করদাতাদের বয়স কমে গেছে

আজকের বাজার প্রতিবেদন
করদাতাদের বয়স কমে গেছে। ৪০ বছর বয়স যাদের তারা বেশ ভালোভাবে কর দিচ্ছেন। এটা অত্যন্ত আশা ও গর্বের কথা বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গেলো মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরে এনবিআরের কর অঞ্চল-৩ আয়োজিত ‘আয়কর ক্যাম্প ও করদাতা উদ্ধুদ্ধকরণ’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ৪০ বছর বয়সের বেশিরভাগ মানুষ কর দেন। গত ৮-৯ বছর ধরে এ সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। কর কর্মকর্তাদের আগের মতো মানুষ অপদস্থ আর অপছন্দ করে না। আমরা চেষ্টা করছি যারা কর আদায় করে তারা যেন করদাতাদের বন্ধু হয়।
অর্থমন্ত্রী বলেন, গত ৪০ বছর আমি করের সাথে সম্পৃক্ত। তখন কর যারা আদায় করত মানুষ তাদের ভয় পেত। পারত পক্ষে মানুষ তাদের কাছে আসত না।
তিনি বলেন, সেসময় নিবন্ধিত করদাতা ৭ লাখ থাকলেও কর দিত অনেক কম। এখন নিবন্ধিত করদাতা ৩০ লাখ। এরমধ্যে কর দেয় প্রায় ২৪ লাখ। গত ৪৭ বছরে যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। সেজন্য আমরা এনবিআরকে ধন্যবাদ দিতে পারি। আগে কর আদায় হত শত কোটি হিসেবে। এখন আদায় হয় লাখ কোটি হিসেবে। কর আদায়ের ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ৮ বছর ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এ সময়ে সার্বিক সব দিকে পরিবর্তন হয়েছে। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালে আমাদের স্বপ্ন দেখালেন আমরা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব। অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় যে আমরা ২০১৬ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। আমাদের ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হবে বলেছেন। আমরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছি এবং যেভাবে জনকল্যাণ সরকারের আদর্শ তাতে ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশ হওয়া কঠিন কিছু নয়। হয়ত তার আগেই আমরা সে অবস্থানে পৌঁছে যেতে পারব।
মুহিত বলেন, বিভিন্ন দেশ আমাদের নানা ধরনের সাহায্য দিত, এখনো সাহায্য অব্যাহত আছে। কিন্তু আগে যে রকম সাহায্য নিতাম এখনো সে রকম নেয় না। আমরাও ইতোমধ্যে আমাদের চেয়ে ভাগ্যাহত তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। যারা বিপদগ্রস্থ, দুস্থ, যারা পেছনে পড়ে রয়েছে; যারা উন্নত হতে চায়, তাদের আমরা হাত ধরে সামনে নিয়ে যাই। এটাই আমাদের উন্নয়ন মডেল বা মন্ত্র হতে পারে।
তিনি বলেন, আমরা খুবই গর্ববোধ করি। একদিকে যেমন নিজেদের চেষ্টায় অন্যের সহায়তা নিয়ে চরিত্র পরিবর্তন করছি, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করছি। ঠিক একইভাবে যারা এখনো দুর্দশায় আছে তাদের সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছি।
মন্ত্রী বলেন, উন্নয়ন বৃদ্ধির জন্য কর প্রয়োজন। আমরা ৩ ধরনের কর আহরণ করে থাকি। এছাড়া যে সেবা প্রদান করি তাতে কিছু চার্জ থাকে। এসব করে আমাদের যে বাজেটের জন্য টাকা তার সংস্থান করি। যা এ মুহূর্তে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। আমরা আশা করছি সামনের বছর অন্তত তা সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা বা তার চেয়ে বেশি টাকা এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে ৫ লাখ কোটি টাকার হবে।
তিনি বলেন, বাজেট বাড়ানোর উদ্দেশ্য হল যাতে আমরা মানুষকে নানা ধরনের সেবা দিতে পারি। আমরা সমাজ সেবামূলক কাজে জাতীয় আয়ের ২ শতাংশ ব্যয় করি। সেটা অনবরত আমরা বাড়িয়ে যাচ্ছি। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশে যাতে গরীব না থাকে। ৭% এর মতো লোক গরীব থাকবে। এরমধ্যে থাকবে প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, নারী। এ ৭% রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করবে। এটা হলো আমাদের ভিশন। জাতিসংঘের হিসেবে এ ভিশন ২০৩০ সালে বাস্তবায়ন হবে, কিন্তু আমার হিসেবে হবে ২০২৪ সালে।
করদাতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সবাই সহায়তা না করলে রাষ্ট্র সামনের দিকে এগুবে না। আপনারা যদি রাষ্ট্রের জন্য রসদ সরবরাহ না করেন, কর না দেন, শুল্ক না দেন তাহলে রাষ্ট্র কি করে বিভিন্ন ধরনের সেবা দেবে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসনসহ সেবা প্রদানের জন্য যেসব অর্থের প্রয়োজন হয় সে অর্থ এ সমাজই সরবরাহ করে। যারা একটু বিত্তশালী তারা কর-শুল্কের মাধ্যমে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলে, রাষ্ট্রের হাতে কিছু অর্থ দিলে মানুষের সেবা ও উন্নয়নে ব্যবহার করতে পারে।
তিনি বলেন, পুলিশ না হলে বেঁচে থাকা মুশকিল। তারা না থাকলে চুরি চামারি, মারামারিতে দেশ ছেয়ে যেত। এই জিনিসটা যেন আমরা মনে রাখি। তারা না থাকলে শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম না। পুলিশ না থাকলে বেশির ভাগ মানুষ রাস্তাঘাটে নিরবিঘেœ চলাচল করতে পারতাম না। এই বিষয়টা আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। পুলিশ বাহিনী মানুষের সেবায় কাজ করছে।
আয়কর আর ভীতির বিষয় নয়:
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বলেছেন, এখন আয়কর আর ভীতির বিষয় নয়। আয়কর প্রদান অত্যন্ত সহজ একটি বিষয় এবং আয়কর দেওয়াটা সবার নাগরিক দায়িত্ব।
তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী প্রাজ্ঞ প্রকাশ ভঙ্গিতে বলেন, আমাদের ব্যবসায়ী ও জনগণ আয়কর দিয়ে বাহাদুরী দেখাচ্ছেন। আয়কর দিয়ে জনগণের বাহাদুরী দেখানোর সময় এখন। আয়কর আর করদাতা সংগ্রহে আমরা সারাদেশে যাচ্ছি। জনগণকে বাহাদুরী দেখানোর সুযোগ দিচ্ছে এনবিআর।
নজিবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছে। এ রোল মডেলকে আরও সমুন্নত ও সুসংহত করার জন্য রাজস্ব আহরণের প্রক্রিয়া আরও সুসংহত হবে। গত বাজেটে অর্থমন্ত্রী দেশের যে অমিত সম্ভাবনা রয়েছে সে সম্ভাবনাকে উৎঘাটিত এবং ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করার কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, প্রথম আমাদের বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রীর হাত ধরে বাড়তে বাড়তে তা ৪ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। তার স্বপ্ন হচ্ছে ৫ লাখ কোটি টাকায় উপনীত করার। সবার অব্যাহত সহযোগিতার মাধ্যমে এটা সম্ভব হবে।
চেয়ারম্যান বলেন, অর্থমন্ত্রী কর বাহাদুর পরিবার সম্মাননা দেয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশে যারা আয়কর দেন অর্থমন্ত্রী তাদের বিভিন্নভাবে সম্মাননা দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা আয়কর মেলা করে ট্যাক্স কার্ড দিই। আগামী ১ থেকে ৭ নভেম্বর আয়কর মেলা অনুষ্ঠিত হবে। নভেম্বরের ২৪ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত জাতীয় আয়কর সপ্তাহ। ঢাকা থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান করি। বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে এর প্রমাণ হচ্ছে আমাদের একটি নিজস্ব আয়কর দিবস রয়েছে। নভেম্বর মাস হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য আয়কর প্রদানের একটি উৎসব।
তিনি বলেন, ট্যাক্স ক্যাম্প এর মাধ্যমে আমরা করদাতাদের দোরগোড়ায় যাচ্ছি। সুদূর চর কুকরি-মুকরি, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়াসহ সারাদেশে এ ক্যাম্প হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় এ ক্যাম্প করা হচ্ছে।
কর বাহাদুর পরিবার সম্মাননা সম্পর্কে চেয়ারম্যান বলেন, একই পরিবারের উপার্জনক্ষম সবাই কর দিলে তাদের আমরা চিহিৃত ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করবো। কাজ শুরু হয়েছে। শিগগিরই কাজ শেষ করে আয়কর মেলার শেষে তা ঘোষণা ও পুরস্কার দেয়া হবে।
তিনি বলেন, দেশে একটি রাজস্ববান্ধব সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায়ও তা উল্লেখ করেছেন। আমরা করসেবা প্রদান শুধু উপজেলা নয়, ইউনিয়ন পর্যন্ত নিয়ে গেছি। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার ব্যবহার করে ই-টিআইএন, অন্যান্য কর, ভ্যাট ও শুল্ক সেবা সংক্রান্ত সেবা, তথ্য প্রদান করছি। চেয়ারম্যান বলেন, অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর নির্ভর করে দেশের উন্নয়ন করতে হবে। সেজন্য আয়করের এত বেশি প্রয়োজন। ভ্যাটে কোনো ফাঁকি দেয়া যাবে না। নাগরিকদের পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে সরকারকে সঠিকভাবে রাজস্ব দেয়া। রাজস্ব দিলেই পদ্মাসেতু, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো উন্নয়ন কাজ হবে। এসব জনগণের করের টাকায় হচ্ছে।
উন্নয়নের জন্য কর প্রদান অব্যাহত রাখার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, আমার সহকর্মীরা অতীতের সব দুর্নাম মুছে ফেলে আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন; একটি করদাতাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। আমরা সুশাসন ও আধুনিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে কাজ করছি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা বলেন, করযোগ্য ব্যক্তি কর প্রদান না করলে সামান্য জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ জরিমানার পরিমাণ অনেক বেশি করা উচিত।এমন আইন করা উচিত যে সম্পদ অনুযায়ী কর নেয়া।
অর্থমন্ত্রীর প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের অনেক করযোগ্য ব্যক্তি রয়েছে। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে অন্তত ৫ কোটি মানুষকে অনলাইনের আওতায় আনুন। তাদের সম্পদ অনুযায়ী কর আদায় করলে ২০৪১ নয়, ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে। রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ করযোগ্য সবাইকে করের আওতায় আসার আহবান জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে কর অঞ্চল-৩ এর কমিশনার নাহার ফেরদৌস বেগম এর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন এনবিআর সদস্য (কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) মো. আব্দুর রাজ্জাক। ১৭৬ জন করদাতার মধ্যে কর সনদপত্র বিতরণ করা হয়।