কি হচ্ছে কাশ্মীরে?

Indian army soldiers guard during restrictions in Jammu, India, Monday, Aug. 5, 2019. India's government issued a revocation of the special constitutional status of its portion of Kashmir on Monday amid an uproar in Parliament and a huge troop deployment in the region. The constitutional provision forbids Indians from outside the region from buying land or permanently settling in the Muslim-majority territory. (AP Photo/Channi Anand)

মাঝরাত পার হওয়ার পর সেনারা এসেছে। আবিদ খানের হাত-পা তখন থরথর করে কাঁপছিল। কাশ্মীরের একটি এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার দুই ডজন তরুণের মধ্যে তিনি একজন।

স্থানীয়রা বলছেন, ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করতেই এই বেপরোয়া নির্যাতন। গত ৫ আগস্ট ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী সরকার হিমালয় অঞ্চলটির সাংবিধানিক বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা কেড়ে নেয়ার পর সেখানকার অধিবাসীদের ওপর নিপীড়নের স্টিমরোলার চলছেই।খবর এএফপি

সোফিয়ান জেলার হিরপোরা গ্রামের ২৬ বছর বয়সী আবিদ বলেন, তারা (ভারতীয় সেনারা) আমার ভাই ও আমাকে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যায়। এর পর দুজনের চোখ বেঁধে ফেলে।

‘এটা গত ১৪ আগস্টের ঘটনা। ঠিক রাস্তার পাশেই আমার ভাইকে বৈদ্যুতিক শক দেয়। মধ্যরাতে ভাইয়ের আর্তচিৎকার শুনে আমাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে,’ বললেন আবিদ খান।

এ সময় তার বাহু, পা ও নিতম্বে নির্যাতনের দাগ দেখাচ্ছিলেন এই তরুণ। চৌগাম সেনাক্যাম্পের কাছেই সেনারা তাকে নগ্ন করে হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে লোহার রড দিয়ে পিটিয়েছে।

তার বিরুদ্ধে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা হিজবুল মুজাহিদিনের রিয়াজ নাইকোকে আমন্ত্রণের অভিযোগ করেন ক্যাম্পের মেজর। সম্প্রতি বিয়ে করেছেন ওই কাশ্মীরি তরুণ।

১৯৮৯ সাল থেকে কাশ্মীরে সশস্ত্র বিদ্রোহে হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছেন। যাদের অধিকাংশই বেসামরিক।

‘অভিযোগ সত্যি না বলে বারবার আমি অনুরোধ করতে লাগলাম। তখন তারা আমার পুরুষাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেয়। একজন সেনা বলেন- আমি তোমাকে নিবীর্য করে দেব,’ বললেন কাশ্মীরি এ তরুণ।

আবিদ বলেন, ভোরে যখন তারা আমাকে ছেড়ে দেয়, তখন আমার দাঁড়ানোর কোনো শক্তি ছিল না।

১০ দিন একনাগারে বমি করে গেছেন তিনি। ২০ দিন পর হাঁটতে সক্ষম হয়েছেন।

‘আমি ঠিকমতো খেতে পারি না। আমার স্ত্রী যে কক্ষে ঘুমায়, সেখানে আমি যেতে পারি না। এমন নির্যাতনের চেয়ে বুলেট দিয়ে আমাকে মেরে ফেললেই পারত তারা।’

ভারতীয় সরকার বলছে, উত্তেজনা উসকে দিতে ইসলামাবাদ সমর্থিত সন্ত্রাসীদের হামলা প্রতিরোধেই গত মাস থেকে সেখানে অচলাবস্থা জারি করা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ এখনও বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে কোনো নিপীড়ন চালায়নি বলে দাবি করেছেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল রাজেশ কালিয়াও একই দাবি করেছেন।

তিনি বলেন, জনবান্ধব ও পেশাগতভাবে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে। কাজেই সেখানে নৃশংসতার যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা ভিত্তিহীন।

কিন্তু সেনাক্যাম্প থেকে প্রায়ই মধ্যরাতে মানুষের আর্তচিৎকার শুনতে পান বলে জানাচ্ছেন হিরপোরা গ্রামের লোকজন।

এ ছাড়া তিন গ্রামবাসী বলেন, তারা সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। এভাবে সোফিয়ান বিভিন্ন গ্রামের দুডজন তরুণ নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন।

এক তরুণ বলেন, প্রতিটি গ্রামের দুই কিংবা তিনজন তরুণকে বেছে নিয়ে নির্যাতন করে দৃষ্টান্ত তৈরি করছে সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনী বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে পরিচয়পত্র ও মোবাইল নিয়ে নেয়। এর পর সেগুলো ফিরে পেতে সেনাক্যাম্পে রিপোর্ট করতে বলা হয় তরুণদের।

২১ বছর বয়সী এক কাশ্মীরি বলেন, ২৭ আগস্টের পর পাহনো ক্যাম্পে তিনবার রিপোর্ট করেছেন তিনি। কিন্তু প্রতিবারই নির্যাতিত হয়েছেন।

এএফপিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই যুবক নির্যাতনে তার আহত হওয়ার ছবি দেখিয়েছেন।

তার বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খাবার সরবরাহের অভিযোগ করেন এক সেনা কর্মকর্তা। এরপর তথ্যের জন্য অর্থ সাধে তাকে। আরেকবার বিদ্রোহে যোগ দেয়া সাবেক এক সহপাঠীকে নিয়ে জেরার মুখোমুখি হন তিনি।

তিনি বলেন, অন্তত দুই ঘণ্টা ধরে একটি অন্ধকার কক্ষের ভেতর তারা আমাকে বৈদ্যুতিক শক দেয়। এ সময় হাতে নির্যাতনের ক্ষত দেখান এ তরুণ।

গুগলোরা গ্রামের বাসিন্দা ২১ বছর বয়সী ওবায়েদ খান। পরিচয়পত্র ফিরে পেতে একই ক্যাম্পে যেতে হয়েছিল তাকে। এছাড়া ২৬ আগস্ট তাকে ফোন করা হয়।

তিনি বলেন, আট সেনা লোহার রড দিয়ে দীর্ঘ সময় আমাকে বেধরক পেটায়। এরপর গ্রামের পাথর নিক্ষেপকারীদের নাম নিয়ে ফের ক্যাম্পে যেতে বলে।

পিনজোরা গ্রামের সাজ্জাদ হায়দার খান বলেন, সেনাবাহিনী ও পুলিশের হাতে আটক এক হাজার ৮০০ জনের একটি নামের তালিকা তিনি দেখেছেন। কাশ্মীর উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চীয় জেলা সোফিয়ান থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

শহর তাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। জামার আস্তিনে কমান্ডো লেখা পাঁচ সেনা অ্যাসল্ট রাইফেল নিয়ে তাদের বাড়িতে এসে সবার পরিচয় বিস্তারিত জানতে চায়।

তখন অনেকটা বিনীত স্বরে বলেন, চাপের কারণে এখানে লোকজন বিক্ষোভ করতে পারে না।

আজকের বাজার/লুৎফর রহমান