অর্গানিক পোল্ট্রি ফার্ম করার কৌশল এবং করণীয়

অর্গানিক ফুড অর্থাৎ রাসায়নিক পদার্থ ছাড়া জৈব পদ্ধতির উৎপাদিত খাদ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। রাসায়নিকের বিষাক্ততা থেকে মানুষ বাঁচতে চায়। শাকসবজি, ফলমূল, খাদ্যশস্য যেমন অর্গানিক পদ্ধতিতে উৎপাদন করা যায় তেমনই পোল্ট্রিও করা যায়। তবে একটু ঝামেলাযুক্ত। ঋঅঙ এর মতে, অর্গানিক পদ্ধতিতে পশুপাখি চিকিৎসায় ব্যবহৃত রাসায়নিকের মাত্রা বেশ কম থাকে। অনেক ক্ষেত্রে অর্গানিক খাদ্যে নাইট্রেটের পরিমাণ কম পাওয়া গেছে।

অর্গানিক ফুড নিয়ে বিশ্বে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে। সম্প্রতি ‘অর্গানিক ফুড এন্ড ফার্মিং, মিথ এন্ড রিয়ালিটি’, বিষয়ে গবেষণা হয়েছে। বিশ্বের ৭৭ জন বিশেষজ্ঞ এবং ৩৬টি প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে গবেষণা করেন। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছেÑ অর্গানিক খাদ্যে এন্টিবায়োটিক ও নাইট্রেটে কম পাওয়া গেছে। এ দুটোই মানবদেহের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অর্গানিক মাংস ও ডিমে শতকরা ৩০ ভাগ পুষ্টি বেশি পাওয়া গেছে। কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব অর্গানিক এগ্রিকালচার মুভমেন্টের অনুসৃত ১৭টি মৌলিক নীতি অন্যতম হলো পোল্ট্রির স্বাধীনতা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা। অর্গানিক পদ্ধতিতে মুরগির ঘনত্ব কম রাখা, খোলামেলা চলাফেরার সুযোগ দেয়া, প্রাকৃতিক খাদ্য খাওয়ানো ও মানবিক আচরণ কম হয়। অসুস্থ হলে বা রোগ প্রতিরোধের জন্যও অর্গানিক পদ্ধতিতে করা হয়।

প্রকৃতপক্ষে অর্গানিক খামারের মালিকরা পোল্ট্রি চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি ও ভেষজ পদ্ধতি ব্যবহার করে। নন অর্গানিক পদ্ধতির পোল্ট্রি উৎপাদনে গাদাগাদি করে বেশি ঘনত্বে পালন করা হয়। এতে জীবাণু সংক্রমণ বেশি হয় এবং দ্রুত বিস্তার করে লাখ লাখ মুরগি মারা যায়। অর্গানিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ননঅর্গানিকে মুরগির জীবনকাল খাঁচায় বা আবদ্ধ স্থানে রাখা অমানবিক। অল্প দিনেই রাসায়নিক পদ্ধতিতে মুরগি বড় করা হয় বলে মুরগি দুর্বল হয়। অথচ অর্গানিক পদ্ধতিতে পালন করা মুরগি হয় খুব শক্তিশালী। এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি হয়। ননঅর্গানিক মুরগির রোগ প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন ধরনের এন্টিবায়োটিক এবং খাদ্যে এন্টিমাইক্রোবায়ালস দেয়া হয় বলে ননঅর্গানিক মুরগির মাংস ও ডিম মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মার্কিন যুক্তরাজ্যের হাউজ অব লর্ডস এর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সিলেক্ট কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা পোল্ট্রির মাংস ও পশুর মাংস এবং দুধ শরীরে প্রবেশ করলে মানুষের মধ্যে রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা বিনষ্ট হয়। সে সঙ্গে স্যালমনেলা এবং অন্যান্য বেশ কিছু মাইক্রোবায়োলজিক্যাল রোগ সৃষ্টি হতে পারে মানুষের দেহে যা নিরাময়যোগ্য নয়। তাই এই লর্ডস কমিটি অর্গানিক পদ্ধতিতে পশু পাখি পালন ও এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে।

অর্গানিক পোল্ট্রি ফিডের কাঁচামাল হচ্ছে ভুট্টা, গম, চালের কুড়া, গমের ভূষি, সয়ামিল, সয়াবিন, সূর্যমুখীর তেল, চুনাপাথর, ঝিনুকচূর্ণ, ডালের ভুষি, শুঁটকিমাছের গুঁড়া ইত্যাদি। কিন্তু ননঅর্গানিক পোল্ট্রি খাদ্যে রাসায়নিক ভিটামিন, মিনারেল, প্রিমিক্স, এন্টিবায়োটিক্স, কক্সিডিওষ্ট্যাট, কৃত্রিম এমাইনো এসিড, টক্সিন ও পিলেটবাইন্ডার, এনজাইমস ইত্যাদি দেয়। এসবের উচ্চমূল্যের জন্য ভেজালকারীরা অতি সহজেই এসব উপাদানে ভেজাল দিয়ে খামারীদের ভেজাল দিয়ে থাকে। বিশেষ করে ভিটামিন-প্রিমিক্সের ভেজাল মারাত্মক। পোল্ট্রি শিল্পে মোট খরচের শতকরা ৭০ ভাগ খরচ হয় খাদ্যে। তাই সম্প্রতি কিছু কিছু ছোট ও অপরিচিত পোল্ট্রি ফিড উৎপাদন কোম্পানি ট্যানারীর বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ দিয়ে পোল্ট্রি খাদ্য তৈরি করছে। এই খাদ্য খাওয়ায়ে উৎপাদিত ডিম ও মাংস বিষাক্ত হচ্ছে। এই ডিম ও মাংস খেয়ে মানুষের ক্যান্সার, প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম, কিডনিরোগসহ বিভিন্ন রোগ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্যানারীতে পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক জিংকসহ ২৫০ ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। পরিত্যক্ত চামড়ায় উপস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে শুধু ক্রোমিয়াম জাত ক্রোমিক এসিটেট মানবদেহ ফুসফুস ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ সৃষ্টিকারী কার্সিনোজিক পদার্থ, খাদ্যশৃংখল বিনষ্টকারী পদার্থ ও আলসার সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে। ট্যানারীর বর্জ্যে বিদ্যমান লেড সালফাইড পোল্ট্রি খাদ্যের মাধ্যমে মুরগির দেহ ও ডিমে যাচ্ছে। গর্ভবর্তী মহিলা এর মাংস ও ডিম খেলে প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের আশংকা রয়েছে। অর্গানিক ফার্মে শুধু প্রাকৃতিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি খাদ্য মুরগিকে খাওয়াতে হবে। বড় বড় পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অর্গানিক ফিড তৈরি করে।
রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার

অর্গানিক পদ্ধতিতে পোল্ট্রির রোগ প্রতিরোধ করা সহজ হলেও চিকিৎসা কিন্তু কঠিন। পোল্ট্রির রোগ হলে চিকিৎসায় কাজ হয় না বললেই চলে। এজন্য প্রতিরোধ করাই উত্তম। জৈব নিরাপত্তাই একমাত্র অর্গানিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা। খামারের ভেতর জীবাণু প্রবেশ প্রতিরোধই হচ্ছে জৈব নিরাপত্তা। জীবাণু প্রতিরোধের জন্য করণীয় হচ্ছে

১. মানুষ, যানবাহন, যন্ত্রপাতিসহ সবকিছু জীবাণুমুক্ত করে খামারে প্রবেশ করাতে হবে।
২. পশু, পাখি ও দেশি মুরগি প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না।
৩. অসুস্থ মুরগি পৃথক করা এবং পশু চিকিৎসককে জানানো।
৪. মৃত মুরগি মাটিতে পুঁতে ফেলা।
৫. লিটার শুকনো রাখা ও পরিবর্তন করা।
৬. দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ।
৭. টাটকা খাদ্য খাওয়ানো।
৮. অবিক্রিত ডিম ও মুরগি খামারের বাইরে রাখা।
৯. খাদ্যপাত্র ও পানি পাত্র জীবাণুমুক্ত করা।
১০. খামারের প্রধান গেট বন্ধ রাখা।
১১. অ্যামোনিয়া গ্যাস বের করা ব্যবস্থা রাখা।
১২. মুরগির অস্বাভাবিক আচরণ দেখার সাথে সাথে ডাক্তারকে জানানো।

অর্গানিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা ব্যবস্থা তেমন নেই। হোমিও চিকিৎসা ও ভেষজ চিকিৎসা কিছুটা কার্যকর। গ্রামে এখনও দেখা যায়Ñ মুরগির রক্ত আমাশয় হলে হলুদ মাখা গরম ভাত মুরগি খাওয়ানো হয়। হলুদের মত অনেক ভেষজ উপাদন আছে যেগুলো দিয়ে মানুষের মত হারবাল চিকিৎসা পোল্ট্রি ক্ষেত্রে সম্ভব বলে কেউ কেউ মনে করেন। এন্টিবায়োটিকের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে। যেমনÑ ফুরাজলিডন বিপি ২০% সেবনে মুরগির স্নায়বীক সমস্যা ও অন্ত্রে রক্তক্ষরণ হতে পারে। জেন্টামাইসিন বিপি সালফেট ব্যবহারে মুরগি প্যারালাইসিস, হাইপারটেনশন, নেফ্রোটক্সিসিটি এবং ওটোটক্সিটি হতে পারে। চিকিৎসার ৩ দিনের মধ্যে মুরগির মাংস মানুষের খাওয়া ঠিক নয়। পোল্ট্রির তাপজনিত ধকল প্রতিকারের জন্য ওষুধ ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়। যেমনÑ বাতাস চলাচল, সেডের চালে চট ভিজানো, গাছের ছায়ায় ব্যবস্থা করা, বেশি করে পানি খাওয়ানো, মুরগির ঘনত্ব কমানো ইত্যাদি।

২০০৭-২০০৮ সালে বার্ডফ্লুসহ বিভিন্ন রোগের সংক্রমনে বিভিন্ন ফার্মে কয়েক লাখ মুরগি নিধন করা হয়। এজন্য গত ৪ বছরে প্রায় ৫০ হাজার খামার বন্ধ হয়েছে। অর্গানিক পদ্ধতিতে কম ঘনত্বের ও প্রাকৃতিক উপায়ে মুরগি পালনে জীবাণু সংক্রমণ কম হয়। সংক্রমণ হলেও ক্ষতি কম হয়। সরকারি হিসেবে বর্তমানে ৯৩ হাজার, বেসকারি হিসেবে সোয়া লাখ খামার এবং ১২৩টি হ্যাচারি ও ব্রীডার ফার্ম চালু আছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পে প্রায় ৫০ লাখ লোক কর্মরত আছে। দৈনিক ২ কোটি ৩৫ লাখ ডিম এবং প্রায় ১৬শ’ টন মাংস উৎপাদন হচ্ছে। বর্তমানে এই শিল্পে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতি মাসে প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা খামারীদের লোকসান হচ্ছে।

পোল্ট্রি শিল্পে ঝুঁকি বেড়েছে, উৎপাদন খরচ বেড়েছে, ভেজাল খাদ্যে বাজার সয়লাব হয়েছে, এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার বাড়ায় মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ বিভিন্ন কারণে পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়েছে। অর্গানিক পদ্ধতিতে মুরগি পালন করলে উৎপাদন খরচ কম হয়। জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি কম, ভেজাল খাদ্য খাওয়ানের সুযোগ নেই, এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার কম হবে। তাই পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচাতে হলে অর্গানিক পদ্ধতি এখন সময়ের দাবী।