এফবিসিসিআই নেতৃত্বকে দক্ষ হতে হবে

জুয়েলারি সেক্টরের অতিপরিচিত নাম মো: আনোয়ার হোসেন। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সমৃদ্ধ করেছেন অভিজ্ঞতার ঝুঁলি। তার এই অভিজ্ঞতার আলোকে জুয়েলারি সেক্টরের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন আজকের বাজারের সঙ্গে। আলোচনার মূল অংশ তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

ব্যবসা বাণিজ্যের সার্বিক অবস্থা
প্রথমেই আমি বলব কয়েকদিন আগে খবরের মাধ্যমে জানলাম, আমরা ব্যবসার দিক দিয়ে এখনও অনেক পিছিয়ে। ব্যবসার পরিবেশগত ভাবে যে দেশ  ব্যবসা উপযোগী সে দেশগুলো অনেক এগিয়ে আছে, উন্নতির শিখরে আছে তারা। সে দিক বিবেচনা করলে তাদের তুলনায় আমরা আসলেই অনেক পিছিয়ে আছি।

ব্যবসা করতে গেলে আমাদের প্রতি মূহুর্তে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। সরকারি অব্যবন্থাপনা আর আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে ভোগান্তির শিকার হই। বিনয়ের সঙ্গে বলবো আমলারা  ব্যবসা খুব ভালো বোঝেন না। যার ফলে সরকারি যত কল কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের হাতে পরিচালিত হয়েছে বা হচ্ছে, ব্যবসা না বোঝার কারণে তার প্রত্যেকটি মুনাফা না করে লোকসানের শিকার হয়। এর একমাত্র কারণ তাদের অদক্ষতা। কিন্ত দেখেন তারা যে কয়টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারিখাতে দিয়েছে তার প্রত্যেকটিতে দক্ষ কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সফলভাবে পরিচালিত হয়েছে এবং হচ্ছে। দেখুন সরকারী আমলা, নীতি নির্ধারকরাই সকল পলিসি তৈরি করেন যা মোটেও দেশের জন্য যুগপোযোগি ও সময়োপযোগী ব্যবসা বান্ধব হয় না। যার কারণে আমরা এগিয়ে যেতে পারছি না। এ জন্য ব্যবসা ক্ষেত্রে সকল পলিসি যত সহজ হবে, তত আমরা এগিয়ে যেতে পারব। ফলে শিল্প কারখানায় অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, দেশের বার্ষিক গড় আয় বৃদ্ধিসহ সব ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে যেতে পারব।

আমাদের  সেক্টরে সমস্যা
আমাদের ব্যবসা মূলত জুয়েলারির, অভ্যন্তরীণ বাজারে তো আমাদের ব্যবসা আছেই, এ ছাড়া আমরা দেশের বাইরে রপ্তানি করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। আমরাই প্রথম বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এনে দেশেই রাফ ডায়মন্ড কাটিং করে বাজারজাত করি এবং দেশের বাইরে রপ্তানি করছি। ব্যবসা জগতে এটা বিশাল একটা সম্ভাবনাময় খাত, কিন্ত কিভাবে কী, আমরা প্রথম শুরু করেও কেবলমাত্র সরকারি পলিসির সঠিক প্রয়োগের অভাবে এগিয়ে যেতে পারছি না। না হলে আজ এ শিল্প অনেকদূর এগিয়ে যেত। বার বার আবেদন নিবেদন করেছি এমন কী প্রপোজাল পর্যন্ত দিয়েছি।

আপনি জেনে অবাক হবেন সারা বিশ্বে হাতে তৈরি করা পণ্যের আলাদা কদর রয়েছে। আমাদের কারিগরদের তৈরি করা পণ্যের অনেক প্রশংসা করে সবাই। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের স্ট্রাটেজি অনুযায়ী এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বিশ্বে হাতে তৈরি করা যত জুয়েলারী কারিগর রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশেরই ৮১ ভাগ কারিগর। এই যে আমাদের দক্ষ জনশক্তি, এটাই একটা বিরাট সুযোগ। কিন্ত আমাদের সঠিক পলিসি না থাকার কারণে, আমাদের প্রস্তাবিত প্রপোজাল আমলে না নেয়ার কারণে, সম্ভাবনা থাকার পরও আমরা আজ এগিয়ে যেতে পারছি না।

ব্যবসার প্রসারে বড় চ্যালেঞ্জ
এ বিষয়ে মূল সমস্যা হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আমরা যদি লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাব দেশের মধ্যে কোন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে গেলে অনেক বাঁধা মোকাবেলা করতে হয়। কিন্ত উন্নয়নশীল দেশেগুলোতে কী ঘটে, ইউরোপ আমেরিকা, জাপান বাদ দিলাম আমাদের পাশের দেশ মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের দিকে দেখেন। সেখানে যদি একজন ব্যবসায়ী কোন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে যান তাহলে সরকার থেকে সব রকম সহযোগিতা তারা পান। অনুমোদন থেকে শুরু করে অবকাঠামোসহ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, দক্ষ জনবলসহ সরকার থেকে সব রকম সহযোগিতা রয়েছে তাদের জন্য। ফলে একজন মেধাবী ব্যবসায়ী তার শ্রম, মেধা দিয়ে যেভাবে একটা সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে চায় ঠিক সেভাবেই সে  তা করতে পারে। এর ফলে তারা দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি বহির্বিশ্বের বাজার ধরতে পারছে অনায়াসে। সে দেশের সরকারি কর্মকর্তারা ব্যবসায় সব ধরনের সহযোগিতা করেন। কিন্ত আমাদের দেশের চিত্র বলতে গেলে পুরো উল্টো। এখানে তারাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন ধাপে ধাপে।

আমরা যারা এনবিআর রিলেটেড যে সকল প্রতিষ্ঠান রয়েছে অর্থাৎ একটা পণ্যকে যদি রপ্তানি করতে হয়, প্রমোশন করতে হয়, তা হলে পণ্যের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির জন্য সুযোগ দিতে হবে। এবং সেটা যাতে সহজ পদ্ধতিতে হয়। দেখুন পলিসি প্রাইভেসি সঠিকভাবে মনিটর না করার জন্য আজ আমাদের গার্মেন্টস শিল্প কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সেরকম যদি জুয়েলারি শিল্পটার আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে গোপনীয়তা না থাকে, বা সঠিক পলিসি প্রয়োগ করা না হয় তাহলে আমাদের আরো পিছিয়ে পড়তে হবে। এর জন্য পর্যাক্রমে অনেকগুলো প্রপোজাল আমরা দিয়েছি। এই ব্যবসার জন্য যে কোন ধরনের কঠিন সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমে করা যায়। কিন্ত আলোচনার উদ্যোগই যদি না থাকে বা এতে যদি কর্তৃপক্ষের অনীহা থাকে, এড়িয়ে যাওয়া হয় তা হলে  সমস্যার সমাধান কে করবে, কেনো সমাধানই হবে না। ফলে জুয়েরারি শিল্পটা সেভাবে বিকাশমান হবে বলে মনে হয় না।

এ ক্ষেত্রে আমাদের এসোসিয়েশন থেকে ১৯৯৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময় সরকারকে আবেদন করে আসছি, বার বার বসেছি, আলোচনার পর আলোচনা হচ্ছে, কথা বলে যাচ্ছি কিন্ত এখন পর্যন্ত আমরা সমাধানের জন্য ভালো কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি। ওই যে রবি ঠাকুরের কথার মতো…

‘এতোদিন বুঝি তার ঘুচে গেছে আশ,
খুুঁজে খুঁজে ফিরি তবু,
বিশ্রাম না-জানি কভূ,
আশা গেছে,
যায় নাই খোঁজার অভ্যাস’।  
পরশ পাথর কবিতার এ পক্তির মধ্যেই আমাদের সকল ব্যাথার কথা নিহিত রয়েছে।

 প্রসঙ্গ এফবিসিসিআই নির্বাচন
এ দেশের আমলাদের অনেক ক্ষমতা, তারা কখনই সঠিকভাবে কাজ করেন না বা করতে চান না, এর জন্য এফবিসিসিআই বলেন বা অন্য কোন সংগঠন জানতে চাইলে জবাবদিহিতাও করেন না তারা। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে শতকরা ৮১ ভাগ অবদান রয়েছে আমাদের। এ সহযোগিতা কিন্ত কম কথা না। তাদেরই সংগঠন এফবিসিসিআই। এ সংগঠনকে অবশ্যই সেরকম মূল্যায়ন করে গুরুত্ব দিতে হবে। আবার সে সংঠনের নেতৃস্থানীয়দেরও যোগ্য হতে হবে, কারণ তাদের দুর্বল নেতৃত্বের কারণে অনেক সময় দাবি আদায় করা সম্ভব হয় না। এ দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য যারা যোগ্য, ব্যবসা বোঝেন ও জানেন, পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারেন তাদেরকে নির্বাচন করা জরুরি।

এফবিসিসিআই হচ্ছে ব্যবসায়ী সমাজের সর্বোচ্চ সংগঠন। আমি আশা করি এ দেশে শুধু আমদানি নির্ভর ব্যবসা না করে কিভাবে আরো রপ্তানিমুখী ব্যবসা বাড়োনো যায় এ ব্যাবস্থা গ্রহণ করা। বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান বাড়ানো, যার মাধ্যমে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা দেশে নিয়ে আসতে পারি। আমাদের আয়ের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে সম্মান যাতে আরো বৃদ্ধি হয় এর উদ্যোগ নেয়ার জন্য অবশ্যই আমরা ভূমিকা রাখবো। সরকারের বিভিন্ন সহযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠান যদি আমাদের ব্যবসায়িক পলিসি সহজ করে এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসে, আমাদের পথ দেখিয়ে দেয় তাহলে আমরাও তাদেরকে পথ তৈরি করে দেব। এটা যদি করা যায় এবং ব্যবসায়ী ও সরকারের মধ্যে যদি পাবলিকলি একটা বোঝাপড়া থাকে, সমঝোতা যদি হতে পারে এবং সর্বোতভাবে তারা যদি ব্যবসায়ীদের দাঁড়াতে সহযোগিতা করেন তাহলে গাছ বড় হবে, ফল ধরবে। সে ফল সবাই খেতে পারবে। কিন্ত গাছ বাড়ার আগেই যদি আমরা ফল খাওয়ার চেষ্টা করি তাহলে তো সব শেষ, গাছই দাঁড়াতে পারবে না।

 নতুন যারা ব্যবসায় আসতে চান তাদের জন্য
যারা জুয়েলারি ব্যবসায় আসতে চান তারা আসতে পারেন অনায়াসে। কোন না কোনভাবে ব্যবসায় জড়িত আছেন কিন্তু মন স্থির করেন নি বা যারা একেবারেই নতুন তাদের বলছি। এই ব্যবসায় কঠিন সংগ্রাম করতে হবে। কারণ আমরা পুরোনোরাই হিমশিম খাচ্ছি। এখনও কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছি। সে যায়গায় নতুনদের জন্য তো সহজবোধ্য হবে না। যে কোন ব্যবসার উদ্যোগ নেন না কেন আপনাকে ধৈর্য সহকারে ব্যবসার সব কিছু জেনে নিতে হবে, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। পৃথিবীতে কোন ব্যবসায়ী সৎভাবে কষ্ট ছাড়া সহজে কোন ব্যবসা দাঁড় করাতে পারে নি। অসৎভাবে তো অনেক কিছুই করা যায় সেটা আলাদা। সার্বিকভাবে আমি আহবান করব, শিক্ষিতদের এই ব্যবসায় এগিয়ে আসা উচিত। সরকারি চাকরির বাজার এখানে সীমিত। অনেকেই এখন কর্পোরেট চাকরির দিকে ঝুঁকছে। যেখানেই যান না কেন কোন না কোনভাবে সেটাও একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সবারই আগ্রহ থাকে বড় হওয়ার, শর্টকাটে সফলতার কোন সুযোগ কোথাও নেই। অবশ্যই সফল হতে হলে নতুনদের একাগ্রতা, নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে এগিয়ে  যেতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই।

ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কী করণীয়
আমাদের এই দেশকে আমদানি নির্ভর না করে কিভাবে দেশেই পণ্য উৎপাদন করা যায় এবং রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায় সে দিকে নজর দিতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। ব্যবসা ক্ষেত্রে সব অনিয়ম, দুর্নীতি, ট্যাক্স ভ্যাটে আমরা জর্জরিত। এগুলো থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। টিকে থাকার জন্য আমাদের সমন্বয় দরকার, সঠিক নেতৃত্ব দরকার। আর সেই নেতাকে বেছে নেওয়ার জন্য আপনার, আপনাদের সঠিক মতামত দরকার। আমরা অন্তর দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি দেশে একটা স্থিতিশীল ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে। আর এ জন্য আমি এবার আসছে এফবিসিসিআই এর নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। এই দেশটা যাতে আমরা সবাই মিলে সুন্দরভাবে গড়তে পারি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যাতে সুন্দর একটি দেশ গড়ে যেতে পারি, সে লক্ষ্যে মূল্যবান ভোট  ভোটাররা আমাকে দিবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

আজকের বাজার: আরআর/ ০৪ মে ২০১৭