এগিয়েছে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত

কৃষি প্রধান বাংলাদেশ – প্রবাদবাক্যের মতো এ কথাটি এখন আর ওতটা উচ্চারিত হয় না৷বাংলাদেশ এখন আর শুধুই কৃষি নির্ভর নয়৷কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে, বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার৷ তারপরও বাংলাদেশ এখন রয়েছে শিল্পের ‘টেক অফ স্টেজে’৷

বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান খাতে পরিণত হয়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানি৷ অর্থাৎ শিল্প খাত, এবং তার সঙ্গে সেবা খাত এগিয়ে গেছে অনেক৷
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ এখনো গ্রামে বাস করে৷ গ্রামে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগ এখনো কৃষি খামার বা চাষাবাদে জড়িত। অন্যদিকে শহরেও শতকরা প্রায় ১১ ভাগ মানুষ সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত৷

মোট দেশজ উৎপাদনের হিসেবে জিডিপিতে এখন কৃষিখাতের অবদান শতকরা ১৫.৩৩ ভাগ৷ এছাড়া কৃষিখাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে ৪৮.১ ভাগ কর্মজীবী মানুষের৷

কৃষি থেকে শিল্প
এরপরেও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ধীর গতিতে কৃষি প্রধান অর্থনীতি থেকে একটি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দেশে পরিণত হচ্ছে৷

২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ২১. ৮ ভাগ৷ ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর – এ সময়ে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান কমতে থাকে৷ ফলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে এসে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান দাড়ায় ১৮.৭ ভাগ৷ সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের জিডিপিতে সেবাখাতের অবদান ৫৩.৩৯ ভাগ, শিল্প খাতের ৩১.২৮ এবং কৃষি খাতের ১৫.৩৩ ভাগ৷ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনটি বৃহৎখাতের মধ্যে কৃষির অবদান এখন তৃতীয়৷

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ সালে রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৪৮.৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ যার ৯০ ভাগ তখন আসে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে৷ আশির দশকে এ ধারার পরিবর্তন শুরু হয়ে, যা এখন আরো দ্রুত হচ্ছে৷ কৃষির জায়গা দখল করে নিচ্ছে শিল্প এবং সেবা খাত৷ বর্তমানে বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানি আয় মিলিয়ন নয়, ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷

কৃষি উৎপাদনও বাড়ছে
বাংলাদেশে এখন কৃষিপণ্য ধান, গম, ভুট্টা, চা, পাট, তুলা, আখ, আলু, ডাল, তৈলবীজ, সবজি, ফল, মশলা, ফুল ও রেশমগুটি৷ এর বাইরে মাছ চাষ, সবজি চাষ, গাবাদি পশু ও হাস-মুরগি পালন অন্যতম৷দেশের অর্থনীতিতে কৃষির আনুপাতিক অবদান কমলেও মোট কৃষি উৎপাদন বেড়ছে অনেক৷ কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার এবং যন্ত্রের ব্যবহার উৎপাদন বাড়ার পেছনের প্রধান কারণ৷ এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ এবং পরিবেশ সহিষ্ণু বিভিন্ন ফসল৷

বাংলাদেশে এক সময় গমের চাষ ছিল না বললেই চলে৷ কিন্তু এখন গমের আবাদ বাড়ছে৷ প্রচলিত তৈল বীজের পাশাপাশি বেড়েছে সূর্যমুখীর চাষ৷ বণিজ্যিক ভিত্তিতে শাক-সবজি চাষে রীতিমত বৈপ্লবিক অগ্রগতি হয়েছে৷ এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পোল্ট্রি শিল্প এবং গবাদী পশু লালন পালন, ডেইরি ও মৎস চাষ৷

৪৪ বছরে দেশের আলু চাষের জমি সাড়ে ৫ গুণ বেড়েছে৷ ফলন বেড়েছে ১০.৯ গুণ৷ এই সময়ে গমের উৎপাদন বেড়েছে ১২.২৫ গুণ৷ ভুট্টার ফলন বৃদ্ধির হার রীতিমতো বিস্ময়কর৷ এ পর্যন্ত দেশে ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ৭৫৭ গুণ৷ আর এ ফসলের জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ৷
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়৷ স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ৷ এখন প্রায় সারা বছরই ২০ থেকে ২৫ জাতের সবজি উৎপাদন হয়৷ গত এক দশকে বাংলাদেশে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে৷

এফএও বলছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ৷এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চিন৷ এফএও-র হিসাবে সমুদ্রে মাছ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম৷

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসেব অনুযায়ী, ১৯৭১ থেকে ২০১৫ সাল এই ৪৪ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে ৩ থেকে ৭৫৭ গুণ৷

চাল রপ্তানি করে বাংলাদেশ
একসময় বাংলাদেশে বেশির ভাগ ধান ছিল প্রকৃতি নির্ভর, যেমন আমন ও আউশ৷ ১৯৭০-৭১ সালে দেশের মাত্র ২০ শতাংশ ফসল আসত বোরো থেকে৷ আর এখন দেশের ৫৫ শতাংশ চাল আসে বোরো থেকে৷ বোরোর মোট উৎপাদন বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ৷

বিবিএস-এর তথ্য অনুযায়ী, ৪৪ বছরে দেশের ধান চাষের জমি ১৮ শতাংশ কমেছে৷ কিন্তু একই সময়ে চালের উৎপাদন বেড়েছে ৩.১৬ গুণ৷
বাংলাদেশ এখন চাল রপ্তানিকারক দেশ৷ বছরে দুই লাখ টন চাল রপ্তানি করা হয়৷ শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের চাল নিচ্ছে৷ আফ্রিকায় চাল রপ্তানির জন্য বাজার খোঁজা হচ্ছে৷যদিও এবার আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের কারণে খাদ্যঘাটতি দেখা দেয়ায়, চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার কয়েক দফায় চাল আমদানী করেছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট’র তথ্য মতে, সংস্থার বিজ্ঞানীরা ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭৪টি উচ্চফলনশীল (উফশী) ও চারটি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন৷ এর মধ্যে ১৪টি জাত লবণাক্ততা, বন্যা ও খরাসহিষ্ণু৷ এছাড়া বাংলাদেশ আণবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)-এর বিজ্ঞানীরা ১৬ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন, যার চারটি লবণাক্ততা ও খরাসহিষ্ণু জাত৷

এখনো কৃষি সম্ভাবনাময়
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কামাল মুজেরী বলেন, ‘‘বাংলাদেশে কৃষি থেকে শিল্পে একটা টেক অফ স্টেজ চলছে৷ কৃষির উৎপাদন বাড়ছে বা উন্নয়ন ঘটছে তবে তা শিল্পের সঙ্গে সমান গতিতে নয়৷ এটা পৃথিবীর যেসব দেশে শিল্প উন্নয়ন হয়েছে সব দেশেই একই চিত্র দেখা গেছে৷ সাধারণভাবে অবশ্য কৃষির প্রবৃদ্ধি শিল্পের মতো দ্রুত গতিতে হয় না৷

তবে তিনি মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশে কৃষির প্রচুর সম্ভাবনা রয়ে গেছে৷ সেব সম্ভাবনা ব্যবহার করা প্রয়োজন৷ কৃষিকে আধুনিকায়ন করতে হবে৷ একর প্রতি উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে৷ ব্যবহার করতে হবে উন্নত প্রযুক্তি৷

তিনি বলেন, শুধু কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেই চলবে না, কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হবে৷ কৃষককে ভর্তুকিসহ, উন্নত সার ও বীজের নিশ্চয়তা দিতে হবে৷ এ জন্য প্রয়োজন দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের ওপর জোর দেয়া৷

তিনি আরো বলেন, কোনো কোনো কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ছে৷ আবার কোনোটির কমছে৷ এর কারণ হলো কৃষক তাঁর অর্থনৈতিক লাভের দিক বিবচনা করে নতুন কৃষিপণ্যের দিকে ঝুঁকছে৷

তাঁর কথায়, সোনালী আঁশ পাটের দিন আবারো ফিরে আসছে৷ আমরা সঠিক পরিকল্পনা নিলে সেই সুদিনের সুবিধা নিতে পারব৷ যেটা ভারত পেরেছে৷

কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
বাংলাদেশের কৃষি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ‘উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা’ বা উবিনীগ-এর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার বলেন, ‘‘বাংলাদেশে যে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে তা ধানের ক্ষেত্রে টেকসই বলে আমি মনে করি৷

তিনি বলেন, অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষ করে শাক-সবজি উৎপাদন বাড়াতে যা করা হয়েছে তা ক্ষতিকর৷ নানা জাতের সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে বিষাক্ত শাক-সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে৷ এর ফলে মানুষের চিকিৎসা খরচ বেড়ে যাচ্ছে৷

তাঁর কথায়, এতে বিভিন্ন কৃষি ও কীটনাশক কোম্পানি লাভবান হচ্ছে৷ কৃষক নয়৷ কারণ উৎপাদন বেড়ে গেলে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যায়৷ তাই অনেক কৃষক কৃষি ছেড়ে দিচ্ছে৷ যাঁরা আছেন, তাঁরা বাধ্য হয়ে আছেন৷

ফরিদা আক্তার বলেন, জিএম ফুড এবং উচ্চ ফলনশীল বীজের নামে কৃষককে জিম্মি করা হচ্ছে৷ বীজের অধিকার তাঁদের হাতে থাকছে না৷ অনেক বীজের ‘পেটেন্ট রাইট’ নিয়ে যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি৷ সরকারও এ নিয়ে কারুর পরামর্শ শুনছে না, যা খুবই উদ্বেগের।

আজকের বাজার: আরআর/ ২৭ আগস্ট ২০১৭