আমদানি নয়, বিস্কুট রপ্তানিকেই গুরুত্ব দিতে হবে

অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। নামটি শুনলেই বিস্কুটের কথা মনে হয়ে যায়। আগে ছিল অলিম্পিক মানেই ব্যাটারি আর এখন তার জায়গা নিয়েছে বিস্কুট। দেশে বিস্কুটের বাজারের প্রায় ৬০ ভাগ অলিম্পিকের দখলে। আর নিজেদের আয়ের ৯০ শতাংশ আসছে বিস্কুট থেকে। তবে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তারা সামান্য পরিমাণে ব্যাটারির উৎপাদন চালু রেখেছে। অলিম্পিকের বিস্কুট দেশের বাইরেও যাচ্ছে। অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিংয়ের জেনারেল ম্যানেজার জনাব কাজী তৌহিদুজ্জামান। দেশের বিস্কুট বাজার, এই বাজারের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ, এই খাতে কর্মসংস্থান, সরকারের করণীয়সহ নানা দিক নিয়ে কথা বলেন আজকের বাজার-এর সঙ্গে। তাঁর কথোপকথনের অনুলিখন ছাপা হলো।

উৎপাদনের কয়েক দিনের মধ্যে দেশের সব জায়গায় অলিম্পিক বিস্কুট পৌঁছে যায়

আমদানি নয়, বিস্কুট রপ্তানিকেই গুরুত্ব দিতে হবে

অলিম্পিকের প্রধান প্রডাক্ট ছিল ব্যাটারি। ব্যাটারির পর শুরু হলো বলপেন, বলপেনের পর থেকে বিস্কুট। এখন ডাইভারসিফিকেশন হয়ে আমাদের প্রধান পণ্য বিস্কুট। ঐতিহ্য হিসেবে ব্যাটারিটা আমরা রেখেছি। তবে আপনি শুনে অবাক হবেন, এখন অলিম্পিকের ৯০ ভাগ ব্যবসা হচ্ছে বিস্কুটে। দেশের বিস্কুটের বাজারে বড় অংশ অলিম্পিকের। বাজারে অলিম্পিকের নানা ধরনের বিস্কুট রয়েছে। যেমন অলিম্পিক, এনার্জি প্লাস, নাটিসহ আরও অনেক রকমের। আছে মোগল কুকিস নামের বিস্কুট। নতুন এসেছে ব্ল্যাক নামের বিস্কুট, বেশ ভালো এটি।

আমাদের অনেক রকমের ক্রিম বিস্কুটও বাজারে আছে। বাচ্চাদের জন্য টিফিন, টুইংকেল টুইংকেল, টিনটিন আছে। সব লেভেলে আমরা বিস্কুট দিই। একদম দুই টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকা পর্যন্ত সব পর্যায়ের ভোক্তার জন্য আমাদের প্রডাক্ট। আমাদের বিশেষত্ব কী? আমি বলব, আমাদের বিশেষত্বই হচ্ছে কোয়ালিটি। অলিম্পিকের মতো প্রডাক্টের কনসিসটেন্সি বাংলাদেশে আর কেউ মেইনটেন করতে পারে না। আমাদের শক্তি হলো, উইদিন সেভেন ডেইজ, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে আমরা প্রডাক্ট পৌঁছে দিতে পারি। নতুন প্রডাক্ট বের হওয়ার পরপরই আমরা এমনটা পারি। আমাদের সরবরাহব্যবস্থা বেশ স্ট্রং, ডেডিকেটেড। আমাদের স্কিল ওয়ার্ক ফোর্স খুব ডেডিকেটেড।

বেসিক্যালি আমি ২৬ বছর ধরে সেলসে কাজ করছি। এখন সেলস আর মার্কেটিং দুটোতেই কাজ করছি। সেলস আর মার্কেটিং খুব মজার জায়গা। প্রতিনিয়ত তৃপ্তির জায়গা, যা অন্য কোনো প্রফেশনে পাওয়া যায় না। যাদের নিয়ে আমরা কাজ করি, সবাই কিন্তু অসম্ভব পরিশ্রম করে। এটা এত মজার কাজ যে তাদের কাছে কষ্টটা কষ্ট মনে হয় না। কিন্ত এরা সবাই পরিশ্রম করতে পারে। অলিম্পিকের ওয়ার্ক ফোর্স খুব ডেডিকেটেড, দ্যাটস হোয়াই দে আর ওয়ার্কিং ভেরি হার্ড। তারা কঠোর পরিশ্রম করে, নতুন কোনো প্রডাক্ট আসার সাথে সাথে প্রতিটা দোকানে পৌঁছানো সম্ভব হয়। অলিম্পিকের সেই স্ট্রেন্থ আছে।

বাজারে অলিম্পিক বিস্কুট
অলিম্পিকের ৯০ ভাগ ব্যবসা বিস্কুটের। এটা দেশের বিস্কুট বাজারের অলমোস্ট ৬০ ভাগ। আর অন্যরা সব মিলিয়ে ৪০ ভাগ। আসলে অলিম্পিকের খুব কাছাকাছি আর কেউ-ই নেই, যদিও দেশের বাজারে ৩০-৩৫টা কোম্পানি অপারেট করছে। বিদেশি বিস্কুটও আসছে এখন। আমাদের সঙ্গে প্রাণ আছে, হক আছে, ড্যানিশ আছে এরা সবাই খুব দূরে নয়, কাছাকাছি অবস্থানে আছে। তবে তা অলিম্পিকের তুলনায় কিছুই নয়। সে ক্ষেত্রে নতুন নতুন কোম্পানি হচ্ছে, বিদেশিরাও আসছে। বিগ জায়ান্টরা আসতে চাইছে। সবাই বিস্কুটের বাজারটা ধরতে চাইছে, যেহেতু বিস্কুটের চাহিদা দিনে দিনেই বাড়ছে। কনজ্যুমাররা পছন্দ করার সুযোগ পাচ্ছে। বাজারে যত বেশি কোম্পানি আসবে, গ্রাহকের পছন্দ করার অপশন বাড়বে। অলিম্পিকের জন্যও তা ভালো। কারণ কোম্পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে, প্রডাক্টের কোয়ালিটিও বাড়বে। এতে গ্রাহকেরা তুলনা করে কিনতে পারবে, প্রডাক্টও হাতের কাছে পাবে। এই জায়গাটিতেই অলিম্পিকের বিস্কুট শক্তিশালী অবস্থানে আছে। অন্যদের তুলনায় এগিয়ে আছে। অন্যরা এই জায়গাটিতে এখনো আসতে পারছে না।

কর্মসংস্থান ও বিস্কুটের বাজার
সব মিলিয়ে কী পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে এই বিস্কুট সেক্টরে? পরিষ্কার হিসাব আসলে বলা যাবে না। তবে এক অলিম্পিকেই ডিরেক্ট এমপ্লয়ি আছে পাঁচ হাজার। এর সঙ্গে ডিস্ট্রিবিউটররা আছেন, তাঁদের নিজেদের চাকুরেরা আছেন, খুচরা দোকানদাররা আছেন। এভাবে প্রতিটি কোম্পানির হিসাব ধরলে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে এই বিস্কুট সেক্টরে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতেও তা বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। অনেক মানুষ এমনকি দুপুরের খাবার বিস্কুট দিয়েই সারছে। সেই সুযোগও আছে। বিকল্প অনেক ধরনের প্রডাক্ট আছে, যা দিয়ে মানুষ লাঞ্চ সেরে ফেলতে পারে। মানুষ যার যা অ্যাবিলিটি আছে, সে অনুযায়ী বিস্কুট কিনতে পারে। পাঁচ টাকা দিয়েও কিনতে পারে, দশ টাকা দিয়েও কিনতে পারে, ২০ টাকা দিয়েও কিনে ফেলতে পারে, যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী।

বলতে হয়, বিস্কুটের প্রধান প্রধান উপকরণ তিনটি। ময়দা-আটা, চিনি আর তেল। দেখুন, এই তিনটি উপাদানই কিন্তু আমাদের কৃষি সেক্টর থেকে আসছে। বিস্কুট সেক্টরটা এগ্রো বেইজড প্রডাক্ট। অর্থাৎ বিস্কুটের প্রাথমিক পণ্য পর্যন্তও দেশীয় উৎস থেকে আসছে। নাটি বিস্কুটে আমরা বাদাম দিই, এটিও কৃষি পণ্য; পিনাটও তাই। আর অন্য কিছুর মধ্যে শুধু ফ্লেভারটা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তবে এর পরিমাণ কম, টাকার অঙ্কেও তা খুব বেশি কিছু নয়। যদি অন্যভাবে ধরি, দেখেন ময়দার মিল, তেলের মিল, সরবরাহব্যবস্থা কিংবা ট্রান্সপোর্টেশন এসব মিলিয়ে আরও লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানও কিন্তু এই বিস্কুট সেক্টরে হচ্ছে। বিস্কুট পরিবহনে যেহেতু জায়গা বেশি লাগে, তাই পরিবহন সেক্টরের অনেক মানুষের কাজ করার সুযোগ হচ্ছে এখানে।

চ্যালেঞ্জগুলো কী
সত্যি হচ্ছে, চ্যালেঞ্জ আসলে খুব বেশি কিছু দেখি না। মাল্টিন্যাশনালরা আসছে, এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে। মার্কেট ওয়াইড হবে। যত বেশি প্রতিযোগিতা হবে, তত বেশি প্রডাক্ট কোয়ালিটি বাড়বে; গ্রাহক সন্তুষ্টির বিষয়টা সামনে আরও বেশি করে আসবে। গ্রাহকেরা লাভবান হবেন। নতুন টেকনোলজিও আসবে বহুজাতিক কোম্পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে; এতে সুবিধা হবে বাংলাদেশের মানুষের। আমরাও টেকনোলজি অ্যাডাপ্ট করতে পারব।

এই বাজারের তেমন কোনো সমস্যা দেখছি না। বিদেশি বিস্কুট কোম্পানিগুলো খানিকটা সমস্যা করতে পারে, তবে সেটিকেও বড় করে দেখছি না। বরং এতে আমাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা বাড়তে পারে। অবশ্যই আমাদের ভালো হবে এতে।

বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে
মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন ও দুবাইয়ে যাচ্ছে আমাদের বিস্কুট। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায়ও যাচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরাই এর প্রধান ক্রেতা। আমরা নিজেরাই সরাসরি রপ্তানি করছি এগুলো। আগামী এপ্রিলে দুবাইয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিস্কুট ও ফুড ফেয়ারে আমরা অংশ নেব। দেশের আরও কিছু কোম্পানিও এতে যাবে।

দেশি বিস্কুট বিদেশি বিস্কুট
দেশি ও বিদেশি বিস্কুটের তুলনা করলে আমাদের ভোক্তাদের লাভ-লোকসান আছে। বিদেশি যে প্রোডাক্ট ১০০ টাকা দিয়ে কেনে, বাংলাদেশি প্রোডাক্ট তা ১০ টাকা দিয়ে কিনতে পারবে ভোক্তারা। কেন বেশি টাকা দিয়ে মানুষ তা কিনবে? মানুষের কম্পেয়ার করার সুযোগ আছে, কোয়ালিটি যাচাই করার অবস্থা আছে, বোঝার আছে। বিদেশি প্রোডাক্ট কনজ্যুমারের হাতে পৌঁছাতে কমপক্ষে তিন মাস লাগে, বাংলাদেশি প্রোডাক্ট সে ক্ষেত্রে আজকে তৈরি করে কালকের মধ্যেই তাদের হাতে দেওয়া যায়। ইমপোর্ট প্রোডাক্টে ট্যাক্স আছে, কম পরিমাণ আনতে হয়। ফলে প্রফিট মার্জিন বেশি রাখতে হয়। সে জন্য একটা প্রোডাক্ট কনজ্যুমারের হাতে পৌঁছাতে প্রাইস বেশি পড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে দেশি প্রোডাক্ট অনেক সাশ্রয়ী।

দেশে বিদেশি বিস্কুটের ওপর আসলে উচ্চ হারে ট্যাক্স আছেই। আর এসব বিস্কুট আসা বন্ধ হয়ে যাক চাইব কি? দেশে বাইরের বিস্কুট আসার সুযোগই তো পাচ্ছে না। প্রতিযোগিতাতেই তো পারছে না। বরং দু-একটা এলে মানুষ কম্পেয়ার করার সুযোগ পাবে। তা আমাদের জন্য ভালোই হবে।

রপ্তানিতেও সুযোগ-সুবিধা আছে। সরকার আমাদের কিছু সুবিধা দিচ্ছে। এই সেক্টর কেবল শুরু হচ্ছে, নতুন। যেহেতু এখনো আমরা ছোট আকারে করছি; আস্তে আস্তে বড় হলে আমরা সরকারের সঙ্গে বসব, কথা বলব। আরও কী কী করা যায় বিস্কুটশিল্পের উন্নয়নে, আমরা সে বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ করব।

অলিম্পিক কনফেকশনারি
কনফেকশনারি আমরা নতুন শুরু করেছি। খুব বেশি প্রডাক্ট নেই। নতুন এসেছে পালস ক্যান্ডি। বেশ চলছে এটি। এটি একটি অ্যাক্সিলেন্ট কনসেপ্ট ও প্রডাক্ট। আম খেলে আমের ফ্লেভার যেমন পাওয়া যায়, ক্যান্ডিটাতেও এমন নানা ফ্লেভার পাওয়া যাবে। এটা আমাদের দেশেই হচ্ছে, আমরাই প্রথম করেছি। এখন অবশ্য আরও কেউ কেউ করছে। ক্যান্ডিতে আমরা নই। প্রথমে বলতে হবে প্রাণকে। তবে আমরা কনফেকশনারি করতে চাই, কারণ বিক্রিটা আমাদের কাছে প্রধান।

ব্যাটারির বাজার
ব্যাটারি আমরা উৎপাদন করতাম ভালোভাবেই। তবে এখন আমরা ব্যাটারি তেমন উৎপাদন করছি না। ব্যাটারির বাজার কমে আসছে। বাংলাদেশে ব্যাটারি উৎপাদন করে সানলাইট আর অলিম্পিক। তিন রকম ড্রাইসেল ব্যাটারি বাজারে আছে বড় ব্যাটারি, পেনসিল ব্যাটারি আর রিমোট ব্যাটারি। বড় ব্যাটারির বাজার ও ব্যবহার একেবারেই কমে গেছে। নানা ধরনের চার্জার-টার্জার এসে এর দখল নিয়ে গেছে। মানুষের লাইফস্টাইলে বদল আসায় শুধু রিমোট ব্যাটারির ব্যবহার বাড়ছে কিংবা বলব এখনো টিকে আছে। অলিম্পিকে আমরা রিমোট ব্যাটারি উৎপাদন করছি। ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য আমরা ব্যাটারি উৎপাদন একেবারে বন্ধ করে দিইনি। যেহেতু ফুডে আমরা এগিয়ে আছি, আমাদের ৯০ ভাগ রাজস্ব আসছে ফুড থেকে, তাই আমরা ফুড-কনফেকশনারিকেই প্রিভিলেজ দিচ্ছি। আমাদের শক্তিটাও এখানে।

বলপেন আমরা করেছি, এখন করছি না কারণ, বলপেন প্রযুক্তিতে অনেক বদল এসেছে। আমরা এখন যদি বলপেনে যাই, তবে হিউজ সেটআপ লাগবে। ইনভেস্টমেন্টের ব্যাপার আছে। পুরোনো সেটআপ বদল এখন আর আমাদের জন্য সুইটেবল না। আর বলপেন মার্কেটিং ভিন্ন ধরনের, লোকবলও আলাদা। ফলে এটি এখন আর আমাদের প্রধান ব্যবসা ফুড মার্কেটিংয়ের সঙ্গে ম্যাচ করে না। আমরা ফুডেই বেশি করে নজর দিচ্ছি। পুঁজিবাজারেও আমাদের অলিম্পিক ফুডের অবস্থা ভালো।