কার্বন নিঃসরণ কমানোর পথের কাঁটা অজ্ঞতা আর সদিচ্ছা

কার্বন নিঃসরনের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ুর অব্যাহত পরিবর্তনে নেমে আসছে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। পরিত্রান পেতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন দেশ। ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৮ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সরকারের অধিকাংশ কমকর্তার এ সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং বেসরকারি খাতে সদিচ্ছার অভাবের কারণে এই উদ্যোগ বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি অর্থায়নের অভাব তো রয়েছেই।

পরিবেশবাদীরা মনে করেন, শিল্পায়নের যুগ থেকে মুনাফার স্বার্থে মানুষ প্রকৃতির দিতে খেয়াল না করেই পুড়িয়ে যাচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি, বায়ুমন্ডলে জমা করেছে কার্বনের অভিশাপ। এই মুনাফার উন্মাদনার কারণে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় একদিকে যেমন সমুদ্রপৃষ্ঠের তলদেশ উঁচু হচ্ছে, অন্যদিকে সাগরসংশ্লিষ্ট নদ-নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে গতিপথ পাল্টাচ্ছে।

হারিয়ে গেছে ঋতু বৈচিত্র। ওজন স্তরে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ফুটো। গলতে শুরু করেছে দুই মেরুতে জমে থাকা বরফ। জলবায়ুর প্রভাবজনিত কারণে বেড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা, কৃষিতে নেমে এসেছে বিপর্যয়।
প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের বিপন্নতার প্রেেিত ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ফ্রান্সের প্যারিসে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি সই হয়। এতে সই করে ১৭৫টি দেশ। এই শতকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বর্তমান গড় উষ্ণতার চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়বে না, বরং তা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার চেষ্টা চুক্তির মূল বিষয়।

তবে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ ও দফতর পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নয় বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ বা কমানোর মূল দায়িত্ব সরকারের। পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষেরও দায় রয়েছে। কার্বন নিঃসরণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সরকার বেশি সচেতন। কিন্তু কর্মকর্তাদের মাঝে সচেতনার অভাব রয়েছে।

টিআইবির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় কার্বন নিঃসরণ কমানোর সহজ ১০টি প্রধান কৌশল উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- নগরে যানজট নিরসন, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, ইটভাটায় জ্বালানি পরিবর্তন, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে জ্বালানি দতা বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আধুনিকায়ন, শহুরে বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদন এবং গ্রামে উন্নত চুলার ব্যবহার বাড়ানো।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘বাংলাদেশ নিজস্ব সম্পদ দিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ, পরিবহন ও শিল্প খাতে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ ১২ মেট্রিক টন কমানোর ল্য স্থির করেছে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে এই নিঃসরণ ৩৬ মেট্রিক টন কমানোর উদ্যোগ নিয়েছি আমরা।’ তিনি বলেন, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন গাইডলাইন ও নেট মিটারিং গাইড লাইন গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিস্তার ও কাঠামোগত অবস্থায় আনারও কাজ চলছে।

মূলত তিনটি খাত থেকে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কথা ভাবছে বাংলাদেশ। এগুলো হচ্ছে জ্বালানি, শিল্পখাত ও পরিবহণ। এরই অংশ হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ঘটাতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ। সারা দেশে সোলার হোম সিস্টেমকে জনপ্রিয় করে তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি সৌরশক্তি ব্যবহার করে সেচের পাম্প চালানো, প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাস্তায় সৌরশক্তি চালিত লাইটের ব্যবস্থা করা, পিকো সোলার সিস্টেম, গ্রিড টাই সোলার ইত্যাদির মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস তৈরি করা হচ্ছে। খোলা ছাদে বসানো সোলার সিস্টেম কার্বন নিঃসরণ কমাতে সহায়তা করবে। এছাড়া এলইডি লাইট, বায়োগ্যাস ও উন্নত চুলার ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ কারখানায় কার্বন নিঃসরনের নূন্যতম উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এজন্য সদিচ্ছার পাশাপাশি অর্থের অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও কারখানায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে সরকারের কিছু উদ্যোগ রয়েছে কিন্তু তা একেবারেই অপ্রতুল।

জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত উন্নত দেশগুলো দায়ী হলেও তিগ্রস্থ দেশগুলোর বেশির ভাগই দরিদ্র। বাংলাদেশ তালিকার প্রথম সারিতে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ জনপ্রতি ০.৪৪ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন করে। যুক্তরাষ্ট্রে এর পরিমাণ ১৬.৪ টন, অস্ট্রেলিয়ায় ১৬.৩ টন ও কাতারে ৪০.৫ টন।

প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে রাষ্ট্রগুলোর কার্বন নিঃসরণ কমানোর জাতীয়ভাবে নির্ধারিত ল্যমাত্রা (এনডিসি) বাস্তবায়ন। এই এনডিসি বাস্তবায়নে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। বাংলাদেশসহ প্রায় ৩০টি উন্নয়নশীল দেশ তাদের এনডিসি বাস্তবায়নে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সহায়তা চেয়েছে।

এদিকে বিশ্বজুড়ে টেলিযোগাযোগ খাতের উন্নয়ন এবং সেবার পরিসর বৃদ্ধির কারণে এ খাতের কারণে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি গ্রিনপিসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম ও ডিভাইস প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিবেশবান্ধব নয়। গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ঠেকাতে উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিবেশবান্ধব করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

২০২৩ সাল নাগাদ টেলিকম নেটওয়ার্কের ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর সুপারিশ করেছে ভারতের টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া (ট্রাই)। তবে বাংলাদেশে এ খাতের কার্বণ নিঃসরনের তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগ এখনও চোখে পড়েনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব পদেেপর মাধ্যমে সহজে টেলিকম খাতের কার্বন নিঃসরণ কমানো যেতে পারে, এর জন্য টেলিকম খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট।

টেকসই টেলিযোগাযোগ অর্জনের লক্ষ্যে গেল অক্টোবরে ভারতের টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন টেলিকম বিভাগের (ডিওটি) কাছে পাঠানো ট্রাইয়ের সুপারিশে বলা হয়েছে, টেলিকম নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমাতে সরকারের গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এজন্য টেলিকম অপারেটরদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও প্রযুক্তি সরবরাহসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। পাশাপাশি টেলিকম অপারেটরদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে উদ্যোগ গ্রহণ, এনার্জি সম যন্ত্রাংশ কিংবা উচ্চমতাসম্পন্ন চার্জিং স্টোরেজ ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে এতে।

আজকের বাজার: এনএল/ ওএফ/ ৩০ জানুয়ারি ২০১৮