কাটিংএজ ব্রিডিংই ধানের ভবিষ্যৎ

ড. এফ এইচ আনসারী :
বাংলাদেশের ৭০ ভাগ জমিতে ধান উৎপাদন হয়। সে অনুপাতে বলা যায়, আমাদের দেশের ধানের উৎপাদন অনেক বেশি। দেশের অর্ধেকেরও বেশি কৃষক ধান চাষের সাথে সম্পৃক্ত। ইরি বা আইআরআইয়ের সহযোগী সংগঠন ব্রি বা বিআরআই হচ্ছে, দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যারা ধান নিয়ে গবেষণা করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তারা নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে তারা বিভিন্ন দেশের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে, তাদের নিজস্ব জিন ব্যাংকে স্টোর করে। এই সমস্ত সংগ্রহ করা জার্মপ্লাজম আবার অন্যদেশে পরিবেশ অনুকূলে থাকলে, তাদের বিজ্ঞানী বা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কাছে পাঠানো হয়। এভাবেই উন্নত গবেষণা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিনিময় আর দেশীয় অভিজ্ঞদের জ্ঞান, কাজে লাগিয়ে ইরি বছরের পর বছর নতুন ব্রিড আবিষ্কারের মাধ্যমে ধানের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ৮২-৮৩ টি ধানের জাতের প্রায় সবগুলোই ইরির জার্মপ্লাজম সেন্টারের মাধ্যমে এবং তাদের টেকনিক্যাল সাপোর্টে আবিস্কৃত। সবচেয়ে আশার কথা হলো তারা ধানের নতুন একটি ব্রিডিং টেকনোলজি উদ্ভাবন করেছে, যাকে কাটিংএজ টেকনোলজি বলা হচ্ছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লবণাক্ত এলাকার জন্য কিভাবে একটা জাত উদ্ভাবন করে, টিকিয়ে রাখা যাবে, কিভাবে খরা প্রবণ এলাকার জন্য একটা জাতের উদ্ভাবন করা যাবে, অতি বৃষ্টিতে টিকবে এমন ধানের জাত উদ্ভাবন করা যাবে, অতি প্লাবনে পানির নীচে ধান থাকলে তখন কী করা হবে? আবার ধানের রোগবালাই, পোকামাকড়ের আক্রমণে কী করা হবে, এভাবে ধানকে সহনশীল হিসেবে উদ্ভাবনের জন্য, এ টেকনোলজিকে কিভাবে বাংলাদেশে প্রয়োগ করা যায়, তা নিয়ে কাজ চলছে। আমাদের তরুণ এবং অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের কাজে লাগিয়ে অনেক বর্ধনশীল ধানের জাত উদ্ভবন করা সম্ভব। এসব চর্চার মাধ্যমে, আমরা অনেক ভালো জাতের ধান, অনেক অল্প সময়ের মধ্যে পাওয়া সম্ভব। তাতে করে আমাদের ধানের উৎপাদন আরো বেড়ে যাবে। অল্প খরচে বেশি উৎপাদন করা যাবে। উৎপাদন খরচ কমবে, বাড়বে কৃষকের আয়। সর্বোপরি বিক্রেতারা সঠিক মূল্য পাবে এবং সাধারণ ভোক্তারা স্বল্প মূল্যে চাল কিনতে পারবেন।এ চিন্তা করেই টেকনোলজিটা তৈরি করা হচ্ছে। এ কাজের জন্য ইরির প্রধান বাংলাদেশ সফরে আছেন। তার সঙ্গে অন্য সবাই মিলে কাজ করছেন। বিনার ডিজি ও বিজ্ঞানীরাও আছেন। দু’দিনের এই সেমিনারের মাধ্যমে, তারা নতুন টেকনোলজির ব্যবহারে, কিভাবে যে কোনো পরিবেশে এবং স্বল্প সময়ে বেশি পরিমাণ ধান উৎপাদন করা যায়, তারই সমাধান আনার চেষ্টায় কাজ করছেন। এ সেমিনার থেকে যে ফলাফল আসবে, সেখান থেকে বিজ্ঞানীরা স্বপ্ন দেখবেন, সহনশীল পরিবেশে ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনের।আমরা জানি যে, গবেষণার মাধ্যমে একটা ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন করতে সাত থেকে দশ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এই টেকনোলজি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে আরো কম সময়ে নতুন ধানের জাত বা ব্রিড উদ্ভাবন করতে পারবে। পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে এটা সম্ভব। এই টেকনোলোজি নিয়ে বর্তমানে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি দেশে এ টেকনোলজি ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে দুই দিনের একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়। যেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক- বিজ্ঞানী, ইরি থেকে, বিনা থেকে, এসিআই ও অন্যান্য প্রাইভেট কোম্পানি থেকে গবেষক,বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। চার গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা ওয়ার্ক-আউট করেন, কোন কোন ক্ষেত্রে, এ টেকনোলজি যথাযথ ভাবে ব্যবহার করা যাবে এবং এর সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে, কোন কোন ক্ষেত্রে দ্রুত ও সহজে ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন করা যাবে?

আমাদের ধানের উৎপাদন আরো বেড়ে যাবে।
অল্প খরচে বেশি উৎপাদন
করা যাবে। উৎপাদন খরচ কমবে,
বাড়বে কৃষকের আয়। সর্বোপরি বিক্রেতারা সঠিক মূল্য পাবে এবং সাধারণ
ভোক্তার স্বল্প মূল্যে চাল কিনতে পারবেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের কৃষি আরো বিপদের দিকে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত আবহাওয়ার তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, ঝড় বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, বন্যা খরা হচ্ছে, এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে অনেক দূর, মানুষের খাবারের সংস্থান করতে হবে। সমস্যাগুলো মাথায় রেখে এমন সব ধানের জাত উদ্ভাবন করতে হবে, যাতে বড় দুর্যোগেও এগুলো টিকে থাকতে পারে এবং ভালো ফলন দিতে পারে। তাহলেই সাধারণ মানুষ কম মূল্যে চাল কিনতে পারবে, কৃষকরা চাষের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্য পাবে এবং অধিক হারে ধানের উৎপাদন হবে। এভাবেই একটা স্থায়ী ধানের জাত তৈরি হবে আমাদের দেশে।

কোন কিছু নিয়ে গবেষণা করতে গেলে অনেক টাকার দরকার হয়। কৃষি নিয়ে কাজ করে এমন প্রাইভেট কোম্পনিগুলোর অনেক বেশি টাকা খরচ করার মতো অবস্থা থাকে না। এ খাতের জন্য সরকারের যে বাজেট বরাদ্দ থাকে, তা থেকে আরো বেশি পরিমাণ অনুদান পেলে, ধরনের রিসার্চগুলো আরো বেশি বেগবান হয়। এসব বিবেচনা করে, ইউএসআইডি কিন্ত সরকার ও প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে বিভিন্নভাবে সহায়তা ও অনুদান দেয়। ফলে গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবাই ধানের জাতের উদ্ভাবন করতে সচেষ্ট হন। প্রশ্ন আসতে পারে, প্রাইভেট কোম্পানিকে অনুদান দিলে, তাদের লাভ কী? দেখার বিষয়, প্রাইভেট কোম্পানিগুলো যে কাজটা করছে, সাধারণ কৃষকও সেটা করার চেষ্টা করছে, সরকারও কিন্ত সেই একই কাজ করছে। মূলত সবাই কৃষির উপকারের জন্যই কাজ করছে। মানে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন। ফলে বেসরকারি কোম্পনিগুলোর নানা সহযোগিতায়, ব্রি’র নিজস্ব তত্ত্ববধানে, এ ধরনের কাজ হচ্ছে। ইউএসআইডি, ইরির মাধ্যমে আমাদের সহযোগিতা করেছে। ইউএসআইডি, এরইমধ্যে ইরিকে দিয়েছে তিন মিলিয়ন ডলার, এর মাধ্যমেই ইরি তাদের বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে, আমাদের দক্ষতা ও জ্ঞানের উন্নয়নে কাজ করছে। এভাবে আমরা গত পাঁচ বছরে ধানের জাত উদ্ভবনে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। ইউএসআইডির আর্থিক সহায়তার ফলে, ইরি আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। তারা সাধারণত প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে না। তবে এক্ষেত্রে তারা সরাসরি আমাদের সঙ্গে এ কাজে সম্পৃক্ত হয়েছে। আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, কাজের জন্য যে সমস্ত জেনেটিক উপাদান লাগছে, তা দিয়ে সহযোগিতা করছে, বীজ দিচ্ছে। এসব সহযোগিতার মাধ্যমেই বিভিন্ন সময় এ ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মশালা ও কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।

কৃষি কাজ হচ্ছে কঠিন ও শ্রমসাধ্য। এ জন্য সবাইকে সহনশীল হতে হয়। কৃষি নিয়ে কাজ করতে হলে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন থাকতে হয়। এসিআই ঔষধের ব্যবসা করে, ‘স্বপ্ন’র মাধ্যমে রিটেইলিং করে, অন্যান্য ভোক্তা-সামগ্রী বাজারজাত করছে। কৃষিতে এসিআইয়ের ব্যাপকভাবে কাজ করার একটি পরিষ্কার উদ্দেশ্য ও মিশন আছে। আমরা বলছি, বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য দরকার ‘রেসপনসিবল অ্যাপ্লিক্যাশন অব টেকনোলজি স্কিল’। এই যে দায়িত্বশীলভাবে আমরা টেকনোলজিটা দিব, কাকে দিবো? অর্থ্যাৎ, এ দেশের মানুষকে দিবো। দেখার বিষয়, এদেশের অর্ধেক মানুষ কিন্ত গ্রামে বাস করে। আমরা যদি শুধু ওষুধ বিক্রি করি, স্বপ্ন’র মাধ্যমে ভোগ্য পণ্য বিক্রি আর খুচরা ব্যবসা রাজধানীতে অব্যাহত রাখি; তাহলে প্রতিশ্রুতির জায়গায় পৌঁছনো যাবে না। যেহেতু সমাজের কথা আমাদের মাথায় আছে এবং কৃষকরা সেই সমাজের একটি অংশ, তারা আমাদের সংস্কৃতি-কৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কারণেই কৃষিতে আমরা এতটা বেশি নজর দিয়েছি। এর মাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নির্দিষ্ট ‘অ্যাপ্লিক্যাশন অ্যাপ্লাই’ করে কৃষক যথেষ্ট সফল হচ্ছে, কৃষি উপকৃত হচ্ছে, কৃষকেরা লাভবান হচ্ছে, দিন দিন কৃষিখাত উন্নত হচ্ছে।

এ ছাড়া কৃষিতে এসিআই আরেকটা মিশন হাতে নিয়েছে। সেটা হলো, কৃষককে সম্পদশালী করা। অর্থাৎ কৃষিতে যা উৎপাদিত হবে তা দিয়ে, কৃষক তার পরিবারের খাবারের সংস্থান করতে পারবে, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ দিতে পারবে, নিজেদের অবকাঠামো উন্নয়ন করতে পারবে। তারপর দেশের খাদ্যমজুদে সহযোগিতা করবে। আর এজন্যই আমরা কৃষিতে এতোটা আত্মনিয়োগ করে কাজ করছি। এ খাতের বিভিন্ন ধাপে যারা মেধাবী, বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে পেশাগতভাবে আমাদের কোম্পনিতে সম্পৃক্ত আছেন। তাদের মেধা, যোগ্যতা আর শ্রমের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য নিজস্ব স্বপ্ন আছে। প্রত্যেকের নিজস্ব অবজেকটিভ মাথায় নিয়ে, কৃষির উন্নয়নে বিশাল একটা টিম তৈরি করেছে এসিআই এগ্রো। ফলে আমাদের পক্ষে কাজটা করতে খুব সহজ হচ্ছে। সবাই স্বচ্ছতার সঙ্গে দেখতে পারচ্ছে, কৃষিতে এসিআইয়ের অবদান কতটুকু এবং কী কী? আমাদের কথা, কাজ আর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমরা এগুতে পারছি কি না।

ড.এফ এইচ আনসারী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও
এসিআই এগ্রি বিজনেস