উত্তরাঞ্চলের স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষে সফল ডোমারের দুই যুবক

জেলার ডোমার উপজেলায় পুকুরের স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষ শুরু করেছেন সেলিম আল মামুন বাবু (৪০) ও জুলফিকার রহমান বাবলা (৪১)। ইতিমধ্যে মুক্তা আহরণে সফল হয়েছেন তারা।
সেলিম আল মামুন বাবু (৪২) উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের জামিরবাড়ী চাকধাপাড়া গ্রামের তমিজ উদ্দিনের ছেলে ও ও জুলফিকার রহমান বাবলা (৪৪) সোনারায় হাজিপাড়া গ্রামের কাশেম উদ্দিনের ছেলে। নিজ বাড়ির পাশে বাবুর রয়েছে ৫৭ শতকের জলাশয়ে মাছ চাষের প্রকল্প। তেমনি বাবলারও রয়েয়েছে ৯০ শতক জমিতে মাছ চাষের প্রকল্প। তারা দীর্ষদিন ধরে বাণিজ্যিকভাবে মাছ উৎপাদন করে আসছিলেন। এরই মধ্যে মাছের ওই পুকুরেই মুক্তা চাষের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেন তারা। সে চিন্তায় ২০১৮ সালের মধ্য সময়ে মুক্তা চাষের প্রশিক্ষণ নেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউটে (বিএফআরআই)। ওই প্রশিক্ষণের পর থেকেই পুরোদমে কাজে নামেন তারা। এক বছরের মাথায় গত জুনে ঝিনুক থেকে মুক্তা আহরণ শুরু করেছেন।
তারা জানান, মুক্তা চাষের জন্য প্রয়োজন কিছু সরঞ্জাম। এসব সরজ্ঞামের মধ্যে রয়েছে ঝিনুক অপারেশনের কিটবক্স, দুই ধরণের নেট বক্স ও ইমেজ তৈরীর জন্য কিছু যন্ত্রপাতি। সাধারণত ১৮ থেকে ২০ মাস বয়সে অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ইমেজ স্থাপন করা হয় ঝিনুকের পেটে। মোম এবং ঝিনুকের খোলস দিয়ে তৈরী করা যায় ওই ইমেজ। খোলসের ইমেজে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই ঝিনুকের শরীরে। ঝিনুকে ইমেজ প্রতিস্থাপনের পর চারকোনের একটি নেটের বক্সে ছয় থেকে নয়টি ঝিনুক সাত দিন রাখা হয় আড়াই ফিট পানির নীচে। এসময়ে কোন খাদ্য গ্রহণ করতে দেওয়া হয়না ঝিনুককে। এরপর বলের মধ্যে গেলাকার নেটের ঝুড়ি বেধে প্রতিটি ঝুড়িতে তিন থেকে চারটি করে ঝিনুক ছেড়ে দেওয়া হয় পুকুরের পানিতে। ওই নেটে বল বাধার অন্যতম কারণ ঝুড়িটি যেন পানির গভীরে যেতে পারে না। ২১ থেকে ২৮ দিন পর এসব ঝিনুক উম্মুক্ত করা হয় পুকুরে। আট থেকে ১০ মাসের মধ্যে স্থাপিত ইমেজটি মুক্তায় পরিণত হয়। এসময়ে পুকুর থেকে ঝিনুক তুলে আহরণ করা হয় মুক্তা। প্রতি শতকে ৬০ থেকে ৭০টি ঝিনুক ছাড়ার পর বাড়তি কোন খাদ্য সরবরাহের প্রয়োজন হয়না। ঝিনুক সংগ্রহ থেকে মুক্তা আহরণ পর্যন্ত প্রতিটিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা খরচ হয় বলে জানান তারা।
ডোমার উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের সোনারায় হাজীপাড়া গ্রামে জুলফিকার রহমান বাবলার রয়েছে ত্বাকী জামান এগ্রো ফিসারিজ প্রকল্প। অপরদিকে একই ইউনিয়নের জামিরবাড়ি চাকধাপাড়া গ্রামে সেলিম আল মামুন বাবুর আছে মাছ চাষের প্রকল্প। ওই দুই প্রকল্পেই দেখা গেছে মুক্তা চাষের ব্যাপক প্রস্তুতি।
তারা আগে শুনেছিলেন মুক্তা চাষ করা যায়। কিন্তু কিভাবে করা যায় সেটা জানা ছিল না তাদের। গত বছর ময়মনসিংহে বিএফআরআইয়ে মাছ চাষের প্রশিক্ষণে গিয়ে স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষের প্রশিক্ষণের খবর পান জুলফিকার রহমান বাবলা। সে বছরের জুলাই মাসে বাবলা তিন দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝিনুক ও অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করে নামেন মুক্তা চাষে। সংগৃহিত ৫০ হাজার ঝিনুক সংগ্রহ করে ৬০০টিতে মুক্তা চাষ করেছেন। একইভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে সেলিম আল মামুন বাবুও নামেক কাজে।
সেলিম আল মামুন বাবু বলেন, ‘মুক্তা হচ্ছে জীবন্ত ঝিনুকের দেহের ভেতরে জৈবিক প্রক্রিয়ায় তৈরী এক ধরণের রতœ। সেটি সাধারণত গোলাকৃতির হয়। চাষ করা মুক্তায় অলঙ্কারে ব্যবহারের উপযোগী বিভিন্ন আকারের ইমেজ তৈরী করে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঝিনুকের ভেতরে স্থাপন করা হয়। আমরা ঝিনুকের খোলস দিয়ে ইমেজ তৈরী করে তা প্রতিস্থাপন করছি। সেটি ঝিনুকের শরীরের দ্রুত ম্যাচিং হয়, মৃত্যুর হারও কমে। ইমেজটিও সহজে ভাঙে না।
তিনি বলেন, ‘সাত থেকে আট মাসের মধ্যে ইমেজ থেকে মুক্তা তৈরী হয়। সাধারণত বড় আকৃতির সুস্থ সবল হলুদাভাব তরুণ ঝিনুক মুক্তা উৎপাদনের বিশেষভাবে উপযোগী। একটি মুক্তা উৎপাদনে খরচ পড়ে মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকা। মাছ চাষের পুকুরে সেটি করা হলে মাছের উৎপাদনের কোন ক্ষতি হয় না। বরং বাড়তি আয় করা সম্ভব। প্রতিটি মুক্তা সর্বনি¤œ ৫ হাজার টাকা দামে বিক্রি করা সম্ভব।
তারা বলেন, ‘উত্তর বঙ্গের স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এর ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়লে অনেক নারী পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি এ এলাকায় মুক্তার একটি বাজার গড়ে উঠবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় হবে।’
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউটের (বিএফআরআই) উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ফেরদৌস সিদ্দিকী বলেন, এ কার্যক্রমটি সারা বিশ্বে চলছে। ১৮৭০ সালে জাপানে প্রথম স্বাদু পানিতে মুক্তা ঝিনুকে মুক্তা উৎপাদন শুরু হয়। আমাদের দেশে দেরীতে হলেও কার্যক্রমটি শুরু হয়েছে। আমাদের দেশে প্রাকৃতিকভাবে ঝিনুক পাওয়া যায়। তাপমাত্রাও ১০ মাস উষ্ণ থাকে, সে দিক থেকে মুক্তা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ইরোপিয়ান দেশ, প্রাচ্যের দেশে মুক্তার ব্যবহার রয়েছে। শুধু অলঙ্কারে নয় চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যবহার হচ্ছে। আয়ুরবেদিক ওষুধ তৈরীতে, রূপচর্যার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি মুক্তার উৎপাদনের পরে আমরা ঝিনুকের খেলসকেও ব্যবহার করতে পারি। ঝিনুকের খোলসের চুর্ণ চুন এবং সিমেন্ট তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। আবার মুক্তা উৎপদনের পর যে খোলস থাকে তা দিয়ে অনেক সৌখিন জিনিস তৈরী করে আয় করা যায়।
তিনি বলেন,‘প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের মধ্যে আট থেকে ১০ জন সফলভাবে প্রথম পর্যায়ে মুক্তা উৎপাদন করছেন। সেটির বাজার সৃষ্টির জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সঠিকভাবে বাজারজাত করা গেলে আয়মুখি নূতন একটি সোর্স তৈরী হবে।’
বাজার সৃষ্টির ব্যাপারে বলেন, নূতন প্রডাক্ট যখন আসে তখন বাজার তৈরীতে সমস্যা হয়। একটা সময়ে বাজার সৃষ্টি হয়। দেশের বাইরে চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এমনকি পাশ্বর্তী দেশ ভারতেও ইমেজ মুক্তার ডিমা- রয়েছে। আমাদের দেশেও অভিজাত শ্রেণী দাম দিয়ে মুক্তা কিনছেন। জুয়েলারী দোকানে মুক্তা বিক্রি হচ্ছে। ফার্মারদের সাথে বায়ারদের যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। সরকার এবিষয়ে এগিয়ে আসলে কৃষক উপকৃত হবেন, দেশ এগিয়ে যাবে এবং নতুনএকটি শিল্পের বিকাশ ঘটবে।

সূত্র – বাসস