আইসিটি খাতের রপ্তানিকারকদের নগদ প্রণোদনা দিতে হবে

 [বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে আইটি সেক্টর। এই সেক্টরে যেমন আশা ও সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে নানা সমস্যা। সম্ভাবনাময় এই সেক্টর নিয়ে দৈনিক আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশন-এবিটিভির সাথে আলোচনা করেছেন সফটওয়্যার নির্মাতাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) পরিচালক ও মেট্রোনেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকতা সৈয়দ আলমাস কবীর। আলোচনার অনুলিখন তাঁরই জবানিতে আজকের বাজারের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।]

আজকের বাজার ওয়ান স্টপ মিডিয়া হাউজকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরুতেই আমি এ দেশের আইটি সেক্টর নিয়ে কিছু বলব।
বাংলাদেশের আইটি সেক্টরের এখনকার পরিস্থিতি খুবই আশাব্যঞ্জক। এর প্রধান কারণ সরকার বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা দিয়েছে। তারপর থেকেই কিন্তু আইটি সেক্টরে প্রচুর কাজ হচ্ছে। আমরা আইটি সেক্টর মাত্র টেকঅফ করছি। আমরা জানি, বাংলাদেশে কম্পিউটার এসেছে অনেক আগে। তারপর থেকে অফিসে অফিসে পিসি, ঘরে ঘরে পিসি চলে এসেছে। কয়েক বছর ধরে মোবাইল ফোনের ব্যবহারও বহুগুণ বেড়ে গেছে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করার ফলে আইটি সেক্টরও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। আর ঠিক এখন আমাদের দরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করলে কিন্তু হবে না। স্বল্প পরিসরে পরিকল্পনা নিয়ে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের কথা বললে হবে না। যদি ইন্ডিয়ার সঙ্গে আমাদের তুলনা করি তাহলে দেখতে পাব যে তারা ১৯৬০ আইআইটি শুরু করে। আর এতে করে ৩০ বছর পর থেকে তারা সুফল পাওয়া শুরু করেছে।

দক্ষ জনশক্তি : কম্পিউটার সায়েন্স পড়ার ট্রেন্ড আবার চালু হোক
আমাদের আইটি সেক্টরে উন্নতির প্রধান বাধা দক্ষ জনশক্তির অভাব। আমাদের মেধা ও মেধাবীর অভাব নেই। আমাদের কেবল দক্ষ জনশক্তির অভাব। আমরা যদি বিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন দেখতে চাই, তাহলে দক্ষ জনশক্তি বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্কুল লেভেলে সায়েন্সের পরিসর বাড়াতে হবে। অনেকে ভাবে যে এমবিএ, বিবিএ শেষ করে একটা ভালো চাকরি পাব। সে কারণে সায়েন্স পড়ার ভীতি বাড়ছে, আগ্রহ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। স্কুল লেভেল থেকেই ছেলেমেয়েদের উৎসাহ দিতে হবে।
দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হলো,  ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সে থিউরিটিক্যাল বিষয়গুলো পড়ানো হয়, কিন্তু ট্রেনিংয়ের বিষয়টি  ইউনিভার্সিটিতে করানো হয় না। ফলে ভালো রেজাল্ট করেও একটা ছেলে কিংবা মেয়ে জব ক্যাপাবল হয়ে বের হচ্ছে না। তারা কেবল থিউরিটিক্যাল জ্ঞান নিয়ে বের হয়, কিন্তু স্কিলটা নেই। কীভাবে কাজ করতে হয়, অনেক েেত্র বুঝে উঠতে পারে না। সে জন্য তাকে ট্রেনিং নিতে হয়। যেটা চার বছরের পড়াশোনায় শেখানো হয় না। তাই আমার মনে হয়, চার বছরে থিউরিটিক্যালের পাশাপাশি ট্রেনিংটাও যোগ করে দিতে হবে। তাহলে প্রতিটি ছেলেমেয়ে সরাসরি জব ক্যাপাবল হয়ে বের হতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে আমি একটা উদাহরণ দিতে পারি, আমি নিজেও কয়েক বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিকতা করেছি। একবার এক ছাত্র এসে বলল, স্যার আমি কম্পিউটার সায়েন্স থেকে ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করে চাকরিতে ঢুকলাম ৮ হাজার টাকায়। অথচ বিবিএ, এমবিএ করে চাকুরিতে ঢুকে ১৫ হাজার স্যালারি পায়। তবে এখন এই অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে।

যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, আজ থেকে ১৪ বছর আগেও সবার মধ্যে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ার একটা ঝোঁক ছিল। একটা ট্রেন্ডই চালু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর তাদের মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকে। এর কারণ হিসেবে, পছন্দমত চাকরি না পাওয়া, স্যালারি না পাওয়ার কথা বলতে পারি। তারপর কাজের পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া। সে কারণে এখন বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, বিবিএ, এমবিএ’র দিকে ঝোঁক। আমরা চাই, আগের মত কম্পিউটার সায়েন্স পড়ার ট্রেন্ড চালু হোক। তাহলেই কেবল ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে আমরা অতিদ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারবো।
বর্তমানে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ হচ্ছে। সে কারণে আমাদের দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন। আমার নিজেরই অনেক আইডিয়া আছে, কিন্তু আমি লোকবলের অভাবে কিছুই করতে পারছি না। তবে আরও ভালো কিছু সম্ভব যদি আমরা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে পারি। যে কথাটা আমি বার বার বলে আসছি।

সম্ভাবনার নাম আউটসোর্সিং ও পরিকল্পনা
আউটসোর্সিং আমাদের দেশে অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে। প্রথম দিকে আমরা কেবল ডাটা এন্ট্রি করতাম। কিন্তু এখন সে পরিস্থিতি আর নেই। আমরা অনেকেই জানি না, এখন ডেল ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপনের কাজ আমাদের দেশে করা হচ্ছে। ডিজনির অনেক কাজ বাংলাদেশ থেকে করা হয়। থ্রী ডি এনিমেশন লেভেলের কাজও আমরা করি।
গত ১৫ বছরে ফাইবার অপটিকের কভারেজ প্রায় পুরো দেশে ছড়িয়ে গেছে। তা আরও বাড়বে এবং এটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ।
র্দীঘ মেয়াদী পরিকল্পনার সময় কী আমরা বসে থাকবো? অবশ্যই না। এই ফাঁকে আমাদের নিয়মিত কাজগুলোই করতে থাকবো। আমদের প্যারালালি কাজ করা দরকার। ঠিক এই সময়টাতে কল সেন্টার নিয়ে আমরা কাজ করতে পারি। আমি উদাহরণ হিসেবে বার বার ইন্ডিয়ার কথা বলি। কাছের দেশ। কালচারেরও মিল আছে। তাদের কাজ থেকে ভালো কিছু নিতে তো সমস্যা নেই। তারা কল সেন্টারের বিষয়েও বেশ কিছু লজিস্টিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সেখানে ছেলে-মেয়েরা কলসেন্টারে সারারাত কাজ করে। রাতে মেট্রোরেল বন্ধ হয়ে যায়, তখন তাদের জন্য আলাদা বাসের ব্যবস্থা আছে। কল সেন্টারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য কিছু রেস্তোরাঁ আছে, যেগুলো খোলেই রাত ৮ টার পরে। আমার নিজের অফিসেও সারা দিন-রাত কাজ হয়। যেসব মেয়েরা রাতের শিফটে কাজ করে তারা সকাল পর্যন্ত অপো করে, কারণ এর আগে রাস্তায় বের হওয়াটা ঝুঁকির হয়ে যায়। আমাদের মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও গুরুত্ব সহকারে কাজ করতে হবে।

পলিসি লেভেলে করণীয়
আইটি সেক্টরের উন্নতির জন্য দ জনশক্তি ও লজিস্টিক সমস্যা ছাড়াও পলিসি লেভেলের কিছু সমস্যা রয়েছে। বেসিস থেকে আমাদের টার্গেট দিয়েছে ২০১৮ সালে মধ্যে এক্সপোর্ট করে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করতে হবে। সরকার থেকেও আমাদের টার্গেট দিয়েছে ২০২১ সালের মধ্যে এক্সপোর্ট করে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করতে হবে।
আমরা কথা বলছি বাইরের মার্কেট নিয়ে, অথচ আমাদের এখানে লোকাল মার্কেটেই কিন্তু কয়েক বিলিয়ন ডলারের কাজ আছে। সেগুলো নিয়েও ভাবতে হবে, কাজ করতে হবে; কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের এখানে এমন অনেক বড় বড় কোম্পানি আছে যারা আইসিটিতে প্রচুর ইনভেস্ট করে। তারা যখন সফটওয়্যার কেনে তখন কিন্তু বাইরে থেকে কেনে। আমাদের কাজের কোয়ালিটি আছে, গ্রহণযোগ্যতা আছে। সেেেত্র সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে। সরকার ঘোষণা দিতে পারে, যারা দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করবে তারা ট্যাক্স বেনিফিট পাবে। আমি বলছি না, বিদেশী কোম্পানী আসবে না, অবশ্যই আসবে কিন্তু তাদের শর্ত দিতে হবে ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার হোল্ডার আমাদের থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে সমস্যা হচ্ছে, টেন্ডারে আমাদের দেশীয় কোম্পানী শর্ট লিস্টেও থাকে না।
অথচ যদি কোয়ালিটির কথা বলা হয়, তাহলে আমি বলতে পারি, কোয়ালিটির বিষয়ে আমরা কোনো দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। তাই সরকার যখন তার কাজের জন্য দেশীয় কোম্পানির কাছ থেকে সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করবে তখন দেশীয় অন্য কোম্পানীও কাজ করতে আগ্রহী হবে।

পলিসি লেভেলে উন্নতি ও কাজের জন্য বুলেট পয়েন্ট হিসেবে, এই মুহূর্তেই যে সব পদত্রে নেয়া যেতে পারে তা হচ্ছে —
আমাদের ছেলে-মেয়ে, যারা ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে, তাদের প্রপার ট্রেনিং দিয়ে চাকরি উপযোগী করতে হবে। সেেেত্র কারিুুলাম পদ্ধতি পাল্টাতে হবে। তিন থেকে ৬ মাসের যে সব ট্রেনিং হচ্ছে, সেখানে একটা অডিট করতে হবে, দেখতে হবে, তারা সঠিক ভাবে শিখে বের হচ্ছে কি না।

তারপর, দেশীয় কোম্পানীর সফটওয়্যার ব্যবহার করতে উৎসাহ দেয়ার, ইনসেনটিভ দেয়ার নীতিমালা করতে হবে। সরকার চাইলেই এগুলো করতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি। যেহেতু সরকার বলছে গার্মেন্ট সেক্টরের পরেই আইসিটি সেক্টরই নেক্সট সম্ভাবনাময় সেক্টর। তাই আইসিটি সেক্টরেও সরকার বিভিন্ন প্রনোদনা দেবে বলে আশা করি।

আসছে বাজেটে প্রত্যাশা
সামনে বাজেট আসছে। প্রতিবারই বাজেট নিয়ে আমার প্রত্যাশা থাকে, কিন্তু প্রতিবার প্রত্যাশা মেটে না, এটাই সমস্যা। এক নম্বর কথা হচ্ছে, ইন্টানেটের উপরে ১৫% ভ্যাট আরোপ বেশি হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, ৫ বছরের জন্য হলেও এটা কমাতে হবে। যেমন ধরেন. গার্মেন্ট সেক্টরে বাড়িভাড়া নিতে গেলে ৯% ভ্যাট দিতে হয় না। কেননা আরএমজি সেক্টরকে একটা কর্মসংস্থানের সেক্টর ধরা হয়েছে। একইভাবে আইসিটি সেক্টরকে কর্মসংস্থানে খাত হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। অফিস ভাড়া নেয়ার সময় ৯% ভ্যাট মওকুফ করতে হবে। তারপর অপারেটিং সিস্টেম এবং সিকিউরিটি সিস্টেমগুলো ইমপোর্ট করার সময় ট্যাক্স মওকুফ করতে হবে। ভালো ‘সিকিউরিটি ফায়ার ওয়াল’ থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মত ঘটনা ঘটত না।
সারাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে হবে, সরকার নিজেও এ ব্যাপারে কাজ করছে। অপটিক্যাল ফাইবার, রাউটার, সুইচ এসবের ওপর থেকে ভ্যাট, ট্যাক্স মওকুফ করতে হবে, তা না হলে এই সেক্টরের উন্নতি সম্ভব নয়। যেমন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে দেশের অর্থনীতিও উন্নতি হয়। তাহলে ডাটা আদান-প্রদান বেড়ে যাবে। আইসিটি সেক্টরও উন্নতি করবে। আশা করি, সরকার বিষয়গুলো নিয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করবে।

 

সৈয়দ আলমাস কবীর

প্রধান নির্বাহী কর্মকতা, মেট্রোনেট বাংলাদেশ লিমিটেড

পরিচালক, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস)