আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিমার আওতায় আনা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ সহায়তা দেয়া দরকার

করোনাকালীন এই সময়ে আবাসন খাতের অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। আপনারা জানেন, সারা বিশ্বব্যাপী বৈশ্বিক মহামারী রোগে আক্রান্ত। করোনার সাথে বিশ্বের আমরা কেউই পরিচিত ছিলাম না। করোনা আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিজ্ঞতার বিষয়। এটা আমাদের জীবন যাত্রাকে বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক চাকা বন্ধ করে দিয়েছে। রিয়েল এস্টেট অত্যান্ত প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। এই শিল্পের সাথে দেশে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে প্রায় এক কোটি লোক জড়িত। রিয়েল এস্টেট সেক্টরের সাথে প্রায় দুইশরও বেশি লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি সম্পৃক্ত। মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান,শিক্ষা এবং চিকিৎসার মধ্যে এখাতটি অন্যতম। আমরা এই করোনাকালীন সময়ে একটি বিষয় ভীষণভাবে সকলেই উপলব্ধি করতে পেরেছি, সেটা হলো ‘ঘরে থাকা’। একটি ঘর খুবই জরুরি।

বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নগর কেন্দ্রিক একটি সভ্যতা গড়ে উঠছে। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশ। দেশের চলমান অবস্থায় ঢাকা সিটিতে প্রচুর জনসমাগম। সবাই ঢাকায় থাকতে চায়। চট্রগ্রাম ও খুলনা সিটিতে থাকতে চায়। এই থাকার সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে বাসস্থানের। একজন মধ্যম আয়ের মানুষ তার জীবন যাপন শুরু করে ভাড়া বাসা নিয়ে। পর্যায়ক্রমে সেই মানুষটি ফ্ল্যাট কিনতে চান। এমনিভাবে আমাদের জায়গার সংকুলান যা আছে,তার থেকে আমাদের লোকসংখ্যা অনেক বেশি। আপনি জানেন, আমরা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা ১৯৯২ থেকে হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছি। আজকে যদি আপনি দেখেন,সিটিগুলোতে একটা দৃষ্টি নান্দন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আবাসন ব্যবসায়ীরা রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করেন,তাদের অবদান অনেক। যত দৃষ্টিনন্দন বড় অট্টালিকা দেখবেন, এর পিছনে একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর শ্রম,ঘাম,অর্থ এবং মেধা জড়িত। আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ এই কাজ শুরু করেছি এবং পর্যায়ক্রমে করে যাচ্ছি। আমরা নিজেরা উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছি। কিন্তু সেভাবে আমাদের নীতিমালা তৈরি হয় নাই। আমাদের সেক্টরের প্রয়োজন অনুযায়ী সেভাবধারায় আগাতে পারিনি।

আমাদের রিয়েল এস্টেট এমন সেক্টর, যেখানে বিনিয়োগের এমন যায়গা, একটি ফ্ল্যাট কিনতে হলে কমপক্ষে ত্রিশ লক্ষ থেকে দুই- তিন- পাঁচ কোটি পর্যন্ত ইনভেস্ট করতে হয়। এটা কোনো ছোট পণ্য নয়। আমরা বিরাট একটা অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করছি এবং এর সাথে সম্পৃক্ত প্রচুর জনগন। করোনার কারণে যখন ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না,ঠিক সেসময় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা প্রায় বন্ধ বলা যায়,এক কথায় বলতে গেলে আমরা খুব ভালো নেই। আমাদের টোটাল কর্মযজ্ঞ প্রায় বন্ধ। আমাদের প্রায় লক্ষ হাজার কোটি টাকা চলমান বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। আমরা সিস্টেম লসের মধ্যে আছি।

এবারের ২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের ব্যাপারে দৃষ্টি দেয়া যাক। সম্প্রতি বাজেট ঘোষণা হয়েছে করোনাকালীন মহামারী সময়ে এটি একটি বড় বাজেট। ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট। বাজেটের আয় ধরা হয়েছে ৩ লক্ষ ৭৮হাজার কোটি টাকা, ঘাটতি আছে ১ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। বাজেট প্রণয়নের চেয়ে বাজেট বাস্তবায়ন হওয়া বড় বিষয়।

এবারের বাজেটে আমাদের জন্য অবশ্যই ভালো খবর রয়েছে। অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাতে বিনিয়োগ করা যাবে। বিনিয়োগ করলে, কিংবা ১০ শতাংশ টাকা দিয়ে অবৈধ অথবা অপ্রদর্শিত অর্থ, যা ট্যাক্সের ফাইলে দেখানো হয়নি, এমন টাকা ১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে বৈধ বা সাদা করা যাবে। এতে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। অথচ এই অপ্রদর্শিত টাকা রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ করার সুফল কিন্তু এখনো আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

ফ্ল্যাট এবং প্লটের রেজিস্ট্রেশন ব্যাপারে একটু বলি। আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি, রেজিস্ট্রেশনের কিছু নীতি নির্ধারণে ভ্রান্ত নীতিমালা রয়েছে। এই নীতিমালার কারণে আমরা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ ক্রেতারাও। বছরের পর বছর, হাজার হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি করার পরেও আনরেজিস্টার্ড থেকে যাচ্ছে। এতে সরকার তার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই রেজিস্ট্রেশন খরচ কিন্তু কমানো হচ্ছে না। দীর্ঘদিন যাবৎ আমরা দাবি করে আসছিলাম রেজিস্ট্রেশন খরচ কমানো দরকার। আপনি যদি একটা গড় হিসাব করেন, পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে একটি ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রায় ১৭ শতাংশ খরচ হচ্ছে। অথচ কমানো হচ্ছে মাত্র ২ শতাংশ। এই ২ শতাংশ আবাসন খাতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলছে না। এই নীতিমালার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ দেই। কিন্তু আমাদের কাঙ্খিত চাহিদা পূরন হয়নি। রেজিস্ট্রেশন খরচ ৭ শতাংশ করা হলে ভালো হতো।

আমাদের আরেকটা দাবি ছিল, সেকেন্ডারি মাধ্যম। যেটা পৃথিবীর সব জায়গায় আছে, শুধু আমাদের এখানেই নেই। আজকে একটা ফ্ল্যাট কিনলেন, কাল সেটা আবার কারোর কাছে বিক্রি করলেন। তাহলে আপনি প্রথম ক্রেতা। আর যার কাছে বিক্রি করলেন, তিনি দ্বিতীয় ক্রেতা। একইভাবে আপনি একটা ফ্ল্যাট কিনে আপনার ভাইকে ট্রান্সফার করবেন, তাকেও ১৬ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হবে। পৃথিবীর কোথাও এই ধরণের নিতিমালা নেই। আপনি যখন পুরাতন গাড়ি ক্রয় করেন, সেক্ষেত্রে কিন্তু পার্থক্য থাকে না। আপনি মিনিমাম টাকা দিয়ে সেকেন্ডারি গাড়ি কিনতে পারছেন। কিন্তু সেকেন্ডারি ফ্ল্যাট কিনার ক্ষেত্রে সেই নীতিমালাটা নাই। রাষ্ট্রকে মানুষের আবাসস্থলের জন্য সহযোগিতা করতে হবে। নীতিমালা বাস্তবায়ন যদি করতে হয় তাহলে, একটা ক্যাটাগরী থাকা দরকার।

এই সেক্টরে আমাদেরকে নিয়ে বাজেটের আগে ব্যাপকভাবে আলোচনা হওয়া দরকার। বৈশ্বিক মহামারির কারণে এবার আলোচনা হয়নি। এফবিসিসিআই ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে এনবিআর আমাদের সাথে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা করে এবং প্রায় তিন মাস আমাদের আলোচনা চলে। আলোচনায় আমাদের পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া, যৌক্তিকতা তুলে ধরি এবং সেভাবে বাজেট প্রণয়ন হয়। আমরা কখনো সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হই, আবার কখনো হই না।

আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলছি, আমাদের রেজিস্ট্রেশন ফি যদি ৭ শতাংশ হয়, তাহলে স্বচ্ছতার সাথে অনেক রেজিস্ট্রেশন হতো এবং সরকার সঠিক রেজিস্ট্রেশন ফি পেতো। পক্ষান্তরে আমাদের উন্নত রাষ্ট্রের সাথে তাল মিলিয়ে যারা প্রথম জেনারেশন, যাদের কোনো ফ্ল্যাট বা ভূমি নেই, আবাসনের জন্য বিশেষ একটা সুযোগ দিয়ে, মিনিমাম ট্যাক্স যদি করা হয়, তাহলে অনেক ভালো হবে। তেমনিভাবে সেকেন্ডারি ফ্ল্যাটের জন্য আলাদা একটা নীতিমালা থাকা দরকার। আমরা দাবি করে আসছি দীর্ঘদিন ধরে,আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিভিন্ন টকশোতে বলেছি। সরকারকে বিভিন্নভাবে বলার চেষ্টা করি। নীতি নির্ধারণী মহল,এখনো এ বিষয়ে কর্ণপাত করেননি। নীতি নির্ধারণী মহল সরকারেরে বিচ্ছিন্ন কিছু না, আমাদেরকে নিয়েই। যার যে সেক্টরের ধারণা আছে, তাদেরকে নিয়েই যদি এই সমস্ত নিতিমালা প্রনয়নের জন্য কমিটিতে রাখা হয়,তাহলে তারা মতামত দিতে পারবে।

আমরা জানিনা কবে করোনা মহামারী থেকে রক্ষা পাবো। কিন্তু আমাদের জীবন এবং জীবিকা দুটোই সমান ভাবে চলবে। আমরা কতদিন আর ঘরে বসে থাকবো? এর প্রেক্ষিতে আমাদের আবাসন খাতের ব্যবসা সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য সরকারের কাছে কিছু দাবি রাখতে চাই। আমাদের দেশে মহামারী চলছে। আমরা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যেই সীমিত পরিসরে আমাদের কর্মযজ্ঞ শুরু করেছি। মানুষ এখন অনাস্থায় ভুগছে এটাই সমস্যা। অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড কমে গেছে এবং তারা কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে দিয়েছে। রিয়েল এস্টেটের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে কমপক্ষে তিন কোটি টাকা হতে একশত কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়। আমাদের রিয়েল এস্টেট সেক্টরে ব্যাংকগুলোর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আমরা লক্ষ্য করছি। গার্মেন্টস এবং অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে সরকার থেকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা আবাসন খাতকে শিল্প হিসেবে বাস্তবায়ন করার অনুরোধ জানাচ্ছি। রাষ্ট্রের অন্যান্য কর্মকান্ডের সাথে যদি আবাসন খাত গতিময় হয় তাহলে সরকার ট্যাক্স পাবে। অনেক কর্মসংস্থান হবে। এই ক্ষেত্রে আমি বলব, রিহ্যাবের আওতাভুক্ত লিষ্টেড রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সমস্ত প্রকল্পের জন্য,বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা দরকার, যাতে আমরা ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে স্বল্পসুদে ঋণ পেতে পারি।

আবাসন খাতে বিনিয়োগ নিরাপদ। আমাদের সাথে ব্যাংক পার্টনারশিপ হতে পারে। ফ্ল্যাট বিক্রির সাথে সাথে ব্যাংক টাকা পেয়ে যাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের রিয়েলষ্টেট সেক্টরে প্রত্যেকটা প্রকল্প ভিত্তিক আমরা ঋণ পাই না। সরকারকে এ জায়গায় এগিয়ে আসতে হবে।

আমাদের এখানে যতগুলো পলিটেকনিক্যাল কলেজ আছে ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আছে,ছাত্ররা বিবিএ,এমবিএ পাশ করে আমাদের রিয়েল এস্টেট সেক্টরে কাজ করতে আসে। একজন পলিটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার,বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার পাশ করে বের হয়ে রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে চাকরি করে। প্রথম কর্মক্ষেত্রটা রিয়েল এস্টেট সেক্টরে শুরু হয়। আমাদের রিয়েল এস্টেট সেক্টর তাদের কর্মের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে। তাই আমাদের রিয়েল এস্টেট সেক্টর যদি সচল থাকে, জাতি এবং পুরো অর্থনীতি ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে গতি সঞ্চার হবে।

আমরা প্রণোদনা চাই না। তবে আমরা চাই, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিশেষ নির্দেশনা আসুক,যাতে প্রত্যেকটা ব্যাংক রিয়েল এস্টেটের সবগুলো প্রকল্পের জন্য সহজ শর্তে বিনিয়োগ করে।

সেলিম রাজা পিন্টু
ব্যবস্থাপনা পরিচালক,রাজা হোল্ডিংস লিমিটেড ও পরিচালক,রিহ্যাব