমূহে কোনো লোডশেডিং নেই। যেমন ভোলার মনপুরায়, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, বাঘা, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, কুড়িগ্রামের নারায়ণপুর, নরসিংদীর রায়পুরা, কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়, মানিকগঞ্জের দৌলতদিয়ার বাগুটিয়া ইউনিয়নের যমুনা নদীর চরে ও সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর চরে আমাদের এ রকম মিনি গ্রীড রয়েছে। এসব এলাকার প্রত্যন্ত চরের।চারপাশে নদী থাকায় এখানে বিদ্যুৎ যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। যদিওবা যায়, তা হবে খুবই ব্যয়বহুল। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার পরিবার আমদের এ সকল গ্রীড থেকে বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। আমরাই বাংলাদেশে প্রথম এ সকল সোলার মিনিগ্রীড ব্যাপকভাবে প্রসারে কারিগরী সহায়তা প্রদান করছি।

সোলার গ্রীডের অর্থায়ন হয় কীভাবে

এ সকল প্রকল্পগুলো প্রায় সবই আমার ডিজাইন করা। আমি সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক হিসেবে কিংবা ব্যক্তিগত ভাবে এসকল প্রকল্পে কারিগরী সহায়তা প্রদান করি। এগুলোর অর্থায়ন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ইডকল (ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড) যারা বিদেশি অনুদানও অর্গানাইজ করে। এ সকল প্রকল্পের জন্য ৫০ ভাগ অনুদান, ৩০ ভাগ সফট লোন ৬% ইন্টারেস্টে ইডকল প্রদান করছে। আর বাকি ২০ ভাগ যিনি উদ্যোক্তা, তাকে মূলধন হিসেবে প্রদান করতে হয়।

সোলার বিদ্যুৎ যেহেতু বেশ দামি, তাই আমাদের এ রকম ফিন্যান্সিয়াল মেকানিজমের পরও উদ্যোক্তাদের মূলধনের ১৫ থেকে ২০ ভাগ পর্যন্ত রিটার্ন ধরে, বিদ্যুতের মূল্য পড়ে ৩০ টাকার মতো। শহরে যেখানে ৯-১০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়, সেখানে প্রথমে এটাকে একটু দাম বেশি মনে হলেও আসলে বিদ্যুৎ পাওয়ার তুলনায় এটা খুব বেশি না। কারণ এমন প্রত্যন্ত এলাকায় সে তো গ্রীড কোয়ালিটির বিদ্যুৎ প্রাপ্তি চিন্তাও করতে পারে না। বিদ্যুৎ না পাওয়া মানে তো সমস্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া। আমি যখন আমাদের মিনিগ্রীড এলাকাগুলোতে যাই, তখন দেখি সোলার মিনিগ্রীড সমূহ স্থাপনের পর এলাকায় অনেক পরিবর্তন এসেছে।

বিদ্যুৎ পাওয়ার পর সে টেলিভিশন দেখতে পাচ্ছে, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছে, মোবাইল চার্জ করতে পারছে, বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করছে, বিদ্যুতের আলোয় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা হচ্ছে, গ্রাম এলাকায় ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে উঠছে, গ্র্যাইন্ডিং মেশিন ব্যবহার করতে পারছে, ধান ভাঙা মেশিন, বৈদ্যুতিক সেচ ব্যবহার করছে, কাঠ চেরাই হচ্ছে। আগে কিন্তু এসব এলাকায় কেবলই কৃষিকাজ করা ছাড়া আর কিছু সম্ভব ছিল না। ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটিজ না থাকার কারণে এলাকার তরুণেরা শহরমুখী হতে বাধ্য হতো। অথচ মিনি গ্রীডের বিদ্যুতের ফলে এখন সেখানে ছোট ছোট শিল্প হচ্ছে, ওয়ার্কশপ হচ্ছে, ওয়েল্ডিং মেশিন বসানো যাচ্ছে; মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

এ ধরনের গ্রীডের প্রতিটি প্রায় ১০০০ পরিবার, ক্ষুদ্র শিল্প ও দোকানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এ ধরনের একটি মিনিগ্রীড (২৫০ কিঃ ওঃ) স্থাপনের খরচ প্রায় সাড়ে আট হতে নয় কোটি টাকা। এসকল মিনিগ্রীডের ক্ষমতা ২৫০ কিলোওয়াটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। কারণ এর চেয়ে বেশি করতে গেলে সরকারের বিভিন্ন অনুমোদন প্রয়োজন হয়, যা প্রাপ্তি সময় সাপেক্ষ। ২৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতা পর্যন্ত মিনিগ্রীড তৈরিতে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না। ইডকল তাই এই ক্ষমতার মধ্যে মিনিগ্রীডের আকার সীমিত রাখছে। আমার কথা হচ্ছে, বিদ্যুতের চাহিদা তো সব সময়ই বাড়ছে। সরকার যদি এটার সীমা ১ মেগাওয়াট করে দেয়, তাহলে তা গ্রামবাংলার বিদ্যুতায়ন এবং উন্নয়নের জন্য বিশাল সহায়ক হয়।

সরকার তো নিজেই বিদ্যুতের পক্ষে কথা বলছে, তাহলে এতে জটিলতা কোথায়?

আসলে অসুবিধা হচ্ছে এব্যপারে আমাদের কোন সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা দরকার। দেখা যাচ্ছে, উদ্যোক্তা যারা, তারা লার্জ স্কেল পাওয়ার জেনারেশন করে লোকালিটিতে দিচ্ছে, তো তাদেরকেও কিছু সুবিধা দিতে হবে। তারা তো ব্যবসা করতে চায়। আমাদের মিনি গ্রীডগুলোর প্রায় সবই এখন সর্বোচ্চ সীমায় কাজ করছে, কিন্তু চাহিদা তো দিনে দিনে বাড়ছে। কিন্তু আমরা এসকল মিনিগ্রীডের ক্ষমতা বাড়াতে পারছি না। সরকার যদি নীতিমালা করে এর সীমা বাড়িয়ে দেন, তাহলে আমাদের কাজের যেমন সুবিধা, তেমনি গ্রামের মানুষ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে। নরসিংদীতে গিয়ে আমি দেখেছি, গ্রামের ছোট একটি রেস্টুরেন্ট ২ বছরেই বেশ বড় হয়েছে দোকানের মালিক সেখানে মাইক্রোওভেন বসিয়েছে, ফ্রিজ এনেছে, সারা দিন টেলিভিশন চলছে সৌরবিদ্যুতে। আমি রেস্টুরেন্টের মালিককে বললাম, সারা দিন টেলিভিশন চালালে আপনার লস হয় না? জবাবে তিনি বললেন, ‘লস না, টেলিভিশন চালালে আমার লাভ হয়। কারণ টিভি থাকলে বেশি কাস্টমার আসে। বসে বসে টিভি দেখে আর চা, বিস্কুট, খাবারের অর্ডার দেয়।’ ওই এলাকায় আগে বাহন ছিল গরু ও ঘোড়ার গাড়ি, কিন্তু বিদ্যুৎ আসার পর ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চলছে, চার্জিং হচ্ছে যা আমাদের প্রাথমিক জরিপে ছিল না। এ ছাড়া ইরিগেশন এলাকায় সৌরবিদ্যুতের বড় চাহিদা হয়েছে। আগে এটা ছিল না। তারপর এখন আরেকটা জিনিস দেখা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ যাবার পর গ্রামেও শহরের মতো অবকাঠামো হচ্ছে, সেখানে চাপকলে তারা মোটর বসিয়ে ওভারহেড ট্যাংকে পানি তুলে ব্যবহার করছে শহরের মত। এসবের কারণে আমাদের প্রাথমিক অনুমানের বাইরেও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে; গ্রীড বসানোর সময় আমরা এ রকম লোড গ্রামে হবে, এমনটা ভাবিনি। আসলে উন্নয়নশীল এলাকায় এমনটি হবেই।

বাণিজ্যিকভাবে এই বিদ্যুতের সম্ভাবনা

গ্রীডগুলো তো এরই মধ্যে বাণিজ্যিক। যারা উদ্যোক্তা, তাদের জন্য এটা একটা বিজনেস মডেল। তাদের জন্য আমরা যে ফিন্যান্সিয়াল মডেল বানাই, তাতে ২০ ভাগ ইক্যুইটি সাপোর্ট তারা দিচ্ছে। আর আট থেকে দশ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করার পর তারা নিজেরাই এসব গ্রীডের মালিক হয়ে যাচ্ছে। পরে তারাই এটা চালাবে।

সারা দেশে ২০১৮ সালের মধ্যে ৫০টা মিনিগ্রীড করার পরিকল্পনা ইডকলের রয়েছে। সারা দেশে কতগুলো মিনিগ্রীড দরকার হবে, তা আসলে পরিষ্কারভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে ২০২১ সালে সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুসারে সবার জন্য বিদ্যুৎ দেওয়ার পরিকল্পনায় সোলার মিনিগ্রীড অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। কারণ এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পৌঁছানো তখনো সম্ভব হবে না। যেমন মনপুরা, কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন কিংবা উড়িরচর। এসব এলাকায় গ্রীড বিদ্যুৎ নিতে হলে নদী পার হতে হবে বা সাগর ক্রস করতে হবে। আর এখানে লোডও এতটা নেই। ফলে জাতীয় গ্রীড বিদ্যুৎ এসব জায়গায় ব্যবসায়িকভাবে সফল হবে না, সোলার মিনিগ্রীডই এসব এলাকার জন্য অধিক উপযুক্ত।

সারা দেশে আনুমানিক ১৫০-২০০ মিনিগ্রীড হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এটা নিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা এখনো হয়নি। যারা উদ্যোক্তা তাদের বেশির ভাগ এনজিও, তারা অফ গ্রীড রুরাল এরিয়ায় কাজ করে, তারা এলাকাগুলো নির্বাচন করে নিয়ে আসে, এসব তালিকা ইডকলের অনুমোদনের জন্য পাঠালে তারা এগুলো বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে অনুমতি চায়। মন্ত্রণালয় তাদের লাইন এজেন্সি যেমন পিডিবি, আরইবির কাছে জানতে চায় যে এসব এলাকায় আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রীড সম্প্রসারনের সম্ভাবনা রয়েছে কিনা। যদি জানা যায়, শিগগির বিদ্যুৎ আসবে না, তাহলে মন্ত্রণালয় এ সমস্ত জায়গায় মিনিগ্রীড করার অনুমোদন দেয়। অনুমোদন পাবার পর আমরা ইডকলের আর্থিক সহায়তায় মিনিগ্রীড স্থাপনের কারিগরী সহায়তা প্রদান করি।

মিনিগ্রীড গুলোর জন্য অন্যতম একটি সমস্যা হল মিনিগ্রীড স্থাপিত এলাকায় জাতীয় গ্রীডের সম্প্রসারন। গত বছরের ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ সপ্তাহে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেসব এলাকায় মিনিগ্রীড রয়েছে, কিন্তু জাতীয় গ্রীডের বিদ্যুৎ পরে আসবে তাদের পলিসি কী হতে পারে, মন্ত্রণালয়কে তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। ইনভেস্টরদের ইনভেস্টমেন্ট কীভাবে সিকিউর করা যায়? সরকারকে এটা নিস্চিত করতে হবে, নচেৎ উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবেন না। এটা সহজভাবে এমন হতে পারে, মিনিগ্রীডের বিদ্যুৎ সরাসরি ন্যাশনাল গ্রীডে সরবরাহ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ট্যারিফটাও নেগোশিয়েট করা যায়, সহজে ক্যালকুলেট করা যায়। এখন মিনিগ্রীড বিদ্যুতের দাম বেশি পড়ে। কেননা, এই বিদ্যুতে ব্যাটারি ব্যাংক ব্যবহার করতে হয়। সৌরশক্তি তো শুধু দিনের বেলায় পাওয়া যায়। আর মিনিগ্রীড সমূহে আমাদের ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাটারি ব্যাংক লাগে। আর এতে দাম বেশি পড়ে। যদি মিনিগ্রীড এলাকা সমূহে জাতীয় গ্রীডের সম্প্রসারন হয় তাহলে ব্যাটারি বাদ দেওয়া যায় এবং মিনিগ্রীডের বিদ্যুৎ সরাসরি জাতীয় গ্রীডে বিক্রি করা যায়। এক্ষেত্রে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের মুল্য এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসবে।

এসব পলিসি একটু ফাস্টার করা দরকার। তাহলে উদ্যোক্তারা লাভবান হতে পারেন। আবার অনেক সময় বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয়ের লাইন এজেন্সির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানসিকতার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। তারা মনে করে, এখানে মিনি গ্রীডের অনুমোদন দিলে এলাকাটা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এই সুযোগ কেন দেব? এসবে কিন্তু সাধারণ মানুষই বঞ্চিত হচ্ছে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যে এলাকায় বিদ্যুৎ যায়, সেই এলাকাটি অন্ধকার থেকে আলোতে চলে আসে। মানুষের জীবনমানের বড় ধরনের পরিবর্তন হয়। এটি না দেখলে বোঝা যাবে না। তাই এসব ব্যাপারে দ্রুত একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রনয়ন করা উচিত। যেখানে বিদ্যুৎ নেই, সেখানে সোলার মিনিগ্রীডের অনুমতি দিয়ে দিলেই হয়।

একটা উদাহরণ দিই, সন্দ্বীপে একটা এনজিও মিনিগ্রীড করতে চাইল, কিন্তু পিডিবি থেকে বলা হলো যে সেখানে সাবমেরিন কেবল দিয়ে বিদ্যুৎ নেওয়া হবে। ফলে সোলার মিনিগ্রীডের অনুমোদন দেওয়া হলো না। সেটা ছিল ২০১২ সাল। ২০১২ থেকে আজ ২০১৭ পর্যন্ত ঐ এলাকায় কিন্তু জাতীয় গ্রীডের বিদ্যুৎ কিংবা মিনিগ্রীড কোনোটাই হয়নি। ফলে বঞ্চিত হলো সাধারণ মানুষ। দেশের একটি বিপুল জনগোষ্ঠিকে অবিদ্যুতায়িত রাখার মূল্যায়ন কে করবে? হাতিয়ার কিছু জায়গায়ও এমন হয়েছে, মন্ত্রনালয় থেকে বলার পরও আমরা মিনিগ্রীড স্থাপনের অনুমোদন পাইনি। এখন তাহলে হলোটা কী? পিডিবিও জাতীয় গ্রীডের বিদ্যুৎ দিচ্ছে না, মিনি গ্রিডও হচ্ছে না; ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষ বিদ্যুৎ না পেয়ে ভুগছে। আমি বলব, একধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এগুলো হচ্ছে। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে সরকারকেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সুস্পষ্ট নীতিমালা করতে হবে।

মিনিগ্রীড নিয়ে কাজ আমাকে বেশি তৃপ্তি দেয়

আমার অন্তত ১০০ টি প্রকল্প নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তবে প্রত্যন্ত এলাকায় মিনিগ্রীড স্থাপনের পর আমার যে তৃপ্তি তা অন্যগুলোর চেয়ে একেবারেই আলাদা। কারণ এতে সরাসরি মানুষের উপকার করা হচ্ছে; আমি মানুষের তৃপ্তি সরাসরি দেখতে পাই। এরচেয়ে বড় আর কী হতে পারে, অন্ধকারের মানুষগুলোকে আলোর সুবিধা দেয়া এটা বড়ই তৃপ্তিকর।

জাতিসংঘ পুরস্কার অর্জন

চাকুরী জীবনের শুরুতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্লানিং ও ডিজাইনে কাজ করি অতপর ২০০৭ সালে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে যোগদানের পর থেকে সৌর বিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করি, আমি দেখেছি আমাদের সোলার হোম সিস্টেমগুলোতে প্রায় ৩৫ ভাগ বিদ্যুতের ব্যবহার হয় না। এই অব্যবহৃত বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য একটা আইডিয়া ডেভেলপ করা হয়। এই ইনডিভিজ্যুয়াল সিস্টেমগুলোকে কানেক্ট করে যদি স্মল গ্রীড তৈরি করা যায় এবং তাদের মধ্যে যদি বিদ্যুৎ আদান-প্রদান করা যায়, তাহলে অব্যবহৃত বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায়।

ইডকলের আর্থিক সহয়তায় গবেষনা প্রকল্পটিতে সোলশেয়ার ও সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ যৌথভাবে গবেষনা করে। সোলশেয়ার থেকে ২০ লাখ আর ইডকল থেকে ৫৭ লাখ, মোট প্রায় ৭৭ লাখ টাকার গবেষনা প্রকল্পটি নিয়ে আমরা ডিভাইসগুলো ডেভেলপ করি। এ প্রকল্পের আওতায় একজনের বাড়িতে উৎপাদিত বাড়তি বিদ্যুৎ চলে যায় আরেক জনের ঘাটতি পুরনে। এভাবে এ ধরনের বিদ্যুতের লেনদেন ঘটে নতুন এক প্রযুক্তির মাধ্যমে। এক বছর রিসার্চ করে আমাদের প্রথম পাইলট প্রজেক্ট শরীয়তপুরের জাজিরায় স্থাপন করি। এখানকার আটটা ফ্যামিলিকে যুক্ত করে, যারা হোম সোলার ব্যবহার করে, তাদের সঙ্গে আমাদের এই পাইলট প্রকল্প চলছে। এ প্রকল্পটি আমরা গত বছর জার্মানিতে প্রেজেন্ট করি, আউটস্টান্ডিং সোলার প্রজেক্ট ক্যাটাগরিতে আমরা “ইন্টার সোলার” পুরস্কার পাই। এটিই আবার ২০১৬ সালের নভেম্বরে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে জাতিসংঘে “মোমেন্টাম ফর চেঞ্জ” পুরষ্কার লাভ করে। মরক্কোতে এই পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

সোলার এনার্জি সম্প্রসারণে করণীয়

সোলার এনার্জি সম্প্রসারণের জন্য দুটি জিনিস বিবেচনা করা যায় এক গ্রিড এলাকা, দুই আর অফ গ্রিড এলাকা। গ্রিড এলাকায় লার্জ স্কেলে সোলার এনার্জি উৎপাদন করে সরাসরি জাতীয় গ্রীডে দিয়ে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সরকার যে পলিসি নিয়েছে, আমি তা অ্যাপ্রিসিয়েট করি। মন্ত্রণালয়ের লাইন এজেন্সি যেমন পিডিবি, ইজিসিবি, আরপিসিএল এটা নিয়ে কাজ করছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানী নীতিমালায় বলা হয়েছে ২০২০ সাল নাগাদ জাতীয় গ্রীডে অন্তত ১০% নবায়যোগ্য বিদ্যুৎ থাকতে হবে। আর বেসরকারিভাবে আপনার অকৃষি জমিতে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করলে সরকার তা জাতীয় গ্রীডে কিনে নেবে। এটি সাহসী পদক্ষেপ। বর্তমানে জাতীয় গ্রীডে ২ হাজার মেগাওয়াট সোলার বিদ্যুতের উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে মন্ত্রনালয় কাজ করছে। ২০২১ সাল নাগাদ সবার জন্য বিদ্যুৎ এই লক্ষ্য পূরণে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পসমূহ বড় ধরনের অবদান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

আর অফ গ্রীড এলাকার ব্যাপারে সরকারকে পরিস্কার সিন্ধান্ত নিতে হবে, পিডিবি বা আর ইবির বিদ্যুতায়নের প্রকল্প আছে বলে সময় নষ্ট করা যাবে না। যেখানে খুব শিগগিরই জাতীয় গ্রীডের বিদ্যুৎ যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, ওই সব এলাকায় দ্রুত মিনি গ্রীড স্থাপনের অনুমোদন দিয়ে দিতে হবে। আর মিনি গ্রীড নিয়ে আমি বলব, এখন আমি আমার সবগুলো মিনিগ্রীডকেই তৈরি করি “গ্রীড রেডি”, অর্থ্যাৎ এমনভাবে আমরা তা ডিজাইন করছি, যা সরাসরি জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ রপ্তানী করতে পারবে। ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ সরকারের এই ভিশনের সফলতার জন্য এ সবই সহায়ক বলে আমার মনে হয়।

শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী

সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ,
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

ইমেইলঃ shahriar.ac@gmail.com