আর্ন্তজাতিক বাজারে ইমেজ রক্ষায় শ্রমিক অসন্তোষ কমাতে হবে

বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত গার্মেন্টস শিল্প। দেশের উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে গার্মেন্টস শিল্প। মো. সেলিম খান একজন অভিজ্ঞ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী।  ইয়র্ক ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি গার্মেন্টেসের নানা বিষয়ে কথা বলেছেন আজকের বাজার ও এবিটিভির রিপোর্টার ইফফাত শরীফের সঙ্গে। আলোচনার মূল অংশ তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

গার্মেন্টস্ শিল্পের সার্বিক অবস্থা
বর্তমানে গার্মেন্টস্ খাতের অবস্থা একটু ধীর গতি সম্পন্ন। যে গতিতে আগানোর কথা ছিল সে গতিতে আগানো সম্ভব হচ্ছে না । এর জন্য অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ি করা হচ্ছে। তবে আশা করা যাচ্ছে কয়েক মাসের মধ্যে এটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। এছাড়া এটাও হতে পারে বিশ্ব বাজারে চাহিদাও কমতে পারে। আবার ওয়েদার চেঞ্জ এর কারনেও এটা হয়ে থাকে। ওয়েদারটা এখানে বড় একটি ফ্যক্ট । আগে উইন্টার ছিল তিন মাস এখন তা বেড়ে গিয়েছে, সামার এর অবস্থাও চেঞ্জ হয়েছে , এই ওয়েদার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। এর জন্য বায়াররা এখন অর্ডার দেয়ার সময় অনেক চিন্তা ভাবনা করে। তদের আবওহাওয়ার সাথে যদি না মিলে তাহলে তারা প্রডাক্টগুলো বিক্রি করতে পারবে না। এর জন্য গার্মেন্টস্ শিল্প একটু ধীর গতিতে আছে।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার প্রভাব
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আর্ন্তজাতিক বাজারে বাংলাদেশে গার্মেন্টস্ শিল্পের যে নেগেটিভ ইম্প্রেসনস্ হয়েছিল তা এখন অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এই ঘটনা হবার কারনে বাংলাদেশের গার্মেন্টস্ শিল্প অনেক চেঞ্জ হয়েছে। এটি ছিল গার্মেন্টস্ সেক্টরের একটি টার্নিং পয়েন্ট। এখন বাংলাদেশে গত তিন চার বছর ধরে কোন ধরনের দূর্ঘটনা হচ্ছে না এবং গার্মেন্টস্ ম্যানুফেকচারারর্স থেকে শুরু করে গার্মেন্টস্ মালিকরা অনেক সতর্কতা পালন করছেন। এই ঘটনার কারনে আমাদের যতটুকু আঘাত পাবার কথা তার পরও আমরা এখন যথেষ্ঠ ভাল অবস্থানে আছি। আমাদের বায়ারদের কনফিডেন্টস্ এখন অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে কোম্পানিগুলোতে একর্ড এলাইন্স এবং আই.আর.ও এর আওতাভূক্ত হওয়ায় প্রতিটা ফ্যাক্টরি সেফ এন্ড সাউন্ড। সুতরাং বায়ারও এখন অনেক কনফিডেন্ট এর জন্য তারা এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন ওঠায় না।

প্রসঙ্গ: ভিশন ২০২১
সরকার ২০২১ সালের মধ্যে গার্মেন্টস্ খাত থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির যে টার্গেট নিয়েছেন তা বাস্তবান করা সম্ভব। এখনই ২০১৭ সালে ৩৫ বিলিয়ন ডলার আমরা রপ্তানি করতে পারছি। উৎপাদনের হার যদি বৃদ্ধি পেতে থাকে তাহলে ইনশাল্লাহ্ আমরা ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের টার্গেট পূরণ করতে পারব। কিন্তু দেখা যাচ্ছে  আমাদের কমপিটিটর দিনে দিনে বেড়েই চলছে। যার ফলে কি না আমাদের ম্যানুফেকচারাররা খুবই কম মূল্যে কাজ করছে।  মূল্য না কমলে আমাদের টার্গেট পূরণ করতে ২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। আগের প্রাইজ থাকলে আমরা এখনই ৪০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে পারতাম। এক্ষেএে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বি হচ্ছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চায়না এবং নতুন করে ইন্ডিয়া কাজ শুরু করেছে। ইন্ডিয়ার আগে কোন গার্মেন্টস্ ছিল না, তারা এখন নতুন করে কাজ শুরু করছে।

গার্মেন্টস্ সেক্টরের চ্যালেঞ্জ
গার্মেন্টস্ সেক্টরে বিদ্যুৎ এবং গ্যাস নিয়ে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। গ্যাস লাইন এক প্রকারে বন্ধই আছে, গ্যাস এবং বিদ্যুৎ যদি নিরবিচ্ছিন্নভাবে থাকে তবে বাংলাদেশকে কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না। গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সবসময় থাকলে গার্মেন্টস্ এর প্রোডাকশন  এর পরিমাণ অনেকাংশে বেড়ে যাবে। সরকারের প্রতি গার্মেন্টস্ মালিকদের চাওয়া এটাই। উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নতুন গার্মেন্টস্ এর গ্যাস খুবই জরুরি।

চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয়
গার্মেন্টস্ খাতে উন্নতি করতে হলে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা স্বচ্ছ থাকতে হবে। এছাড়া নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ লাগবে। সরকারি যে সকল জায়গাগুলোতে আমাদের লাইসেন্স এবং সেবা খাত রয়েছে তা গতিশীল করতে হবে। বিশেষ করে পোর্টের কাজগুলো দ্রুত করতে হবে। এই খাতগুলোর দিকে সরকার সুদৃষ্টি দিলে গার্মেন্টস্ খাত উন্নত হবেই। এছাড়া দেখতে হবে, কোনোভাবে যেন শ্রমিক অসন্তোষ না হয়। শ্রমিক অসন্তোষ আর্ন্তজাতিক বাজারে ইমেজ নষ্ট করে।

গার্মেন্টস খাতে ইয়র্ক গ্রুপ
আমারা এই ইয়র্ক গ্রুপ চালু করি ১৯৯৬ সলে ২৭টি মেশিনের মাধ্যমে মিরপুর মাজার রোডে এবং এখান থেকেই শুরু। আর পুরোনো ফ্যাক্টরি আমরা এখনো ধরে রেখেছি জানি না আর কত দিন ধরে রাখা সম্ভব হবে।  আমরা চাঁদপুরে একটি ফ্যাক্টরি করেছি এর নাম ইয়র্ক ফ্যাশন্স লিমিটেড। এটি সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্স মেনে চলা  গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা ওয়ার্কার এর বেনিফিট লক্ষ্য করি। আমরা ওয়ার্কারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ করে তুলি , আমাদের ওয়ার্কারদের সাথে সম্পর্কটা খুবই শক্তিশালি, আমাদের ওয়ার্কাররা আমাদের ছেড়ে যেতে চায় না। এমনও অনেক ওয়ার্কার আছে যারা কিনা ১৯৯৬ সন থেকে আমাদের সাথে কাজ করছে। আমরা এখানে তাদের লাইফস্টাইল এবং তাদেরকে নিয়ে নানা ধরনের মোটিভেসন প্রোগ্রাম করে থাকি। শুধু যে বেতন দেবার জন্য তা নয়, তাদের জীবনের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাই। তারাও দেশের সম্পদ; এটা বোঝাই। তাদের নিয়ে আমরা নানা ধরনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান করে থাকি, যেমন পহেলা মে, পহেলা বৈশাখ, ফাল্গুন, ২১ শে ফেব্রুয়ারি আরো নানা ধরনের অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানে তারা নাচ, গান নানা রকমের আনন্দ করে। আমরা এখানে তাদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। ফ্যাক্টরিতে সবসময় ডাক্তার থাকে, কোন প্রয়োজনে চেকআপ এর ব্যবস্থা থাকে। আরো অন্যান্য ফেসিলিটিসও দেয়। কারণ, তারাই আমার মূল চালিকাশক্তি, তাদের ছাড়া আমি এত উন্নত হতে পারতাম না। প্রতিটা শ্রমিকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক  পরিবারের চেয়েও বেশি। প্রত্যেকটি শ্রমিকের কাছে আমার ফোন না¤া^র আছে , তাদের কোন সমস্যা হলে তারা আমাকে সরাসরি ফোন দেয়। তাদের পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে আমি তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেই, তাদের বোনদের বিবাহের জন্য আমি সাহায্য করি। এসব টুকি টাকি সাহায্য আমি সবসময় আমার শ্রমিকদের করে থাকি।

চাঁদপুরে কারখানা গড়ে তোলার যৌক্তিকতা
আমি ফ্যাক্টরিটা যখন ঢাকার থেকে নিয়েগিয়ে চাঁদপুরে করি তখন নানা ধরনের সমস্যা পোহাতে হয়েছে। কারণ, ঐ জায়গাতে কোনো ওয়ার্কার পাওয়া যায় না। তো আমাকে নতুন ওয়ার্কার যোগার করে তাদের  প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ শেখাতে হয়েছে এবং তারাও এটাকে অনেক পজেটিভলি নিয়েছে। এতে ঢাকা থেকে গ্যাঞ্জাম সরে যাচ্ছে, ঢাকায় অনেক যানযট, লিভিং কস্ট অনেক। কিন্তু চাঁদপুরে শ্রমিকদের বেতন ঢাকার অনেক কমপ্লায়েন্স ফেক্টরির তুলনায় অনেক ভাল। ঢাকায় যেমন কোম্পানিগুলো আশে পাশে যেমন লোক জন থাকে কিন্তু আমার ফ্যাক্টরিতে লোক জন অনেক দূরে থাকে। আমি তাদের যাতায়াত এর জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করেছি, তাদেরকে একটু আগেই ছুটি দেওয়া হয়। অন্যান্য ফ্যাক্টরির তুলনায় আমাদের ওয়ার্কাররা সেজে-গুজে পরিপাটি হয়ে আসে এবং এই ফ্যাক্টরির জন্য ওই এলাকাই চেঞ্জ হয়ে গেছে।

তরুণদের প্রতি পরামর্শ
বর্তমান যুগের তরুণদের প্রতি একটাই কথা বলার আছে যে, কাজের উপর কিছু, নেই, আমাদের দেশে এমন অনেক লোক আছে যারা চিন্তা করে কাজ না করে কিভাবে বড় হওয়া যায়। কিন্তু চিরন্তন সত্য হচ্ছে, কাজ ছাড়া কেউ কখনো উন্নতি করতে পারেনি এবং কখনো পারবেও না। কাজকে কখনো ছোট করে দেখতে নেই। কাজকে মনে করতে হবে এইটা আমার দায়িত্ব। তাহলে সে কোথাও আটকাবে না। আর যে কাজকে ভয় পায় সে উপরেও যেতে পারবেনা নিচেও যেতে পারবেনা, তার জীবনে সে কিছুই করতে পারবে না। আর সব থেকে বড় ব্যাপার হলো যুবকদের খুব ধৈর্যশীল হতে হবে, অধৈর্য হলে জীবনে সাফল্য পাবে না। কাজ কে ভালবাসতে হবে না হলে, সে কিছুই করতে পারবে না। অনেকে আছে শুধু হেল্পারই হয়ে থাকে, আবার অনেকেই আছে পরিশ্রমের মাধ্যমে সুপারভাইজারও হয়ে যায়। আবার অনেক লোক আছে যে দীর্ঘ বছর ধরে সুপারভাইজারই আছে কিন্তু লাইন চালানোর ক্ষমতা নেই। কিন্তু অনেকেই আছে এক বছরেই লাইন চীফ হয়ে যাচ্ছে। এই সবই সম্ভব যদি সে ধৈর্য্য ধারণ করে এবং পরিশ্রমী হয়।

মো. সেলিম খান: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইয়র্ক ফ্যাশন লিমিটেড

আজকের বাজার: ইএসএস/ আরআর/ ২৭ মে ২০১৭